১৪০০ বছরের ধর্মের পরিবর্তনটা জরুরি

অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ভেদাভেদ–এসব ব্যক্তিগত বাধাগুলো অতিক্রম করতে না পারলে মুক্ত মনে চিন্তা-চেতনার উন্মেষই ঘটবে না।

২য় ধাপে সংসার-পরিবারের বন্ধন, ভালোবাসা-মায়া-মমতার মোহ, বিষয়-সম্পত্তির লোভ, ভোগ-বিলাস আর বংশরক্ষা করে ভবিষ্যত প্রজন্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকার স্বার্থ…

তারপরে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ভাঙতে গেলে সমাজ-লোকনিন্দার ভয়, অসামাজিক বা সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়ার লজ্জা, একা হয়ে যাওয়ার অসহায়ত্বতা…

সবশেষে রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর ভয়।

ব্যক্তিগত খোলস থেকে বের হয়ে পরিবারের পিছুটান ঝেড়ে ফেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, অহেতুক নিয়ম-নীতি ভেঙে চুরমার করে, আত্মত্যাগের সৎসাহস যতদিন না আসছে, ততদিন সার্বিক পরিবর্তনের আশা করা বোকামী। বিপ্লব অন্যরা এসে করে দেবে, অন্য কেউ পরিবর্তন এনে দেবে–এটা ভাবতে ভাবতেই কয়েক প্রজন্ম কেটে গেছে, কেটে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম…

সবাই মিলে মিলেমিশে থাকার এরকম একটা চিন্তাভাবনা অনেক মহৎ একটা বিষয়—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। ধর্মীয় ভুজং-ভাজুং জিনিসটাকে সরিয়ে রাখলে ইসলামে মুহাম্মদের প্রথম দিকের চিন্তাভাবনাও খুব সম্ভবত এরকমই ছিল। তিনি যে সমাজে বড় হয়েছিলেন, সেখানে তিনি দেখে আসছিলেন যে, বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন মতবিরোধের জের ধরে গোত্রে গোত্রে নিত্য হানাহানি লেগেই থাকত। তিনি এই হানাহানি বাদ দিয়ে হয়তো সবাইকে একটি সূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন। যদিও সাম্যবাদের কোথাও মানুষ হত্যার বিধান থাকার কথা না, কিন্তু কম্যুনিজমকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে একটা শ্রেণী ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করেছেন, তেমনি মুহাম্মদ নিজেই প্রায় শ’খানেক যুদ্ধ করেছেন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই যুদ্ধ আজও থামেনি, আজও ইসলাম সম্পূর্নরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। কম্যুনিজমেরো বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়নি সর্বত্র। কোনো মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি বিন্দুমাত্র রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোথাও বিরাট গণ্ডোগোল আছে।

গণ্ডোগোল আছে ইসলামের একটি হিসাবেও—ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো যাকাত—‘প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর–নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরীব–দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়’ (উইকি)। এই হিসাবে ধনীরা গরীবদেরকে যাতাক দিতেই থাকবে। এক পর্যায়ে দুনিয়ায় আর গরীব থাকবে না। তখন কী হবে? যাকাত জিনিসটার প্রয়োজন ফুরাবে। ইসলামের একটা স্তম্ভ ধসে যাবে। এটা কি মুসলমানরা মেনে নিবে? আবার ইসলামে মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ আছে, অমুসলিমরা ইসলামের পথে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। অমুসলিম তো বটেই, অনেক মুসলমানও এটা মেনে নিবে না।

দুনিয়ায় সবকিছু প্রতিনিয়ত একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই বিবর্তন সব খানে এক ভাবে হচ্ছে না। তাই স্থান কাল পাত্র ভেদে মানুষের রুচি, খাদ্য, পোশাক, চিন্তা, চেতনা, মতামত, মন–মানসিকতা একেকরকম হতে বাধ্য। আর এইযে বৈচিত্রময়তা, এটাই সৌন্দর্যের ভিত্তি, প্রকৃতির নিয়ম—এটাই বাস্তবতা। কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ দিয়ে এই বিবর্তনকে বাধা দেয়া বা বেঁধে রাখা অসম্ভব।

মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে, বৈচিত্রময়তাকে সম্মান করতে, অন্যের স্বাধীনতাকে, স্বাধীন মতবাদ, চিন্তা–চেতনাকে সমর্থন করতে…। শুধু সমর্থন করি না অন্যের ক্ষতি করাকে…। নাস্তিকদের সর্বোচ্চ মতপ্রকাশ করার অধিকারকে যেমন সমর্থন করি, তেমনি সমর্থন করি আস্তিকদের ধর্ম পালন করাকেও। কিন্তু মত প্রকাশের নামে যদি কেউ কারো ক্ষতি করার উস্কানি দেয়, বা ধর্ম পালনের নামে যদি কেউ কারো ক্ষতি করতে চাপাতি হাতে নেয়—এটা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।