নারীবাদ কোন নেতিবাচক শব্দ নয়

নেকে নারীবাদ শব্দটাকে নেতিবাচক হিসাবে ধরে নেন এর সাথে তসলিমা নাসরিনের সম্পৃক্ততার কারণে। তসলিমা নাসরিন নিজেকে নারীবাদী হিসাবে পরিচয় দেন—এর ফলে অনেকে মনে করে তসলিমা নাসরিন যেমন ‘খারাপ’ তেমনি আর সব নারীবাদীরাও খারাপ। এই ‘মনে করা’র পেছনে কারণটা কী হতে পারে?

রাইটার তসলিমা নাসরিন আশির দশকে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। অন্তত উনার বিরুদ্ধে তখন কারো কোনো অভিযোগ ছিল—এমন দেখা যায় নি। তার জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রমাণ কারণ মনে করি ‘নির্বাচিত কলাম’। ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি লেখালেখি এই কলামেই করেছেন, এবং সেটা সেই আশির দশকেই। অথচ তেমন কোনো প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায় নি সাধারণ আস্তিক সমাজ থেকে।

এর পর আসে ‘লজ্জা’ উপন্যাস—মূলত বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তারই ‘নিউজ কাটিং’ এই উপন্যাস। ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল জামাত-শিবিরের লোকেরা—হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার। জামাত-শিবির তখন সরকার পক্ষের অংশ। স্বাভাবিক প্রশাসনসহ সব ক্ষমতা তাদের পক্ষে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্ম থেকে আসা লীগ-বামদল করা লোকজনও চুপ ছিল—হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে এদের প্রত্যক্ষ সায় না থাকলে মনে মনে খুশি হয়। তবুও সেই লজ্জা উপন্যাস নিয়ে সাধারণ মহলে তেমন কোনো বক্তব্য ছিল না। কিন্তু বিষয়টা যেহেতু জামাত-শিবিরের বিপক্ষে যায়, তাই তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এটাকে ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসাবে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরে রাজনৈতিক চালের মাধ্যমে। তারা সেখানে সফল হয়। তারপর তসলিমা নাসরিনকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় ৯০-এর দশকের শুরুর দিকে।

তারপর থেকেই তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে দেশে এক ধরনের অপপ্রচার শুরু হয়েছে। তিনি যা বলেন নাই, তা তার মুখে বসানো হয়েছে। তিনি যা লেখেন না তা তার নামে বিভিন্ন মাধ্যমে বের করে প্রচার করা হয়েছে। ফুটপাতে এমন অনেক বই পাওয়া যায় যা তিনি লেখেন নাই, অথচ তার নামে সেগুলো ছাড়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না, দু-চারজন করলেও সেগুলো পাত্তা পায় নি। বিএনপি পরে লীগের শাসনামলে উনার পাসপোর্ট রিনিউ করতে দেয়া হয় নি। অন্য দেশের পাসপোর্ট দেশে ঢোকার পারমিশন দেয়া হয় নি। একটা সময় দেশের কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে কোলকাতা এসে ছিলেন। সেখান থেকেও ২০০৭ সালের দিকে বিতাড়িত করা হয়।

তো এই দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময়ে দেশে একটা জেনারেশন আসছে। তারা জন্ম থেকেই তসলিমার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা শুনে আসছে। এই সময়ে যারা স্কুল-কলেজে পড়েছেন তারাও তার লেখালেখির সাথে খুব একটা পরিচিত হতে পারেন নি। তারা শুধু উনার ব্যক্তিগত জীবনাচার—বিশেষ করে সেএণ্ডক্সুয়াল লাইফ সম্পর্কে। দেশের সমাজব্যবস্থা এমনিতেই যৌনতা নিয়ে নানান সংস্কার-কুসংস্কারে ভরা। এরপর আবার দিন দিন ধর্মীয় বিধিবিধান বেড়েই চলেছে। মেয়েদের একাধিক যৌন সম্পর্ক, একাধিক বিয়ে—এসব শুনে ছিঃ ছিঃ করা সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো যখন তসলিমা নাসরিনের শুধু এই দিকটাই শোনে—তখন এমনিতেই তাকে অপছন্দের খাতায় ফেলে দেবে—এটা বলাই বাহুল্য। অনেক নাস্তিক-মুক্তমনা-সেক্যুলাররাও মেয়েদের একাধিন যৌনসম্পর্কের কথা সহজ ভাবে নিতে পারে না। তারপর যখন তসলিমা নাসরিন কিছু প্রতিষ্ঠিত পুরুষের ভিতরের খবর ফাঁস করলেন, সেগুলো নিয়েও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। এছাড়া তার একাধিক বিয়ে—ডিভোর্স—এগুলোও ওই পুরুষদের যারা ভালো পেতেন, তারা ভালোভাবে নেন নি। যেমন কোনো ছেলের যখন কোনো মেয়ের সাথে সমস্যা হয়, তখন ছেলের বন্ধুরা সাধারণত ছেলেটার পক্ষেই থাকে, মেয়েটাকেই দোষ দেয়। এক পুরানো ব্লগারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কেন তসলিমা নাসরিনকে পছন্দ করেন না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন—ব্যক্তিগত কারণে। কারণটা খুলে বলেন নি। তবে এটা ঠিক যে উনার লেখালেখি বা আদর্শের বাইরেও অনেকে উনাকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণে অপছন্দ করতে পারেন। এবং সেই অপছন্দটা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তারা ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেমন দেখেছি, ওই ব্লগারকে যারা পছন্দ করেন বা তার কাছের মানুষগুলোও তসলিমা নাসরিনকে অপছন্দ করেন।

যারা নারীবাদ বা নারীবাদী শব্দ দুইটি বোঝেন না, তাদেরকে অনুরোধ করব—তসলিমা নাসরিন হতে শত হাত দূরে থাকেন, সমস্যা নাই, কিন্তু অন্তত আপনাদের প্রিয় রোকেয়া রচনাবলী আর হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থটি পড়ে নেবেন। যদিও নারীবাদ কোনো ধর্ম নয় যে এর কোনো নির্দিষ্ট ‘ধর্মগ্রন্থ’ থাকতে হবে, তবুও বোঝার সুবিধার্থে এ দুটি গ্রন্থ আপনাদের কাছে সহজলভ্য হবে এবং সহজ-সরল বাংলা ভাষায় পড়ে নিতে পারবেন।

আর নারীবাদ যেহেতু কোনো ধর্ম নয়, বা নারীবাদীরা নির্দিষ্ট কোনো ‘গ্রন্থ’ মেনে এর পক্ষে কথা বলেন না, তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক কথাবার্তা বা মতামতের জন্য পুরো নারীবাদ বিষয়টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা বোকামী, যদিও জানি এটা আপনারা বোকামী থেকে করেন না, করেন চতুরতা থেকে—তর্কে জেতার সুবিধার্থে, নিজের দল ভারী করতে, নিজের স্বার্থ আর লোভ আড়াল করতে। এই স্বার্থ আর লোভের আবরণটা যতদিন না উপড়ে ফেলছেন, ততদিন কেউ আপনাকে নারীবাদ বা সাম্যবাদ বোঝাতে সক্ষম হবে না।