মেরি কুরির রেডিয়াম ভালোবাসা – পর্ব ৪

[পর্ব -১] [পর্ব – ২] [পর্ব – ৩]

পৃথিবীর সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে মেরির। স্তব্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি সারাক্ষণ। ইভ ও আইরিনকে সামলাচ্ছেন জাঁ পেরির স্ত্রী। ইভ কিছুই বুঝতে না পারলেও সাড়ে আট বছর বয়সী আইরিন বুঝতে পারছে তার বাবা আর নেই। মায়ের কাছে আসার জন্য কাঁদছে সে। মেরির বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। পিয়েরকে ছাড়া বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। কিন্তু তাঁর মেয়েদের কী হবে? পিয়েরের স্বপ্ন ছিল আইরিন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। মেয়েটা হয়েছেও পিয়েরের মত ধীর স্থির অথচ ভীষণ জেদি। মেরি নিজেকে বোঝান – ভেঙে পড়লে চলবে না। মেয়েদের জন্য তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। বাবার অভাবে মেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা যেন একটুও নষ্ট না হয়।

ফরাসি সরকার মেরির জন্য একটা বিধবা-ভাতার ব্যবস্থা করলো। কিন্তু মেরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়েরের পদে মেরিকে নিয়োগ দেয়ার দাবি তুলছেন অনেকেই। প্রফেসর হবার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মহিলা হবার কারণে নোবেল বিজয়ী মেরি কুরিকে প্রফেসর পদ দিতে রাজী নয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কারণ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মহিলা শিক্ষক নেই। মেরিকে পিয়েরের জায়গায় নিয়োগ করা হলো ঠিকই কিন্তু পিয়েরের ‘প্রফেসর’ পদ দেয়া হলো না। মেরি হলেন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার প্রধান।

পিয়েরের ল্যাবে অধিষ্ঠিত হলেন মেরি। ল্যাবে যেদিকেই তাকান পিয়েরের স্মৃতি এসে ঝাঁপটা মারে তাঁকে। সরবোনে মেরির গবেষণার শুরুই হয়েছিল পিয়েরের সহযোগিতায়। পিয়ের জোর না করলে মেরির তো ফ্রান্সেই থাকা হতো না। পিয়েরের কত স্বপ্ন ছিল তাঁর ল্যাবকে ঘিরে। সরবোনে একটা আধুনিক ল্যাব পিয়ের দেখে যেতে পারলেন না। মেরি শপথ নিলেন পিয়েরের স্বপ্ন সফল করে তোলার। কায়মনোবাক্যে গবেষণা শুরু করলেন মেরি।

মেরির কর্মদক্ষতা সরবোন ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করলো। ১৯০৬ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন মহিলা প্রফেসর পদে নিয়োগ পেলেন – এবং তিনি হলেন মেরি কুরি। পিয়েরের পদে পূর্ণমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মেরি। পুরো ইউরোপের একাডেমিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পিয়েরের ফিজিক্স কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন মেরি।

প্রথমদিনের ক্লাসে লেকচার থিয়েটার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো। সিনিয়র প্রফেসররা সবাই, ডিন, মেরির স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রীরাও চলে এসেছে তাদের প্রিয় মাদামের লেকচার শুনতে। সাংবাদিকরা ভিড় করেছে প্রফেসর হিসেবে মাদাম কুরিকে নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য।

কাঁটায় কাঁটায় দুপুর একটায় ক্লাসে প্রবেশ করলেন মেরি। কালো গাউন, প্রশস্ত কপাল, উজ্জ্বল দুটো চোখ, আর উন্নত শিরে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন মেরি। প্রচন্ড করতালিতে ফেটে পড়লো লেকচার থিয়েটার। মেরি চুপচাপ অপেক্ষা করছেন কখন করতালি থামবে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর করতালি থামলো। মেরি আগেই ডিনকে অনুরোধ করেছিলেন যেন পরিচিতির আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া হয়। ডিন পল আপ্পেল খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রফেসর হিসেবে স্বাগতম জানালেন। তারপর হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা পিনপতন নিস্তব্ধতায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন – মেরির কথা শোনার জন্য। কী বলে শুরু করবেন মেরি? পিয়েরের স্মৃতিচারণ করতে করতে কি কেঁদে ফেলবেন সদ্য স্বামীহারা এই ৩৮ বছর বয়স্কা নতুন প্রফেসর? সবাই অপেক্ষা করছেন মেরির দুঃখে কাতর হওয়ার জন্য।

কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবাই হতবাক হয়ে গেলেন – যখন দেখলেন মেরি তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছেন ঠিক সেইখান থেকে – যেখানে পিয়ের তাঁর লেকচার শেষ করেছিলেন। ব্যক্তিগত শোকের একটা শব্দও উচ্চারণ না করে মেরি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিয়ে গেলেন অপূর্ব দক্ষতায়।

ব্যক্তিগত দুঃখ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে মেরিকে কেউ দেখেনি কখনো। নিজের মেয়েদের সামনেও কখনো কাঁদেননি মেরি। মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে কষ্টের কথাগুলো পিয়েরের সাথে শেয়ার করেছেন ডায়েরির পাতায়। সরবোনে প্রথম ক্লাস নেয়ার পর মেরি পিয়েরকে লিখলেন, “আমাকে সরবোনের প্রফেসর হিসেবে দেখলে তুমি আজ খুবই খুশি হতে। আমি তোমার জন্যই তোমার কাজ করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার জায়গায় নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না একটুও। প্রতি মুহূর্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারছি না শুধু আমাদের মেয়েদের জন্য। তাদেরকে আমার মানুষ করতে হবে। যে বিজ্ঞানের পথে তুমি আমাকে রেখে গেছো সেই পথে আমাকে সফল হতে হবে। যদি সফল হই তা হবো তোমার জন্য।”

পিয়েরের কবরের কাছাকাছি থাকার জন্য মেরি স্‌সু’র কাছে বাসা নিলেন। নতুন বাসা থেকে কবরস্থান খুব কাছে – কিন্তু সরবোন ইউনিভার্সিটি অনেক দূরে। মেরি প্রতিদিন সকাল বেলা ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় উঠে বসেন। আধঘন্টা পর সরবোনের কাছের স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে নিজের অফিসে যান। কতদিন রাস্তায় হাঁটার সময় ঘোড়ার গাড়ি দেখলে মনে মনে কামনা করেছেন কোন একটা গাড়ির চাকা যেন তাঁর মাথাটা থেঁতলে দিয়ে যায় – যেমন ঘটেছিল পিয়েরের বেলায়। কিন্তু দিনে দিনে দিন চলে যায়, সেরকম কিছুই ঘটে না।

আইরিন আর ইভকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মেরি। তাদের জন্য বিশেষ স্কুলের ব্যবস্থা করেছেন মেরি সহ আরো অনেক বিখ্যাত প্রফেসররা মিলে। ছুটির দিনে একেক জন একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। মেয়েদের যথেষ্ট খেলাধূলা ও শরীরচর্চা করার বিশেষ দরকার আছে বলে মনে করেন মেরি। আইরিন ইতোমধ্যেই সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা শিখে ফেলেছে। তাদের সারাক্ষণের সাথী হিসেবে আছেন তাদের দাদু।

কিন্তু শরীর ভেঙে পড়েছে ৮২ বছর বয়সী ডাক্তার ইউজিন কুরির। বয়সের কারণে যতটুকু – তারচেয়েও বেশি হলো পুত্রশোকে। পুরো এক বছর রোগে ভুগে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান ইউজিন কুরি। স্‌সো কবরস্থান থেকে পিয়েরের কফিন তোলা হলো। সেই জায়গায় ইউজিনের কফিন রেখে তার উপরে পিয়েরের কফিন রাখা হলো। তারপর মাটিচাপা দেয়া হলো। মৃত্যুর পর ছেলেকে এভাবে বুকে ধরে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ডাক্তার ইউজিন।

