একজন এলজিবিটি রাইটস একটিভিস্ট হবার কারণে আমি অনেক মানুষের সাথে সুযোগ পেলেই কথা বলি। অনেকের সাথে অনলাইনে পরিচয় হয়। বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং ব্লগেও নিয়মিত লেখালেখি করে থাকি আমি। অনেকের কাছ থেকে উৎসাহ পাই কিন্তু আমার দেশ বাংলাদেশের মানুষদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী অবহেলা ও গালাগালি শুনতে হয়। কারণ এই সমাজ এখনো আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে না। তার একমাত্র কারণ ধর্ম ও অজ্ঞতা।
কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম। সকলের উত্তরের এক সারমর্ম দিচ্ছি। প্রশ্ন ছিল-
সমকামী মানুষদের কি বিয়ে করা উচিৎ?
প্রেম-ভালোবাসা সমলৈঙ্গিক মানুষের প্রতি ঋণাত্মক হতে পারেনা; আমাদের বাংলাদেশের সমাজে যারা সমপ্রেমী অর্থাৎ সমলিঙ্গের মানুষের সঙ্গে প্রেম করেন তারা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখেন এবং তাদের প্রেমটাকেও তারা বন্ধুত্ব হিসেবে সমাজের সামনে প্রকাশ করেন।
একজন সমপ্রেমী (সমকামীদেরকে সমপ্রেমী বলাটাই শ্রেয়, কারণ সমকামী একটু অশ্লীল শোনায় আমাদের সমাজে) ব্যক্তির বিয়ে তো বাংলাদেশের আইন/সমাজ দ্বারা স্বীকৃত নয় যে সে তার পছন্দের মানুষ (অন্য একজন সমলিঙ্গের মানুষ) কে বিয়ে করতে পারবে, এটা সম্ভব নয়, কারণ বাংলাদেশে বিয়ে বলতে শুধু বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষেরটাই পরিচিত এবং স্বীকৃত। সমপ্রেমীর বিয়ে করা তখনই উচিৎ যদি তার কোনো ভালোবাসার মানুষ না থেকে থাকে এবং যদি সে উভপ্রেমী মানুষ হয় আর যদি তার ভালোবাসার মানুষ থাকে তাহলে তার বিয়ে করা উচিৎ আমি যদি বলি তাহলে তো হবেনা এটা দেশের আইন এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষ তো সমর্থন জানাবেনা তাই বিয়ে করাটা উচিৎ বলে মনে হয়না, এমনি আপনারা মেসে থাকতে পারেন বা আজীবন অবিবাহিত হিসেবে স্ব স্ব পরিবারের সঙ্গে থেকে বন্ধু হিসেবে বিকেলে বাইরে আড্ডা দিন। আপনি নারী সমপ্রেমী হন আর পুরুষ সমপ্রেমী হন বিয়ে আপনাদের দ্বারা সম্ভব নয়।
কথা বলেছিলাম অদিতি কোলের সাথে উনি টেক্সাস সাদার্ন ইউনিভার্সিটির পিএইচ.ডি.(মনোবিদ্যা), ডিগ্রিধারী। ওনাকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম যেমন একজন লেসবিয়ান হয়ে আপানার জীবন সুখের না বিষাদময়? উনি আমার এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলেছিলেন জানেন?
সমকামী হিসাবে আমার জীবন তুল্যমূল্য একজন বিষমকামী নারীর থেকে বেশি বই কম সুখী নয়।আমি গত দশ বছর সমকামী। জীবনের প্রথম চব্বিশ বছর আমি নিজের যৌন প্রবণতা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম। স্কুলে পড়ার সময়কার খুচরো প্রেম অথবা আর একটু বড় হয়ে সিরিয়াস শারীরিক সম্পর্ক – সব ব্যাপারেই আমার সঙ্গী ছিল কোনও না কোনও পুরুষমানুষ। এমনকি আমেরিকায় পড়তে আসার আগে আমার দীর্ঘদিনের প্রেমিকের সঙ্গে আমার পারিবারিক এনগেজমেন্টও সেরে এসেছিলাম।
আমেরিকায় আসার কয়েক মাস পরে আমি প্রথম সমকামী যৌনতার স্বাদ পাই। চার মাস পরে বাড়ির সকলের অমতে আমি টেলিফোনে আমাদের এনগেজমেন্ট ভেঙে দিই। এর অল্প কিছুদিন পরে আমি আমার সঙ্গিনীকে বিয়ে করি। আমাকে সে যে মুক্তযৌনতার স্বাদ দিয়েছিল, তার কৃতজ্ঞতা জানাতেই বিবাহবিচ্ছেদের আট বছর পরেও আমি তার পদবী বহন করে চলেছি এবং আমৃত্যু চলব।
সমকামী হিসেবে জীবনে সুখের সন্ধান পেয়েছি বলেই মা-বাবাকে আশাহত করতে, পরিবারকে ছেড়ে আসতে, দীর্ঘদিনের ভালোবাসার পুরুষমানুষটিকে ত্যাগ করতে, এমনকি দেশে ফেরার সম্ভাবনা ভুলে যেতে দ্বিধা করিনি। আজ দশ বছর সমকামী জীবনের আনন্দে আমি মুগ্ধ হয়ে আছি। বিষমকামী জীবনে (আমি ওটাকে জীবন বলি না, বলি আমার যৌনবিকৃতি) আমি অন্তরঙ্গ সম্পর্কে ছিলাম এবং দৈহিক মিলনের স্বাদও যে অজানা ছিল তা নয়। তবুও, সমকামী জীবনেই আমি অভূতপূর্ব সুখ পেয়েছি এবং সমকামী হয়ে যে আনন্দময় জীবন কাটাতে পারছি, আমার দুই সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে বড় করতে পারছি – সেজন্য ভাগ্যকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।
কিন্তু যারা আমাদের সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল তাদের কেউ কেউ আবার নিরবে সমর্থন দিলেও সমাজ ও আইনের কথা ভেবে পিছিয়ে যায়। এরকম কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম-
আমি একজন ছেলে। কিন্তু আমার ছেলে বন্ধুদের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ ও দুর্বলতা আছে। এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত?
আপনার বন্ধুরা যদি বিষমকামী হয় (যার সম্ভাবনা ৯০%) তাহলে অবশ্যই আপনার মনোভাব প্রকাশ করা উচিত হবে না। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি অল্প বয়স্ক এবং এখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। নিজের সমকামী প্রবৃত্তি প্রকাশ করা আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আমি এও বলতে চাই যে এই প্রবৃত্তির কারণে আপনি যেন অপরাধবোধ না করেন। সমকামিতা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং গ্রহণযোগ্য। আমাদের সমাজ বাকি বিশ্বের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে বলেই সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত গালাগালি শুনি। আমার পরিবারের সকলে আমার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। আমার মা আমার সঙ্গে কথাও বলেন না। বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে অনেক মাড় খেতে হয়েছিলো। আমার জন্মদাতা পিতা- মাতা আমাকে অমানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমাকে মেরেছে। আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমার জন্য যেন ওনারা আর অপমানিত না হন তাই আমাকে পরিবার থেকেই আলাদা করে দিয়েছেন। পরিবারে ফেরার পথটাও চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন।