বডি শেমিং: সমাজের এক গুরুতর সামাজিক রোগ

প্রত্যেক ব্যক্তির পছন্দ স্ব-বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ, তাঁর পছন্দের মানদণ্ড অন্যের সাথে না মেলানো। যেমন, আমাদের কাছে যা সাধারণ মনে হয়, সেটাই হতে পারে অন্যের কাছে অপূর্ব ও বিস্ময়কর। আসল সমস্যা দেখা দেয় যখন কেউ নিজের পছন্দকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কারো শারীরিক গঠন নিয়ে অসদুচ্চারণ যেমন – “এই ওজন নিয়ে কিভাবে রিকশায় উঠবে?” অথবা “তোমার চলাফেরা হিজড়াদের মত”। উল্লেখ্য, ‘বডি শেমিংবলে অনেক সময় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিক অপমানিত করা হয়। কারো ওজন, আকার কিংবা শারীরিক গড়ন নিয়ে করা প্রকাশ্য মন্তব্য বা সমালোচনা বডি শেমিংনামে পরিচিত। কারো পেছনে সে সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করাও এই ধূসর ধারণার আওতায় পড়ে, যেমন – দেখনি মেয়েটা কি পরে বেরিয়েছে? সুমো কুস্তিগীরের মতো দেখাচ্ছেবা রসিকতা করেও অনেক সময় বলা হয় অন্তত তুমি অমুকের মতো দেখতে নও, আল্লাহর শুকরিয়া!

বাহ্যিক সৌন্দর্যকে একেবারেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়, তবে যদি সমাজ দ্বারা প্রণীত মানদণ্ডের মাধ্যমে কাউকে ছোট করা বা লজ্জিত করার প্রয়াস হয়, তবে সেই সৌন্দর্য প্রশংসার বাইরে। একনাগাড়ে কলঙ্কিত কথা শুনে শুনে মানুষের মনে নিজের প্রতি অবজ্ঞা জন্ম নিতে পারে। কেউ কেউ মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতা হ্রাস করার জন্য মাদক দ্রব্যের আশ্রয় নেয়। আমাদের মস্তিষ্কে সৌন্দর্যের এক নির্দিষ্ট ধারণা এমন গাঁথা হয়ে আছে যা থেকে আমরা বাঁচতে পারি না। একজনকে তাঁর স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রহণ না করার আমাদের অক্ষমতা, এমনকি একজন সমাজের সবাইকে নিম্নমানের মনে করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। আমাদের ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে বডি শেমিং এক মহামারীর রূপ নিয়েছে, এ অঞ্চলে রঙ ফর্সা করার ক্রীম ও স্লিমিং টি তৈরির প্রতিষ্ঠান সফলভাবে বিদ্যমান।

এই ভয়াবহ সমস্যার মূলে কে বা কারা আছে? এটি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদেরই কাজ নয়, শিক্ষার্থীরাও তাদের বড়দের অনুসরণ করে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে এর প্রকোপ বেশি। সহপাঠীর গায়ের রঙ কালো বলে তাকে এড়িয়ে চলা বা অশোভন শব্দ ব্যবহার করে তাকে ছোট করা এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত। অনেকের গায়ে জন্মদাগ থাকে, সেগুলো নিয়েও সমালোচনা করা হয়।

বডি শেমিং করতে গিয়ে আপনি একজনের মনস্তত্ত্বের গুরুত্ব দেন না, শুধু তার শারীরিক অবস্থানকেই গুরুত্ব দেন। শারীরিক অস্তিত্ব খুবই ক্ষণস্থায়ী, মৃত্যুর পর শরীর মাটির সাথে মিশে যায় কিন্তু কর্ম চিরস্থায়ী। একটি সুন্দর মন একটি সমাজকে পাল্টে দিতে পারে, একটি সুন্দর শরীরের উপর মানুষের মন দীর্ঘকাল টেকে না। বাহ্যিক সৌন্দর্য সব যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। বডি শেমিংয়ের মনস্তত্ত্বিক ব্যাখ্যা অত্যন্ত সহজ – যখন আপনি কারো যোগ্যতার কাছে পরাজিত হন বা কারো প্রতি অত্যন্ত রাগ বা বিরক্তি অনুভব করেন, তার শারীরিক দিকটি সমালোচনার জন্য নির্বাচন করা হয়, যা একটি নির্মম সহজ পন্থা। এটি মনের ক্ষোভ মেটায় এবং প্রতিপক্ষকে ছোট করে। তবে, আমাদের উচিৎ এই ঘৃণ্য প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং যা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সেই সকল গুণের প্রতি আরও মনোনিবেশ করা।