কুরি পরিবারে আরেকটি মৃত্যুতে আবার শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বারো বছরের কিশোরী আইরিন। দাদুই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। মেরি আইরিনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। এবার মেরিকেই সবদিক সামলাতে হচ্ছে। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন সরবোনে পড়ানো, গবেষণা ইত্যাদি নানা কাজে। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি বিষয়ক ৯৭১ পৃষ্ঠার একটি বিশাল বই লিখেছেন মেরি এই ক’বছরে।

এত কাজের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে শোক এবং হতাশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন মেরি। শোকের পোশাক ছেড়ে কিছুটা উজ্জ্বল পোশাক পরতেও শুরু করেছেন। মেরির শারীরিক কমনীয়তা ও সৌন্দর্য আবার নতুন করে চোখে পড়তে শুরু করেছে সবার। অনেকেই বলছেন – “শোকের আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে গেছেন মেরি।” সহকর্মী ও বন্ধু পল লাঁজেভি’র সাথে একটা সহমর্মিতার অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছে মেরির। পিয়েরের মৃত্যুর পর সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন লাঁজেভি। এখন লাঁজেভির ব্যক্তিগত দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন মেরি।

পল লাঁজেভি ছিলেন পিয়েরের ছাত্র এবং পরে ইপিসিআই-এ সহকর্মী এবং ব্যক্তিগত বন্ধু। পিয়েরের চেয়ে বয়সে ১৩ বছর এবং মেরির চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট লাঁজেভি কুরি পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছেন। প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী লাঁজেভির সাথে বন্ধুত্ব ছিল আইনস্টাইনেরও। আইনস্টাইন মনে করতেন – লাঁজেভিই একমাত্র ফরাসি যিনি তাঁকে ঠিকমত বুঝতে পারেন। চৌম্বকত্বের ওপর ইলেকট্রনের তত্ত্ব সফলভাবে প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছিলেন লাঁজেভি। ১৯০৭ সাল থেকেই মেরি আঁচ করতে পারছিলেন পারিবারিক জীবনে ভীষণ সংকটে পড়েছেন লাঁজেভি।

লাঁজেভি বিয়ে করেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে – বাইশ বছরের তরুণী জেনিকে। জেনি ভীষণ উচ্চাভিলাসী। অর্থ-সম্পদের প্রতি খুবই লালায়িত ছিলেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে স্বামীর সুনামে তিনি খুশি ঠিকই – কিন্তু সেই সুনামে যখন কোন অর্থপ্রাপ্তির চিহ্নও দেখা যায় না – তাঁর ভালো লাগে না। তিনি স্বামীকে বোঝান ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিলে অনেক বেশি অর্থোপার্জন হয়।

লাঁজেভি যে পড়াতে এবং গবেষণা করতে ভালোবাসেন তাতে জেনির কিছুই যায় আসে না। জেনির সাথে যোগ দেন জেনির বোন ও মা। জেনির মা লাঁজেভির বাসাতেই থাকতেন। তাঁরা সবাই মিলে লাঁজেভিকে দিনরাত খোঁচাতে থাকেন।

লাঁজেভি তাঁদেরকে খুশি করার জন্য ইপিসিআই-এর চাকরির পাশাপাশি একটা মেয়েদের স্কুলে পার্ট-টাইম শিক্ষকতার কাজ নেন। ঐ স্কুলে মেরিও পড়াচ্ছেন অনেক বছর থেকে। ইতোমধ্যে লাঁজেভি দুটো ছেলে ও দুটো মেয়ের বাবা হয়েছেন।

ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে – তাদের জন্য আরো অনেক বেশি টাকা দরকার এই অজুহাতে সারাক্ষণ খিটিমিটি করতে থাকেন জেনি। লাঁজেভির সহ্য হয় না তা। ফলে কথা কাটাকাটি হয়। বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে জেনির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন জেনির বোন ও মা। লাঁজেভি আরো রেগে যান।

