১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ নামক ছোট্ট দেশটি পৃথিবীর বুকে তার অস্তীত্ব জানান দেয়। ভ‚-রাজনৈতিক কারণে দেশটি মুসলিম প্রধান হলেও ১৯৭৪ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর শতকরা অনুপাত ছিল প্রায় ১৪.৬ শতাংশ, যা কালক্রমে ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী ৯.৬ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে স্বাধীন হওয়া দেশটি আজ তার ৯.৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষা, বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিতে যারপরনাই হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে বিগত তিন দশক সময়ের মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বাস্তব চিত্র যেকোন সাধারণ মানুষকেই ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করবে বলে আমার ধারণা। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় – ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অসংখ্য সংখ্যালঘু হত্যা, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জমি-দখল, মারধর এবং সংখ্যালঘু নারীদেরকে টার্গেট করে ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনার কথা ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে থাকে।
যদিও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, কিন্ত বিগত ২-৩ বছর যাবত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন-নীপিড়নের ভয়াবহতার নতুন মাত্রা যোগ হতে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এইসব হামলা-মামলা, জমিদখল এবং নির্যাতনের ঘটনায় যোগ দিচ্ছেন বলে খবর আসতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০২১ সালটি ছিল খুবই উৎকন্ঠার একটি বছর। বছরটি শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য তো বটেই, দেশের আপামর জনসাধারণের জন্যও ছিল চরম উদ্বেগজনক। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় – ২০২১ সালে বিচার-বর্হিভ‚ত হত্যাকান্ডের শিকার হন ৮০ জন, বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ক্রশ-ফায়ারে নিহত হন ৫১ জন, বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয় ৮ জনের, বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬ জন। এছাড়া একই বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ৭ টি, যাদের মধ্যে এখনো ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রে ২০২১ সালটি কোনভাবেই ভুলবার নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র র প্রকাশিত রির্পোট মোতাবেক – হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন (১৩ অক্টোবর ২০২১) বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার নানুয়াদীঘি পূজামন্ডপে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর পরই চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনি সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাংচুর, বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মারধরের ঘটনার খবর সামনে আসতে থাকে। এই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮৪ টি বাড়ি-ঘর ও ৫০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। যার ফলশ্রæতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন নিহত এবং ৩০০ এর বেশি আহত হয়েছেন। এছাড়াও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের সবচাইতে খারাপ নজির স্থাপিত হয় ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে। সেই রাতে বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীল পাড়ায় বাইরে থেকে ঘরে তালা লাগিয়ে গান-পাউডার ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে সে রাতেই শীল পরিবারের ১১ জন সদস্য নির্মমভাবে পুড়ে মারা যান। এ ঘটনার ২১ বছর অতিবাহিত হলেও বিমল শীল তার বাবা-মা সহ পরিবারের ১১ সদস্যের হত্যার বিচার আজোও পান নি। ২০১৯ সালের ২৩ জুন এই মামলার বিচার ৬ মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত, তার পরেও পেরিয়ে গেছে প্রায় ৫০ মাস; কিন্তু শেষ তো দুরের কথা, এই মামলার ৫০ জনের ও বেশি স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগ্রহণ এখনো শেষ হয়নি।
তেমনিভাবে একটু পিছন ফিরে তাকালেই দেখতে পাই ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রামু-র বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে, যার বিচার আজোও শেষ হয়নি। যদিও এই ঘটনায় মোট ১৯ টি মামলা হয়, এবং ১ টি মামলায় চার্জশীট হলেও সেটিরও কোন রায় আজোও আলোর মুখ দেখেনি। তদ্বরূপ, ২০১৪ সালের আদীবাসিদের হত্যা ও হামলা-মামলার কোন বিচার আমরা দেখতে পাইনি। এমনি ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাক্ষনবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলা মামলার তদন্তকাজ আজোও শেষ করতে পারেনি প্রশাসন। একইভাবে রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলাসহ দেশের আনাচে-কানাচে সংখ্যালঘুদের উপর অসংখ্য হামলার মামলায় তদন্তকাজ প্রশাসনের ফাইলে ই আটকে রয়েছে, যা আজোও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে কাজ করা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী – দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার হার ২৫-৩০ শতাংশ মাত্র। ঘটে যাওয়া বেশিরভার ঘটনায় মামলা করা যায়না কিংনা নিরাপত্তাজনিত কারণে মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থাকতে হয়। আর এসব মামলা থেকে বিচার পাওয়ার হার মাত্র ৫-৬ শতাংশ বলে পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয়, যা দেশটিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়।
পরিশেষে, বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশে বিচারের বাণী যে নিভৃতে কাঁদে তার অনেক উদাহরণ ই আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। আর সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের ক্ষেত্রে তো এই চিত্র আরোও ভয়াবহ – যা সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় বিচারহীনতার নিরিখেই প্রমানিত এবং সেটি মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের পুরোপুরীই বিপরীত অবস্থানে চিত্রিত।