পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাঃ মাজার ব্যবসা

আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তার ধারে লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো বাঁশের ছোট ঘর। সেখানে দুই, পাঁচ, দশ টাকার কিছু নোট দেখাযাচ্ছে। সন্ধ্যার পর সেই বাঁশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তা আটকে রেখে কয়েকজন লোক চাঁদা তুলছে। প্রাইভেট কার, পিক আপ ভ্যানএমনকি রিকশাও বাদ যাচ্ছে না।

জানা গেলো, এখানে খাজা বাবার নামে গানের অনুষ্ঠান হবে। তাই মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। যে যা দেয় তা দিয়েইঅনুষ্ঠান হবে। কিন্তু ব্যাপারটা “যে যাই দেয়”- তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছুটা যেনো জোর করেই তারা রিকশা, গাড়ি থামিয়ে টাকাচাচ্ছেন। ঘটনাটি বাসাবো কদমতলা ওয়াসারোডের।

যাত্রাবাড়ির পাশে মানিকনগরে কিছুদিন পর পর একদল ছেলে জোট বেঁধে এসে দোকানগুলো থেকে টাকা চায়। ওরস হবে, বড় পীরেরনামে মাহফিল হবে- এধরনের কথা বলে তারা টাকা দিতে বলে। সাথে নিয়ে সে ডেকচি বা ঝুড়ি যা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকে।

গোটা ঢাকার শহরেই বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মাজারের নামে ঝুলিয়ে রাখা দানবাক্স আপনার চোখে পড়বে। শহরের বিভিন্ন দেয়ালেইচোখ দিলে দেখা যাবে মাজারের ওরশ, দোয়া মাহফিল, সম্মেলনের পোষ্টার। এছাড়া, চলন্ত বাসে, রাস্তাঘাটে এমনকি বাসাবাড়িতেওঅনেক সময় মাজারের নাম করে টাকা চাইতে আসে একদল লোক। এরা কারা?

এতো কেবল মাজারের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা নেয়ার কিছু উদাহরণ। খোদ, পীর কিংবা বাবা সেজেই লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ারউদাহরণও বাংলাদেশে আছে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন নামে তথাকথিত বাবা আছেন যারা নিজেকে পীর দাবি করেন ও বিভিন্ন সমস্যাসমাধান দেয়ার নাম করে সাধারণ জনগণ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেন।

বরগুনার আমতলী শহরের মাজার রোডে এক কথিত ফকিরের কথাই বলি। হজরত ইসমাইল শাহ (রা.) এর মাজারে সে থাকতো। নামকালাম শিকদার (৪০)। সে নিজেকে ফকির দাবি করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিতো। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতি ছিলো উদ্ভট। যেরোগী তার কাছে আসতো সে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতো। এতেই নাকি রোগ সারে!  লোকজনের কাছে এই ভন্ড ফকির লাঠি বাবানামে পরিচিত ছিলো।

ভণ্ডামি করে মানুষকে ঠকিয়ে টাকা-পয়সাহাতিয়ে নেয় এরা

সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটার একজন ভন্ড বাবা ছিলো। সে ছিলো বড় মাপের ভন্ড। কারণ, সে দিতো বড় রোগের চিকিৎসা। যেখানেচিকিৎসকরা ক্যান্সার রোগ সারাতে হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে সে এই রোগের চিকিৎসা দেয়। কিভাবে? আয়না পরীক্ষা ও নদীর পানিখাওয়ানোর মাধ্যমে সে এই চিকিৎসা করে।  প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে ২৫শ থেকে ৩ হাজার  টাকা করে নিতো। ঔষধের নামে আয়নাপরীক্ষা, নদীর পানি ও সরিষার তেল বিক্রির জমজমাট ব্যবসা চালাতো। এইভাবে সে হাতিয়ে নিয়েছিলো লক্ষ লক্ষ টাকা।