পিয়েরের মৃত্যুর পর লাঁজেভি যখন মেরির পরিবারে কিছুটা বেশি সময় দিলেন কয়েকদিন, জেনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন যে তাঁর স্বামীর সাথে মেরির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

একদিন মেরি দেখলেন লাঁজেভির মাথায় মুখে হাতে আঘাতের চিহ্ন। অনেক জোর করার পর লাঁজেভি যা বললেন তা শুনে আঁৎকে উঠলেন মেরি। লাঁভেজিকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা ও শাশুড়ি। শুধু তাই নয় – লাঁজেভির মাথার ওপর আস্ত মদের বোতল ভেঙেছেন জেনি। লাঁজেভির প্রতি মায়া হয় মেরির। এরকম একটা প্রাণবন্ত মায়াময় মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানীর মূল্য বুঝতে পারছেন না তার স্ত্রী এটা দুঃখজনক। মেরির সহমর্মিতা পেয়ে লাঁজেভি তাঁর দুঃখের কথা বলতে শুরু করলেন মেরিকে।
“আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি।”
“না” – লাঁজেভির কথা শুনে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন মেরি -“খবরদার, ওরকম চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবে না। তোমার ছেলে-মেয়েদের কথা তো তোমাকে ভাবতে হবে।”

১৯১০ সালের জুলাই মাসে পল লাঁজেভি নিজের নাম গোপন করে সরবোন ইউনিভার্সিটির কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন। ইপিসিআই ও স্কুলের কাজ শেষে যেটুকু সময় পান এই অ্যাপার্টমেন্টেই কাটান লাঁজেভি। বাসায় ফেরেন অনেক রাতে এবং মাঝে মাঝে ফেরেনও না।

মেরির বাসা যেহেতু সরবোন থেকে অনেক দূরে – লাঞ্চটাইমে তিনি লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করেন। মাঝে মাঝে হাতে সময় থাকলে মেরি রান্নাও করেন কিছু কিছু। লাজেঁভি অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবি মেরিকে দিয়েছেন যেন মেরি ইচ্ছেমত আসা-যাওয়া করতে পারেন।

লাঁজেভির সাথে এরকম একান্তে সময় কাটানোতে যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে একটুও খেয়াল নেই মেরির। কারণ তাঁর বয়স তখন ৪৩, লাঁজেভির ৩৮, দু’জনই দায়িত্বশীল অধ্যাপক। তাঁদের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বোঝার এবং সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে তা মেরি বা লাঁজেভি কেউই ভাবেননি। শুরুতে প্যারিসের একাডেমিক জগতের কেউই কিছু মনে করেন নি তাঁদের মেলামেশায়। কিন্তু ক্রমেই অবস্থা বদলাতে শুরু করলো।

১৯১০ সালের মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র কাজে ব্যস্ত মেরি। গবেষণাপত্র তৈরি করার জন্য এবং মেয়েদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য তিনি চলে গেলেন প্যারিসের বাইরে। সেখান থেকে তিনি পল লাঁজেভিকে একটা চিঠি লিখলেন। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানায়।

প্যারিসে ফিরে মেরি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখেন পল নেই সেখানে। তাঁর চিঠিটাও নেই। বিল্ডিং-এর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানতে পারলেন – লাঁজেভি কিছুদিন থেকে অসুস্থ, চিঠিপত্রগুলো তাই মেইলম্যানকে বলে লাঁজেভির বাসায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মেরি।

লাঁজেভির অসুস্থতার কথা শুনে যতটা উদ্বিগ্ন তিনি, তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হলেন চিঠিটার জন্য। চিঠিটা লাঁজেভি ছাড়া আর কারো হাতে পড়লে তো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চিঠিতে তিনি কিছু আবেগের কথা লিখেছেন। লাঁজেভিকে মিস করার কথা লিখেছেন, লাজেঁভির মায়াবী চোখের কথা লিখেছেন, এবং লাঁজেভিকে ‘ডার্লিং’ বলে সম্বোধন করেছেন। মেরি ভয় পাচ্ছেন যদি এ চিঠি লাঁজেভির স্ত্রী ও শাশুড়ির হাতে পড়ে – কী অবস্থা হবে? জানাজানি হয়ে গেলে অন্যরাও তো ভুল বুঝতে পারে।

