ধর্ষণে পোশাক দায়ী না

লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক সৌদি থেকে ফিরে নিজ নিজ দেশে যেয়ে জানিয়েছেন তাদের বীভৎস সব অভিজ্ঞতার কথা। প্রতিদিন তারা ধর্ষিত হয়েছেন গৃহকর্তার কাছে, বারংবার, বাবা-ছেলে একসাথে ধর্ষণ করেছে, বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করেছে, শারিরীক মানসিক নির্যাতন করেছে, এসবে সেইসব পরিবারের মেয়ারাও কোন বাঁধা দেয় নি। বাংলাদেশের সৌদি ফেরত সহস্র নারী তাদের আহাজারি তুলে ধরেছে গণমাধ্যমে, সকল মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় আমরা এসব খবর দেখেছি। যারা ফিরে আসতে পেরেছে তারা জানিয়েছে যারা ফিরে আসতে পারে নি তারা আছে জলজ্যান্ত নরকে। তারা বাঁচতে চায়, কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ চায়। তারপরেও দেখা যাচ্ছে পরিসংখ্যান বলছে সৌদিতে ধর্ষণ নাই। পরিসংখ্যান আরও বলছে বাংলাদেশেও কোন ধর্ষণ। অন্যদিকে আমরা সবাই জানি পশ্চিমা বিশ্ব অনেক উন্নত এবং নিরাপদ অথচ তাদের পরিসংখ্যান দেখলে মনে হয় তারা ধর্ষণ ছাড়া আর কিছুই করে না।

আমেরিকার পরিসংখ্যানে আস্থা রাখা যায় কারণ আমেরিকার নারী স্বাধীন, সক্ষম, আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিচার গ্রহণ এবং সুবিচার প্রদানে পরাঙ্গম, আমেরিকায় তাই একজন যৌনকর্মীর সাথেও কেউ জোর খাটালে তার রেকর্ড থাকে, যৌনকর্মীও বিচার পায়, একজন স্ত্রীও স্বামীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ নিয়ে আদালতে যেতে এবং বিচার পেতে পারে। আমেরিকার পরিসংখ্যান তাই বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে, এর উপর কাজ করে, ধর্ষণ কমাতে কার্যকরী উদ্যোগ নেবার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে।

অন্যদিকে সৌদি আরবে একজন মৃত্যুশয্যায় শায়িত নারীও একা হাসপাতালেও যেতে পারবে না স্বামী বা পরিবারের কর্তার অনুমতি ছাড়া, শরীয়া পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে শাস্তির মুখোমুখি করবে তা তার অবস্থা জতই খারা হোক না কেন , তার প্রসব বেদনা উঠুক বা গলা কেটে চৌচির হয়ে যাক, কিচ্ছু আসে যায় না। তাই ধর্ষিত হোক আর যাই হোক বিচার দেবার ই সুযোগ নাই, পরিসংখ্যান আসবে কোথা থেকে! তারপরেও কোনমতে বিচার পৌঁছাতে পারলে ধর্ষণ প্রমাণের জন্য শরীয়া আইন অনুযায়ী লাগবে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য, কোথায় পাবে একজন ধর্ষিতা চারজন সাক্ষী? যদি পেয়েও যায় তাহলেও সাক্ষীদের মহা সমস্যা, তারা দেখেও কেন প্রতিবাদ করল না আর তারা দৃষ্টি সংযত না রেখে দেখল কেন এই অভিযোগে তারাও অভিযুক্ত হবে বা হতে পারে। তো কে দেবে সাক্ষী মার খাবার জন্য? যেহেতু সাক্ষী নাই সেহেতু অপরাধের তীর এবার ধর্ষিতার ঘাড়েই, তারপর দোররা, পাথর বর্ষণ ইত্যাদি। আর পরিসংখ্যান বলে বেড়াবে সৌদি ধর্ষণ মুক্ত অথচ কেবল ইউটিউব ঘাটলেই সৌদিতে যৌন নিপীড়নের অজস্র ভিডিও পাবেন।

বাংলাদেশ, ভারতের একই রকম চিত্র। পুলিশ মামলা নেয় না, মামলা নিলেও বিচার হয় না। আর ধর্ষিতা মানেই এই অঞ্চলে অপরাধী, বেশ্যা, মাগী তাই বিচার নিয়েও কেউ যেতেও চায় না, মুখ খুলতে চায় না। ফলে পরিসংখ্যান দেখায় বাংলাদেশে ধর্ষণ শূন্য, ভারতে কতিপয়।

সুতরাং, আমরা দেখতে পারি ধর্ষণের দোষ যদি নারীর ঘাড়ে চাপানো যায়, নারীকে যদি বস্তাবন্দী করা যায়, নারীকে যদি ঘরে আটকানো যায় তাহলে নারীর স্বাধীনতা চুড়ান্তরূপে লোপ পায় এবং ধর্ষকের জন্য অবাধ ধর্ষণের অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয় কারণ নারী বিচার দেবার এবং বিচার পাবার সক্ষমতা হারায়। নারী হয়ে পরে হাতের পুতুল। এই পরিস্থিতিতে যারা পোষাক নিয়ে ফতোয়া দেয় তাদের উদ্দেশ্যটা বোঝা মুশকিল কিছু নয়। তারা চায় ধর্ষণের অধিকার এবং ধর্ষণ করে পার পাবার অবাধ সুবিধা। বোরকা হিজাব ছাড়া নারী দেখলেই যদি ধর্ষণের আকাঙ্খা সৃষ্টি হত তাহলে প্রতিটি বিবাহিত পুরুষ হত ধর্ষক, রাতে স্ত্রীর দেহ দেখে তারা দিনে কর্মক্ষেত্রে যেয়ে ধর্ষণ করত, উপাসনালয়ে যেয়ে ধর্ষণ করত, সংসদে যেয়ে ধর্ষণ করত, রাস্তায় ধর্ষণ করত, বাসে ধর্ষণ করত অর্থাৎ সুযোগ পেলেই ধর্ষণ করত। টিভি পর্দায় তিন মিনিটের আইটেম সং ধর্ষণের উস্কানী হয় তাহলে বাস্তবের ৩ মিনিটের স্ত্রী সঙ্গে একজন মানুষ মানুষ কত বড় ধর্ষক করে তুলত ভাবতে পারেন? কিন্তু এমন হচ্ছে না কারণ ধর্ষণের জন্য পোষাক দায়ী নয়, নারীর চমড়া দায়ী নয়, ধর্ষকের মানসিকতা দায়ী, বিচারহীনতা দায়ী। শরীর জেগে উঠলেই ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ হয় যখন বিবেক মরে যায়।