সমকামীদের মানুষ ভাবো, ৩৭৭ ধারা বাতিল করো

বহুজাতিক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি ইপসোস গ্রুপ (IPSOS Group)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষ এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের। এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা ১০ হাজারের একটু বেশি, সমকামী এবং উভকামীদের সংখ্যার কোন হিসাব পাওয়া যায় নি। কিন্তু আমরা যদি ইপসোসের রিসার্চটি বাংলাদেশের জন্যেও গ্রহণযোগ্য ধরে নেই তবে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি তাদের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? মানবাধিকারের বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ কতটুকু পিছিয়ে আছে?

বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ছোট কমিউনিটি লেভেলে কিছু কিছু কাজ হয় শহরগুলোতে কিন্তু পলিসি লেভেলে সেভাবে কোন কাজ হচ্ছে না”। উপরন্তু, সমকামীতা এখনও বাংলাদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন পুরুষ,নারী বা জন্তুর সহিত,প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে–যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ যৌন সহবাসের সর্বজনীন স্বীকৃত সংজ্ঞা এখনো নির্ণীত হয়নি। এই ৩৭৭ ধারা বাতিলের জন্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে ইউ পি আর চলাকালীন সময়ে দাবি তোলা হয়েছে, যা সরকার পক্ষ থেকে বারবার নাকচ করে দেওাা হয়েছে। কিন্তু ধারাটি বাতিল হলেও সামগ্রিকভাবে সামাজিক সচেতনতা তৈরি না হলে কোন কাজের কাজ হবে না বলে মনে করেন অয়ন। পৃথিবীর অনেক দেশেই (যেমন সাউথ আফ্রিকা) ধারাটি বাতিল হলেও দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন আসেনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে। অয়নের মতে, “এই সম্প্রদায়ের মানুষের মুখ্য প্রয়োজন একটি ভালো চাকরি, বাসা থেকে বের করে দিলে একটি থাকার জায়গা, মর্যাদাপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদে মন খুলে কথা বলার মতো এক বা একাধিক সেইফ স্পেইস, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারার স্বাধীনতা ইত্যাদি। ৩৭৭ ধারা বাতিলের পাশাপাশি এই জিনিসগুলে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে”।

এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির বিভিন্ন সংস্থার সংগঠক, কর্মী ও সদস্যরা মনে করেন মূলত পাঁচটি বিষয় নিয়ে কাজ হতে পারে- স্বাস্থ্য, আইন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়গুলোর নিজেদের মধ্যে সমন্বয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধি, মাধ্যমিক পর্যায়ে যৌন শিক্ষা পাঠ্য-পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং চরমপন্থীদের চাপের মুখে তা অপসারণ না করা, সরকারী নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা, মন খুলে কথা বলার জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করা যেখানে নানা ধরণের আলোচনা, বিতর্ক, অনুষ্ঠান, নাটক ইত্যাদি আয়োজন করা সম্ভব, বিভাগীয় শহরগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক নিয়োগ করা ও সমকামী বান্ধব সব ধরণৈর স্বাস্থ্যসেবা।

সামনে নির্বাচন। নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার মনোনয়নপত্রে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ে সংশোধন এনে ‘পুরুষ’ ও ‘মহিলা’র পাশাপাশি ‘হিজড়া’ যুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘হিজড়া’ পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন হিজড়া পরিচয়ের নাগরিকরা। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ২৩ ফেব্রুয়ারি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এর ক্ষমতাবলে বিধিমালায় এই সংশোধন এনেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় এখনো এই সংশোধনীটি আসে নি।

এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানবাধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা মনে করেন, বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে এবং চরমপন্থী মুসলমান জনগোষ্ঠীর কারণে আরও দুঃসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ হবে এই সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিনিয়তই বৈষম্য, হয়রানি এবং সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ থাকে মুখ ফিরিয়ে।