উৎকন্ঠিত হয়ে মেরি গেলেন বন্ধু অধ্যাপক জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভিরও বন্ধু। মেরির কাছে সবকিছু শুনে পেরি গেলেন লাঁজেভির বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন পরিস্থিতি যতটুকু আন্দাজ করেছিলেন তারচেয়েও খারাপ। মেরির চিঠি পড়েছে জেনির হাতে।

চিঠি পড়ে জেনির বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে তাঁর স্বামী পল এখন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে ‘বিদেশি ডাইনি’ মেরির সাথে থাকতে শুরু করেছেন। জেনি হুমকি দিচ্ছেন, “সব কেচ্ছা আমি ফাঁস করে দেবো। আমার ভগ্নিপতি পত্রিকার সাংবাদিক। ওই বুড়ি মেরি ডাইনিকে আমি দেশছাড়া করবো। আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে শয়তানি।”

জেনি বেশি হৈ চৈ করছেন দেখে তাঁর এগারো বছর বয়সী ছেলে জাঁ লাঁজেভি মা-কে থামাতে গেলে এক ধমক দিলেন জেনি – “চুপ কর্‌ শয়তানের বাচ্চা। বাপের মত তোরও কি একটা রক্ষিতা দরকার?”
জাঁ পেরি অনেক কষ্টে জেনিকে কিছুটা শান্ত করলেন। বুঝালেন বেশি হৈ চৈ করলে তাঁরই সম্মান নষ্ট হবে।

ক’দিন পর বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল পেরির। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পেরি দেখলেন অন্ধকারে ঝোঁপের আড়াল থেকে কেউ একজন বেরিয়ে ছুটে এলো তাঁর দিকে। কাছে আসতেই চিনতে পারলেন পেরি। মেরি! এ অবস্থায় এত রাতে! আলুথালু বেশ, জামাকাপড়ে ময়লা দাগ, ভয়ার্ত চেহারা, ঠক ঠক করে কাঁপছেন!!

দ্রুত বাসায় নিয়ে গেলেন মেরিকে। হেনরিয়েট ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেরিকে। একটু আত্মস্থ হবার পর জানা গেলো ঘটনা। রাস্তায় মেরিকে দেখে শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছেন লাঁজেভির স্ত্রী ও শ্যালিকা। চুল টেনে মাটিতে ফেলে লাথি মারতে মারতে হুমকি দিয়েছেন, “আবার যদি তোকে প্যারিসে দেখি খুন করে ফেলবো কুত্তি।” ভয়ে অপমানে লজ্জায় আর ট্রেন ধরে নিজের বাসায় ফিরতে পারেননি মেরি। অন্ধকারে বসে ছিলেন পেরির ফেরার অপেক্ষায়। পরের দিন মেরিকে তাঁর বাসায় দিয়ে এলেন হেনরিয়েট। রাতের মধ্যে মেরি অনেকটা সুস্থির হয়ে উঠেছেন।

ব্যক্তিগত যত সমস্যাই থাকুক বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে শিথিলতা নেই মেরির। মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেল্‌স গেলেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র সভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়াম স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে মেরি কুরির মাপকে গ্রহণ করা হলো। স্ট্যান্ডার্ড একক হিসেবে এই পরিমাপের নাম রাখা হলো ‘কুরি’। তেজষ্ক্রিয়তার আন্তর্জাতিক একক – বেকোয়ারেল (Bq) এবং ব্যবহারিক একক – কুরি (Ci)। [১ কুরি = ৩৭ বিলিয়ন বেকোয়ারেল।]

