এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কথা প্রাচীন ইতিহাসও অস্বীকার করেনি

আমাদের সম্প্রদায়ের যারা বর্তমানে আমাদের অধিকার নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছি আমরা যুগে যুগে অবহেলিত হলেও প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এবং ইতিহাসে আমাদের সম্পর্কে মানুষ নানা কথা বলে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ে মানুষ বিষদ ভাবে আলোচনা করেছে। কালে ভদ্রে সেগুলোকে আমরা আমাদের বর্তমান সভ্যতা থেকে বাদ দিলেও ইতিহাস কিন্তু আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না বরং আমাদেরকে জীবনকেও সাধারণ জীবনযাত্রার মানদণ্ডে ফেলেই আমাদেরকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ।

আমি সাহত্যের ছাত্র নই। আর তাছাড়া যৌন প্রবৃত্তি হল সৃষ্টিশীলতা, চিন্তন ও মননের এক অন্যভূবন। এখানে নানা স্রোতের খেলা প্রতিনিয়তই চলে। চলে নানা টানাপোড়েন। অনেক সময়ই প্রবৃত্তিকে ঘিরে বিভিন্ন সমাজে গড়ে উঠে নানা সংস্কার। সবগুলোই হয়ত বৈজ্ঞানিক নয়, কিংবা এর পেছনে যুক্তিনিষ্ঠ কারণ পাওয়া যায় না।

গ্রীসের ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ কথায় সমকাম স্পৃহার কথা জানা যায়। ধর্মীয়ভাবে সমপ্রেম এখানে স্বীকৃত ছিল। ‘ভেনাস’ ছিলেন তাদের কামনার দেবী। এই দেবীই আবার সমকামীদের উপাস্য ছিলেন। এছাড়া ‘প্রিয়াপ্রাস’ নামেও আরেক দেবীকেও সমকামীরা আরাধনা করত বলে শুনেছি। তাহাতির বিভিন্ন জায়গায় সমকামে আসক্ত ব্যক্তিদের আরাধ্য দেবতার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। আনাতেলিয়া, গ্রীস এবং রোমার বিভিন্ন মন্দিরে ‘সিবিলি’ এবং ‘ডাইওনীসস’ এর পুজো ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল। সিবিলির পুরোহিতেরা গাল্লি নামে পরিচিত ছিলেন। এরা নারীবেশ ধারণ করতেন। মাথায় নারীর মত দীর্ঘ কেশ রাখতে পছন্দ করতেন। এরা সমকামী ছিলেন বলেও অনুমিত হয়। আসলে পরে এশিয়া মাইনর থেকে সিবিলি পুজো পারস্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে এ সমস্ত প্রথা প্ররথিবীর বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়।

পারস্য সাহিত্যে অনেক কবি তাদের প্রেমিকাকে পুরুষ নামে ডাকতেন – এটাও হয়ত অঞ্চল ভিত্তিক কোন প্রথা। যেমন , আরব সমাজে বয়ষ্ক পুরুষ এবং বালকের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গ্রহনযোগ্য তো বটেই মধ্যযুগে (ইসলামের বিস্তৃতির সময়) বহুল প্রচলিতও ছিল। এমনকি কোরানের একটি আয়াতে (Qur’an 52:24; 56:17; 76:19) বেহেস্তে ধার্মিকদের জন্য উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীর পাশাপাশি কিশোর বালকের লোভ দেখানো হয়েছে।

তাহলে শুধুমাত্র নারী হুরদের কথা বর্তমান ইসলাম বিশেষজ্ঞরা কেন বলে থাকেন? বেহেস্তে এই যে কিশোর বালকের কথা বলে লোভ দেখানো হয়েছে সেগুলো কেন উল্লেখ করেন না? কারণ ধর্মকে তারা তাদের সুবিধা মতো কাটা ছেঁড়া করে সমাজের মাঝে প্রকাশ করছেন। এখানে যদি তাদের প্রচলিত মতকে গুরুত্ব দেয়া না হয় অথবা কোরানের এসকল অধ্যায় গুলোকে সামনে আনা হয় তাহলে তারা মনে করেন ধর্ম দিয়ে তারা আর মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারবেন না এবং তার কারণেই তারা ক্ষমতা হারাবেন। ক্ষমতার লোভ বড় ভয়ঙ্কর লোভ। ক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের মতো মানুষদের মেরে ফেললেও সেটা জায়েজ।

আসলে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই সমকামিতা সবসময়ই মানব সমাজে ছিল। গ্রীক, রোমান, চৈনিক, পাপুয়া নিউ গিনি অথবা উত্তর আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় সমকামীতার ভুরি ভুরি উদাহরন আছে। সমকামিতা ছিল অ্যাস্টেক ও মায়া সভ্যতায়। হিন্দু পুরানেও এরকম বেশ উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন পুরুষীনি অথবা তৃতীয় প্রকৃতি। বর্তমানে গুজরাটের সঙ্খলপুরে বহুচোরা মাতার যে মূর্তি আছে তা অনেকটা ‘সিবিলির’ আদলে রচিত। ভারতবর্ষে বৈষ্ণব ধর্মের একটি বিশেষ শাখা আছে। এরা একসাথে রাধা-কৃষ্ণ-এর ভজনা করে থাকে। এদের অনেকে স্ত্রীবেশ ধারন করে। এই সম্প্রদায়ের অন্যতম সাধক গদাধর গোস্বামী নাম নিয়েছিলেন রাধিকা। আবার গোবিন্দঘোষ রঙ্গদেবী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা ইত্যাদি আধুনিক পশ্চিমাদের আবিষ্কার নয়, বরং এটি প্রাচীন সভ্যতা থেকে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই আছে, পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ইন্টারনেটের কারণে জিনিসটা সামনে চলে এসেছে ।

কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ এই ১৪০০ বছরের আগেকার কাটা ছেঁড়া ধর্মকে দিয়েই সমাজ পরিচালনা করে থাকে। তাই এখানে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে এরা মানুষের কাটারেই ভেলতে চান না। এরা মনে করেন এরা মানসিক ভাবে বিকার গ্রস্থ এবং এদের সমাজে প্রকাশ্যে জীবন যাপন করতে দিলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। ইসলামকে বাদ দিয়ে আর কোন ধর্মই রাজত্ব করতে পারবে  না। আমাদের মতো নাস্তিক আর এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের জায়গা তাই বাংলাদেশে হয় না।