দীর্ঘ ৩ বছর টর্চার সহ্য করার পর এক প্রকার জোর জবরদস্তি করেই মুনিয়া শামীম (ছদ্মনাম) কে ডিভোর্স দিলো। প্রতিদিনের মার আর অকথ্য গালাগালি আর সইছিলো না তার। বাচ্চা পেটে নিয়েও মার থেকে রেহাই মিলেনি মুনিয়ার, পরিনাম মিসক্যারিজ। মুনিয়া-শামীমের ডিভোর্সের পর শুরু হলো আরেক ঝামেলা। উঠতে বসতে বড় ভাই ভাবী খোঁচা দেয়-ঃ কি আর দোষ বেটাছেলের, একটু আধটু মাইর খেলে কি ডিভোর্স দিতে হয় নাকি? বাসা থেকে বের হতেই প্রতিবেশীদের কানাঘুষো, কর্মস্থলে কলিগদের গসিপ। অফিসের বসও আজকাল কথায় কথায় মুনিয়ার শরীরে হাত দিতে দ্বিধা বোধ করেননা। ডিভোর্সি নারী মানেই তাকে যখন খুশি যেভাবে খুশি ছোঁয়া যায়, ডিভোর্সি নারীকে তো চাইলেই বিছানায় নেয়া যায়, তাই না?-অফিসের বস হাসতে হাসতে বলেন ম্যানেজার সাহেবকে।
ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ- এই শব্দটা শুনলেই একদল মানুষ গসিপ করতে বসে যায় স্ত্রীর চরিত্র ,বোলচাল আর স্বামী বেচারার অসহায়ত্বের দায়ভার নিয়ে। স্বামী স্ত্রীর ভিতর বনিবনা না হলে যে কোন পক্ষ ডিভোর্স দিতেই পারে, এর দায় ভার নারীর একার না। কিন্তু আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে সব দোষ টা এসে পরে নারীর ঘাড়ে।
বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স ধর্মীয় ও আইনগতভাবে পুরো পৃথিবীতে হয়ে আসছে। বাংলাদেশে কোন নারী তার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে চাইলে তাকে ডিভোর্সের পূর্বে, চলা কালীন সময় ও পরেও মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। পারিবারিকভাবে সহযোগিতা তো দুরের কথা।
ডিভোর্স কেন হয়?
যখন স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকার পরও তাদের মনের মিল হচ্ছেনা, তাদের একজন আরেকজনকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ,তাদের ভিতর ভুল বোঝাবুঝি বেড়েই চলছে কিংবা তাদের ভিতর তৃতীয় কোন পক্ষ প্রবেশ করেছে- এছাড়াও অগনিত অনেক কারনেই স্বামী স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ।
আর সব বিষয়ের মতো ডিভোর্সেরও অনেক নেগেটিভ ও পজেটিভ দিক আছে। আমি এমন অনেককেই চিনি যারা বিবাহিত জীবনে সাফার করছেন কিন্তু শুধুমাত্র লোকে কি বলবে, সমাজ কি ভাববে তার জন্য একই ছাদের নিচে বসবাস করে যাচ্ছেন।
আর এর পরিনাম হিসেবে চলছে পরকীয়া।
ডিভোর্সের কথা উঠলেই নারীকে বাধ্য করা হয় একটু মানিয়ে চলার জন্য। বিবাহিত জীবনে এমন হতেই পারে, তোমারই উচিত এগুলা ভুলে সব মানিয়ে নেয়া- এই ডায়লগ গুলোই নারীকে আত্মহত্যা এবং সংসারের উপর বিতৃষ্ণা উঠাতে যথেষ্ট। দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে কোন স্ত্রীই চায় না তার সাজানো সংসারটা ভাঙুক কিন্তু এই সমাজ নারীকে বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ডিভোর্স এর দায়ভার শুধুই যেন নারীর।
সমাজের বাস্তবতার কাছে একজন নারীর এই লড়াইয়ে টিকে থাকা কতোটা কঠিন একমাত্র সেই নারীই জানে। যেই নারী স্বপ্ন দেখেছিলো তার জীবনসঙ্গীর হাত ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে সেই নারী যখন বাধ্য হয় সে প্রেম, মমতাটুকুকে স্যাক্রেফাইস করার তার ভিতরের অনুভূতি তখন বোঝার বাইরে। ডিভোর্সের মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কিন্তু সে কখনোই একদিনে নেননি। ব্লেইমিং গেম খেলতে খেলতে পুরুষটা যখন আনন্দে ঠিক তখুনি নারীটি বাধ্য হয়েই ডিভোর্সের মত এত বড় সিধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
অনেকেই নিশ্চুপ হয়ে নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিয়ে সটকে পড়ে টক্সিক রিলেশনশিপ থেকে আবার অনেকেই প্রতিবাদ করে তার উপর ঘটা অত্যাচার এর বিবরণ নিয়ে। সমাজ তখন তালি বাজায় নারীকে অপদস্থ করার জন্য।
স্বামী পরকীয়া করেছে-দোষ স্ত্রীর, কারন স্বামীকে সে তা দিতে পারেনি যা অন্য নারী দিয়েছে!!!!!!
‘স্বামী মাদকাসক্ত -দোষ স্ত্রীর, কারন স্বামীকে সে পথে ফেরাতে পারেনি!!!!
স্বামী গায়ে হাত তোলে, মারধোর করে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে -দোষ স্ত্রীর, কারন সে স্বামীর অনুগত না !!!!
দোষটা সবসময়ই নারীর।
জন্মের পরই একটা নারীর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অধিকাংশ নারীকে দেখেছি যাদের স্কুল কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই বিয়ের পুথি পরতে বাধ্য হরা হয়। সংসার জীবনে নারীরা একের পর এক এডজাস্টমেন্ট, স্যাক্রেফাইজ আর কমিট্মেন্ট করে গেলেও তার জীবনসঙ্গী যখন এগুলোর ঊর্ধ্বে তখন নারীটি বাধ্য হয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে। কিন্তু হায়!! এই সমাজের কাছে তখন অপরাধী শুধুই নারী।
পুরুষতান্ত্রিক এই দেশে নারী যখন আত্মসম্মান নিয়ে বাচতে চায় তখন নারী বাধ্য হয় নিজেকে পরিবর্তন করতে। ডিভোর্সি নারী মানেই তাকে ছোঁয়া যায়, তাকে বিছানায় নেয়া সহজ-এই নোংরা কুরুচিপূর্ণ মনোভাব নিয়ে থাকা পুরুষেরা তখনই চপেটাঘাত পায় যখন নারী তাদের থেকে এগিয়ে যায় সকল ফিল্ডে।
মনে রাখবেন, একজন নারী ডিভোর্সি হোক কিংবা বিবাহিত তার আত্মসম্মান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হোক কিংবা সমাজ, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজের মনমতো জীবন যাপন করার সকল অধিকার আছে নারীর। যে সমাজ আজ বাধা দিচ্ছে কাল সেই সমাজই নতজানু হয় নারীর সেই শক্তিশালী মনোভাবের কাছে।