ফ্রান্সের বিজ্ঞানজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সেস। একাডেমির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেই কিছু করার জো নেই ফ্রান্সে। একাডেমির সদস্যদের ক্ষমতা অনেক। বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে আর্থিক অনুদান দেয়া ছাড়াও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের স্বীকৃতির ব্যাপারেও অনেক প্রভাব রাখে একাডেমি। সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ পাওয়া সহজ নয়।

১৯১০ সালের ডিসেম্বরে একাডেমির একটা সদস্যপদ খালি হয়। এই পদ লাভের জন্য যে যোগ্যতা দরকার মেরির যোগ্যতা তারচেয়ে অনেক বেশি। মেরি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, মেরির আবিষ্কার বিশ্বজোড়া খ্যাতিলাভ করেছে, মেরির একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু মেরির সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হচ্ছে – মেরি একজন মহিলা। ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের ইতিহাসে তখনো পর্যন্ত কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করেননি। কিন্তু ইতিহাস গড়াই তো মেরির কাজ। মেরি সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করলেন।

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান সহ অনেক প্রগতিশীল বিজ্ঞানী মেরির সমর্থনে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রভাবশালী প্রগতিশীল পত্রিকা ‘লা ফিগারো’ মেরির সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। একাডেমি অব সায়েন্সের একচেটিয়া পুরুষ-রাজত্বে নারীর অধিকার কি তাহলে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে?

কিন্তু সকল শুভ সম্ভাবনার গলাটিপে মারার জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠলো। মেরির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন দু’জন গোঁড়া ক্যাথলিক বিজ্ঞানী এডোয়ার্ড ব্র্যানলি ও মার্সেল ব্রিলোইন। তাঁদের বৈজ্ঞানিক অর্জন মেরির তুলনায় কিছুই নয়।

৬৬ বছর বয়সী ব্র্যানলি বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর কিছু কাজ করেছিলেন। কিন্তু আগের বছর (১৯০৯) বেতার যোগাযোগের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে মার্কনিকে। ব্র্যানলি তাতে খুবই অসন্তুষ্ট। এখন ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সে ‘নাস্তিক’ মেরির ‘অনুপ্রবেশের চেষ্টা’ ব্র্যানলিকে রীতিমত রাগিয়ে দিয়েছে।

তাঁর যোগ্যতা মেরির তুলনায় কম, কিন্তু অনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র অনেক। মেরির বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটানোর জন্য তাদের হাতে অনেক পত্রিকা। তারা প্রচার করতে শুরু করলো – মেরি ইহুদিদের হয়ে কাজ করছেন। তাঁর স্ক্লোদভস্কা পদবিতে ইহুদির গন্ধ পাওয়া যায়। যখন আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো মেরি জন্মসূত্রে ক্যাথলিক – পরে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে করতে মুক্তমনা হয়েছেন, তাতে ধর্মান্ধরা আরো ক্ষেপে উঠলো – বললো ফ্রান্সে নাস্তিকের স্থান নেই।

মেরির জাতীয়তাবাদ নিয়েও প্রশ্ন উঠলো। মেরি যে জন্মসূত্রে পোলিশ তাতেও নাকি মেরির অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। জনপ্রিয় লেখিকা মেরি রেগনিয়ের – যিনি নারীর অধিকার নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন – বিবৃতি দিলেন মেরির বিপক্ষে – বললেন মেরি যে বিজ্ঞানচর্চা করছেন তা ঠিক করছেন না। মেয়েদের আসল কাজ হলো চুলে রঙিন ফিতে বেঁধে প্রেম ভালোবাসার ভেলায় চড়ে কাঁদা হাসা।

উগ্র জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলো এমনও প্রচার করতে শুরু করলো যে মেরির নোবেল পুরষ্কার পাওয়াটা পিয়েরের করুণাতেই হয়েছে – নয়তো মেরির কোন যোগ্যতাই নেই নিজে কিছু করার।

মেরি এসব প্রপাগান্ডার কোন উত্তর দেয়ার দরকার আছে বলেও মনে করেন না। কিছুতেই মেরিকে কাবু করতে না পেরে একাডেমির নির্বাচনের বারোদিন আগে ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি শেষ অস্ত্র ছুঁড়লো ট্যাবলয়েড পত্রিকা এক্সেলসিয়র।