‘একুশের চোখে’ অনুষ্ঠানে  ‘শিকল বাবা’ নামের এক প্রতারকের ঘটনা দেখানো হয়। যে স্বামী/স্ত্রী বশিকরণ, নারী-পুরুষের গোপনরোগ, কিডনি সমস্যা, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি, ক্যান্সার, প্যারালাইসিস সহ সকল রোগের সমাধান দিতো।  তার বাড়ির সামনের একটি গাছেতারই দেয়া সমস্যা সমাধানের তাবিজ বাঁধলেই নাকি সমস্যা দূর হয়ে যায়। এই শিকল বাবার বাসায় এক বিশাল হাড়ি আছে। যেখানেতার কাছে চিকিত্সা নিতে আসা লোকজন টাকা ফেলে যায়। প্রতারণা করে সেও বিপুল অংকের অর্থ সম্পদের মালিক হয়।

বিঁড়ি বাবা নামের আরেকজন ভন্ড আছেন। তিনিও চিকিৎসা দেন। তার চিকিৎসার মূল কাঁচামাল হচ্ছে “আবুল বিঁড়ি”। কুমিল্লার এইবিঁড়ি বাবার নাম আবদুল মালেক। তার দাবি আবুল বিঁড়িতেই সব রোগ ভালো হয়ে যায়। রোগীদেরকে তিনি বিঁড়ি খাওয়ান। জ্বিনতাড়ানোর নাম করেও অনেক কবিরাজ, ভন্ড পীর টাকা হাতিয়ে নেন। সাধারণ অসুখকেও তারা জীনের আছর বলে আখ্যা দিয়েভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। তবে কখনো কখনো তারচেয়েও ভয়ংকর কাজ তারা করেন। যেমন কামরাঙ্গীরচরের একটি ঘটনা।সেখানকার হুজুরপাড়া নামক এক এলাকায় ভন্ড কবিরাজ, যার নাম আলী আকবর, সে জ্বিন তাড়ানোর কবিরাজ হিসেবে নিজেকেপরিচয় দিতো। জ্বিন তাড়ানোর নামে সে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে নিজের কক্ষে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।

হজ বাবা নামের একজনের গল্প আরো চমকপ্রদ। মতি পীর নামে সে সে ভন্ডামি শুরু করে। প্রথমদিকে হারবাল চিকিৎসার আড়ালেবিভিন্ন যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার বা মোটা হওয়ার সিরাপ, খাবার বড়ি বিক্রি করতো সে। বন্ধ্যা নারীদের সন্তানহওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের আলাদাভাবে দেখতে তার আস্তানায় তৈরি করে “গ্রিন রুম”। এখানে সে নারীদের সাথেঅসামাজিক কাজ করতো চিকিৎসার নামে।  ধীরে ধীরে সে দোহারের লটাখোলা গ্রামে মাজার গড়ে তোলে। মানুষকে তার শিষ্যবানায়। এরপর ২০০৪ সালে হঠাৎ নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করে পীর মতিউর রহমান ওরফে মতি ডাক্তার!

তার উপর তখন হামলা হলেও সে বেঁচে যায়। আবার শুরু করে তার ভন্ডামি। ঢাকায় তার বেশ কয়েকটা বাড়ি। সে সবচেয়ে বেশিআলোচনায় আসে হজ নিয়ে ভন্ডামি করে। সে নিজের মাজারের ভিতর মক্কা শরীফের অনুকরণে কাবাঘর বানিয়ে হজ পালন করেখেতাব নেয় “হজ বাবা”! তার এই ঘরের চারিদিকে অনেকেই হজ এর পোশাক পড়ে প্রণামের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে সেই ঘর প্রদক্ষিণকরে। তারা নিজেদের হাজী বলে মনে করে থাকে।

মাজারে ধর্মের নামে কী হয়

মাজারের নাম ভাঙ্গিয়ে বাইরে টাকা খাওয়ার গল্প আপনি নিজের চোখেই দেখেছেন অনেকবার। ভন্ড পীরের কাহিনীও শুনলেন। এবার, পীরদের নামে যে মাজারগুলো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শহরে সেখানে কী হয় সেটার কিছু উদাহরণ না দিলেই নয়।

