একজন নারীর আইডেন্টিটি তার পোশাক নয়

আমি কি পরবো, কতটুকু শরীর ঢাকা থাকবে বা খোলা থাকবে সেটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। তোমার দেয়া নামে আর আমার পরিহিত পোশাকে আমার পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়। তুমি আমাকে চেন না তাই আমাকে জাজ করতে এসো না। আমার শরীর কতটুকু খোলা রাখবো আমার ব্লাউজ কতটুকু খোলামেলা সেঁতা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার তুমি এখানে আমার দিকে তোমার আঙ্গুল তাক করে থেক না কারণ এটা তোমার শরীর না। এটা আমার শরীর।

দেখলাম ঢাকা লিট ফেস্টের পোষাক নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ বেঁধে গিয়েছে। এমনকি পোষাকের উপর ভিত্তি করে জাজ করা হচ্ছে আমাদের দেশের কে কত বড় … নারীবাদী।

আমরা এমন এক দেশের বাসিন্দা যে দেশে যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার হলেও নারীকে লজ্জায় আজীবনের জন্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়েছে। আবার পরিবারের ভরণপোষণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী নারী যখন সৌদি থেকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন আপনজন তখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তেমন দেশের নারীবাদীরা যতোই নারীবাদী হোন না কেন চিন্তায় অবচেতন মনে এখনও অনেকটাই পোষাক দ্বারা যে প্রভাবিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তথাপি একে অপরকে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করলে জট খুলতে শুরু করবে।

কিছুদিন আগেই একটি গল্প পড়লাম যেখানে গল্পের বধূ বরকে এক চড় দিয়ে কুকুরের বাচ্চা বলে আদরসোহাগে করতে অগ্রসর হয়। যেই না বলেছি গালি এবং চড় দিয়ে ভালোবাসা শো করা ঠিক মনে হয়নি, ওমনি লেখক বললেন, ‘দেখলাম আপনার প্রোফাইল পিকচারটি– আপনার প্রোফাইল পিকচার দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন?’

বাস্তবে আমিতো কিছুই বোঝাতে চাইনি কিন্তু তিনি কিছু বুঝতে চেয়েছেন পোষাকের আঙ্গিকে আমাকে জাজ করে–সেটা পরিস্কার হলো। আমার ঐ পোষাকটি দিয়ে যদি সে আমায় জাজ করতেন তাহলে প্রতিদিন বাসায় যে পোষাক পরে থাকি, তাতে তার হার্ট এ্যাটাক হবার কথা।

কে আমি, কী আমার পরিচয়–আমি না আমার পোষাক ?

ছোটবেলায় ‘পোষাকের মূল্য’ বলে একটি গল্প পড়েছিলাম যেখানে প্রধান চরিত্রটি কম দামী পোষাক পরায় অনুষ্ঠানে তাকে খাবার দেয়া হয় না। পরবর্তীতে ঐ একই ব্যক্তি যখন দামী পোষাক পরে আসেন তখন আপ্যায়নের ধুম পড়ে যায়। সেই দেখে ভদ্রলোক খাবার না খেয়ে পকেটে ভরতে থাকেন।

পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষকে কীভাবে শুধুমাত্র তার লিঙ্গ বা বক্ষ রিপেজেন্ট করে? তারপরও কাজ সম্পন্ন করতে শুধু যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই পদচারণা থাকে। তার থেকে বেশি কিছু দেখার একবিন্দু আগ্রহও জন্মে না ভেতরে।

দেশে দেখেছিলাম এক নারীকে, যার কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়াতে পারতেন না তিনি। ঘরেই অন্যের সহায়তায় প্রস্রাব-পায়খানা করতে হতো। তখন তাকে উঁচু করে ধরে বসাতে হতো চেয়ারে। ঐ সময়ও তিনি খুঁজতেন, আমার ওড়না কোথায়, আমার ওড়না কোথায়। আরেক মাকে দেখেছিলাম স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে। তার ছেলেরা মায়ের শরীর একজন নারীর বলে মায়ের ঘরে উঁকিও দিতেন না– বউরা যদি চেঞ্জ করে করবে নইলে তেমনই থাক আপন গর্ভধারিণী। নারীর শরীরের লজ্জা বলে কথা–জীবনের প্রশ্নেও?

সুনামীতে এক মহিলার কাপড় ভেসে যায় তাকে উঁচু নারকেল গাছে বসিয়ে দিয়ে। পরনে তখন তার একটি প্যান্টিও নেই। তিনদিন ধরে গাছের মাথায় রোদে শুকাচ্ছেন তিনি। পেটেও কিছু পড়েনি। উপরন্তু কনকনে ঠাণ্ডার রাত।

তিন দিনের দিন তিন তলার এক ভদ্রলোক দেখেন তাকে ঐ অবস্হায়। ইশারায় বলেন, যাবার তো কোন পথ নেই ওখানে, তবে বাঁশ দিয়ে আমার প্যান্টসটিই পাঠাতে পারি যদি চান–একজন নারী বলে কথা।নারী বলেন, প্যান্টস পাঠাতে হবে না। যদি উপকার করতেই চান, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব গিয়ে উদ্ধার কর্মীদের পাঠান।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন নারীকে জাজ করা হয় তার পোষাকের ধরন, বক্ষ/ লিঙ্গের আবরণ, এবং সহবাসের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে যদিও একজন মানুষের আসল পরিচয় তার মন্যুষত্বেই।

যেই পোষাক বদলাতে দু’মিনিটও লাগে না, সেই প্যাকেজিং কী করে একজন নারীকে রিপ্রেজেন্ট করে?

পোষাক যতদিন একজন নারীকে বিশ্লেষণ করবে, ততদিন ভেতরের নারীটির সমৃদ্ধি ঘটাবার আর প্রয়োজন অনুভূত হবে কী?

একজন নারীর পরিচয় তার শরীর দিয়ে বিচার কান করবেন? একজন নারীর পরিচয় কি তার স্তন কত সুন্দর? তার নিতম্ব কত সুন্দর? বা তার খোলামেলা ফিগার কত সুন্দর এর উপর ভিত্তি করে থাকে? নারী কি শুধু আপনার বিছানায় শোবার সঙ্গী? নাকি নারী শুধু আপনার কল্পনার জগতের বিবস্র উলঙ্গ এক শরীর? নারীর পরিচয় কি শুধু তার শরীর আর পোশাকেই সীমাবদ্ধ? নাকি নারীর ভেতরের স্বত্বাটাই তার পরিচয় আর অহংকার।