প্রথম পাতায় মেরির বিশাল ছবির সাথে তাঁর হাতে লেখা চিঠির অনুলিপি ছাপিয়ে মেরি ও লাঁজেভিকে জড়িয়ে কুৎসিত প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে ব্যক্তিগত কুৎসা রটানো হলে কোন ধরনের যুক্তি প্রয়োগ না করেই অনেকে তা বিশ্বাস করে ফেলেন। প্যারিসের তথাকথিত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের অনেকেই মেরির নামে ছি ছি করতে শুরু করলেন।

১৯১১ সালের ২৩ জানুয়ারি একাডেমির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ব্র্যানলি পেয়েছেন ২৯ ভোট, মেরি ২৮ ভোট আর ব্রিলোইন পেয়েছেন ১ ভোট। মাত্র এক ভোটে মেরি হেরে গেলেন। কিন্তু একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী জিতলে হলে কমপক্ষে দুই ভোটের ব্যবধানে জিততে হয়। আবার ভোট হলো। এবার ব্র্যানলি ৩০ ভোট আর মেরি ২৮ ভোট। উল্লাসে নেচে উঠলো রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু তাদের ভয় মেরি যদি ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী হয়ে আবার নির্বাচন করেন? মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশের সুযোগ চিরতরে বন্ধ করার জন্য ভোটের ব্যবস্থা হলো। ৯০ জন বিজ্ঞানী ভোট দিলেন মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশাধিকার চিরতরে বন্ধ করার পক্ষে, ৫২ জন ভোট দিলেন বিপক্ষে। [পরবর্তী ৬৮ বছর ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সে কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করতে পারেন নি। ১৯৭৯ সালে এ প্রথা রহিত হয়।]

মেরি কুরি নীরবে তাঁর অধ্যাপনা ও গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত মেরির গবেষণার ফল ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মেরি সেসব নিয়ে কাজ করছেন।

সরবোনে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মেরি। পল লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। লাঁজেভির সাথে তাঁর একাডেমিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিকই আছে, তবে দেখাশোনা হচ্ছে না।

মেরির মনে হচ্ছে সামাজিক সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করতে তাঁর অফিসে দেখা করতে এলেন লাঁজেভির স্ত্রীর ভগ্নিপতি সাংবাদিক হেনরি বোর্গেস।
“মাদাম, আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।”
“বলুন”
“আপনার আর মঁসিও লাঁজেভির কিছু একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি আমাদের হাতে এসেছে।”
মেরির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে দেখেই হেনরি বুঝতে পারলেন কাজ হয়ে গেছে।
“মসিও লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কেউ একজন আপনাদের চিঠিগুলো নিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। এগুলো প্রকাশিত হলে আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনাকে হয়তো দেশত্যাগ করতেও হতে পারে। সুতরাং একটু সাবধানে থাকবেন মাদাম।”

হেনরি বোর্গেস যে মেরিকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছেন তা বুঝতে পারছেন মেরি। তিনি কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই হেনরিকে বিদায় করে দিলেন। কিন্তু খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন তিনি। পরামর্শ চাইতে গেলেন জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভির বাসায় গিয়ে সব জানতে পারলেন।

লাঁজেভি অসুস্থ হয়ে যখন বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জেনি লাঁজেভির চাবি নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে যান। সেখান থেকে লাঁজেভিকে লেখা মেরির চিঠিগুলো সব নিয়ে আসেন। চিঠিগুলো পড়ে ভীষণ রেগে যান জেনি।
“ঐ শয়তানীকে আমি খুন করে ফেলবো।”
জেনির বোন ও মা জেনিকে কোন রকমে শান্ত করে পরামর্শ দেন চিঠিগুলো বোনের স্বামী হেনরির হাতে তুলে দিতে। হেনরি দেখলেন এই তো সুযোগ মেরিকে ব্ল্যাকমেইল করার।