ঢাকার মোহাম্মদপুর বাশবাড়ি প্রধান সড়কের পাশে গায়েবি মাজার নামে একটা মাজার আছে। এই সমাধিটি আসলে কার সেটি নিয়েকৌতূহলের শেষ নেই। তবে, ১৬৮০ সালে নির্মিত বহু পুরানো এই মাজারটি মোঘলদের স্থাপত্যশৈলীর অনন্য উদাহরণ। প্রত্নতত্ত্বঅধিদপ্তরের আওতাভুক্ত হলেও এই মাজারে দুইটা দানবাক্স দেখা যায়। এই দানবাক্সের টাকা আসলে কে নেয় তা বলা মুশকিল।সন্ধ্যার পর এখানে মোমবাতি আর আগরবাত্তি জ্বলে। কিছু ভক্তের আনাগোনা হয়। স্থানীয় সূত্রমতে, মাজারের অধিকাংশ ভক্তইমুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি।

মিরপুর শাহ আলী মাজার। গভীর রাতে শত শত ভক্তের সমবেত আওয়াজে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। ভক্তরা বিশাল বিশাল পতাকাটাইপ কাপড়ের চারিদিকে ধরে শাহ আলীর নাম নিতে নিতে মাজারের দিকে এগিয়ে যান। গভীর রাতে অনেক নারী ভক্তও এই মাজারেআসেন। কেনো আসেন এতো রাতে তারা? কেউ দাবি করেন, মনের টানে আসেন, আধ্যাত্মিক কারণে আসেন। কেউ আসেন নিজেরপ্রয়োজনে। তারা বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণ করার মানত করতে এই দরবারে আসেন। বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে শাহ আলীর মাজারেআর্তি জানাতে আসেন।

ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্থানে আছে গোলাপ শাহ নামে এক ব্যক্তির মাজার। যদিও গোলাপ শাহ নামে কোনো পীর আউলিয়ারঅস্তিত্বের প্রমাণ মিলে না, তবুও মাজারকে ঘিরে ভক্তদের ভক্তি শ্রদ্ধার কমতি নেই। অনেকেই বলেন, এই মাজারে আসলে কারো কবরইনেই, শুধু ব্যবসা করার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাজারের আশে পাশে কিছু লোক ঘুরঘুর করে। কেউ টাকা দিতে আসলে তারাসেই টাকা নিয়ে নিজেদের পকেটে ঢুকায়। কেউ আগত ভক্তদের ফুঁ টু দিয়ে টাকা দাবি করে বসে। কেউ গোলাপজল ছিটিয়ে দোয়া করারনামে টাকা চায়। একটি সূত্র বলে, চারপাশে বাটপাররা লুটেপুটে নেওয়ার পরও মাজারের মূল অংশে বেশ ভালো পরিমাণ টাকাই জমাহয়।

জমা হওয়া টাকাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। টাকার ভাগ পায় প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও। এক ভাগ জমা হয় মাজারেরতহবিলে।

সিলেটের হজরত শাহজালাল মাজারকে কেন্দ্র করে বিশাল ব্যবসাজজ্ঞ রয়েছে। মাজারের উত্তরদিকের একটি পুকুরে বেশ কিছু গজারমাছ আছে। প্রচলিত আছে যে, দুষ্ট জ্বিনদেরকে হজরত শাহজালাল তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে গজার মাছ বানিয়ে দেন। মাছগুলোকেতাই ভক্তরা বিশেষ চোখে দেখে। ভক্তরা ছোট ছোট মাছ কিনে গজার মাছকে খাবার হিসেবে আধার দেয়। অনেকে বিশ্বাস করে মাছকেখাওয়ালে ব্যবসায় বাণিজ্যে উন্নতি হয়, বৈষয়িক শান্তি আসে। এই খাবার হিসেবে ব্যবহৃত ছোট মাছ বিক্রি হয় মাজারের পাশেই। মাছবিক্রির একটি সিন্ডিকেটও আছে সেখানে। মাজারের পশ্চিম দিকে আছে ঝরনা। এই ঝরনার পানিও বোতল হিসেবে বিক্রি হয়।