সব শুনে জাঁ পেরিও বিচলিত হয়ে উঠলেন। জেনি একবার সরাসরি আক্রমণ করেছিল মেরিকে। তার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। মেরি যদি কিছুদিন প্যারিস থেকে দূরে কোথাও চলে যান ভালো হয়।

একটা সুযোগ এসে গেলো ইতালিতে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যাবার। ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোল নরমাল সুপেরিয়র’ – যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হবার শিক্ষা নেয়। ইকোল নরমাল সুপেরিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমিল বোরেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভাবান লেখিকা মার্গারিট বোরেল মেরিকে খুব পছন্দ করেন। মার্গারিট সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পল আপ্পেলের মেয়ে। এমিল ও মার্গারিটের সাথে মেরিও আইরিন ও ইভকে নিয়ে চলে গেলেন ইতালি।

ইতালিতে কনফারেন্স চলাকালীন একদিন সন্ধ্যায় মার্গারিটের সাথে একান্তে কথা বললেন মেরি। পল লাঁজেভির ব্যক্তিগত সুখ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত মেরি।
“মার্গারিট, তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই – পলের মত এমন মেধাবী বিজ্ঞানী, এমন ভালো মনের মানুষ আর হয় না। অথচ তার স্ত্রী তাকে এত কষ্ট দেয়। পলের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। পল খুব নরম মানুষ। কিন্তু তুমি আর আমি তো শক্ত। আমাদের কি উচিত নয় পলকে জেনির হাত থেকে রক্ষা করা?”
মার্গারিট মেরির চোখে দেখতে পান লাঁজেভির জন্য ভালোবাসা।

ইতালি থেকে প্যারিসে ফিরে মেরি শুনলেন লাঁজেভির সাথে জেনির সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে গেছে। লাঁজেভি নিজের বাসা ছেড়ে জাঁ পেরির বাসায় গিয়ে উঠেছেন।

মেরি ভাবলেন এসময় প্যারিসে থাকলে আরো সমস্যা হতে পারে। তিনি মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন হল্যান্ডের লিডেনে। সেখানে গিয়ে তিনি অতি নিম্নমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের ধর্মের পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা করলেন ক্যামেলিন ওনিসের সাথে। [ওনিস দু’বছর পর (১৯১৩) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।]

বেশ কিছুদিন লিডেনে কাটানোর পরেও প্যারিসে ফেরার ইচ্ছে হলো না মেরির। তিনি তাঁর মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন পোল্যান্ডে। ইভ ও আইরিন প্রথমবারের মত তাদের মায়ের জন্মভূমিতে এলো। মেরির সব আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হলো অনেক বছর পর। মেরির বড়বোন ডাক্তার ব্রোনিয়া ও তাঁর স্বামী ডাক্তার কাজিমির ইতোমধ্যে পোল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একটা যক্ষ্মা হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তাঁরা। মেরি তাঁর নোবেল পুরষ্কারের টাকা থেকে একটা অংশ দান করেছেন এই হাসপাতালের জন্য। মেরি ও তাঁর মেয়েদের কাছে পেয়ে সবাই খুব খুশি হলেন। আইরিন ও ইভের সময়ও বেশ আনন্দে কাটলো পোল্যান্ডে।

১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে ফিরলেন মেরি। প্যারিসে লাঁজেভির পারিবারিক অশান্তি আরো ঘনীভূত হয়েছে। মেরি এসময় ব্রাসেল্‌সের সল্‌ভে কনফারেন্সে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। অক্টোবরের ৩০ তারিখে শুরু হলো কনফারেন্স। সেই সম্মেলনে মেরি কুরি ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানী যোগ দিয়েছেন – আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাংক, রাদারফোর্ড, পয়েনকেয়ার প্রমুখ। প্যারিস থেকে পল লাঁজেভিও যোগ দিয়েছেন সম্মেলনে। মেরির সাথে পলের দেখা হলো অনেকদিন পর।

[শেষ পর্ব]