শাহজালাল মাজারের গজার মাছের খাবারনিয়েও আছে সিন্ডিকেট

পূর্বদিকে একতলা ঘরে আছে তিনটা ডেকচি। এখানে ভক্তরা মানতের টাকা ফেলে। মাজারের পবিত্রতা রক্ষায় জুতা খুলে যাওয়ারনিয়ম। এই জুতা জমা রাখার জন্যেও টাকা দিতে হয়। তবে, মাজারের পবিত্রতা নষ্ট করে নেশাগ্রস্থ কিছু লোক। তারা মাজার প্রাঙ্গণেগাঁজাসহ বিভিন্ন নেশা গ্রহণ করে।

চাঁদপুরের মতলবে বদরপুর গ্রামে অবস্থিত সোলেমান লেংটার মাজার। সোলেমান লেংটা কখনো পোশাক পরিধান করতেন না। তাইতার মাজারটি লেংটার মাজার হিসাবেই পরিচিত। প্রতিবছর এই লেংটার মাজারে ওরস হয়, সাথে মেলাও হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে চলেমাদক বিক্রি ও সেবন, জুয়া খেলা ও অশ্লীলতা। মাদক বিক্রি, আস্তানা ভাড়া, মাজারে দান-অনুদানের নামে হয় কোটি কোটি টাকারবানিজ্য।

মাজারে মানত হিসেবে আসে গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি। মাজারকে কেন্দ্র করে যে বিপুল টাকা উঠে সরকারসেখান থেকে এক টাকাও রাজস্ব পায় না, তবুও অবাধেই চলে এসব মাজারের ধর্মের নামে ধর্মবিরোধী এবং আইনবিরোধীকার্যকলাপ! সাধারণ মানুষও এই সব তথাকথিত মাজারে ঢলে পড়ে।

ব্যক্তিগতভাবে কিছু মাজারের দৃশ্য নিজে দেখেছি। সেখানে সাধারণ মানুষ মাজারে যেভাবে সেজদা করে তা দেখতেও কেমন গাঁ গুলিয়েউঠে। ইসলাম ধর্মে মাজারে সেজদা করাকে শিরক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া, মাজারে অন্ধ বিশ্বাসের জেরে যে বিপুল পরিমাণঅর্থ এবং গরু ছাগল মানত হিসেবে মানুষ দেয়, তারা কি জানে এই টাকা এবং দান কোথায় যায়?

অনেক মাজারেই গরু, ছাগল, এমনকি মাজারের উপরের দেয়া ভক্তদের ফুল তারা চলে গেলেই আবার বিক্রি করে দেয়া হয় বাইরেরদোকানদারের কাছে। সেই দোকান থেকেই নতুন ভক্ত আবার ফুল কিনে মাজারে দেয়। এভাবেই বাণিজ্য চলে। মাজারের সবচেয়ে বাজেদৃশ্য হচ্ছে, এখানে অনেকে আধ্যাত্মিক ভাব নেয়ার ভং ধরে গাঁজা সেবন করে ঢুলু ঢুলু হয়ে পড়ে থাকে। বিভিন্ন মাজারের সামনে গেলেগাঁজার উৎকট গন্ধে চারদিক ভরে থাকে। সাধারণ মানুষেরা পীর ফকিরদের পা ছুঁয়ে চুমু খায়। মাজারের সমাধিতে টাকা ছিটায়, মোমবাতি জ্বালায়। এই কাজগুলোর ধর্মীয় কিংবা সামাজিক অথবা বৈজ্ঞানিক কোনো বৈধতা নেই। মানুষের অন্ধ ভক্তি ও শিক্ষাসচেতনতা না থাকার ফলেই এক শ্রেণীর প্রতারক, ভন্ড তাদের বোকা বানাচ্ছে। স্বেচ্ছায় বোকা হওয়ার এমন নজির খুব কম দেশেই

 #সংগৃহীত