এই লেখাটির উদ্দেশ্য অনেকটা মেটাফোরিকভাবে ধর্ম আর সামাজিকতায় একই এলিমেন্ট যে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটিকে তুলনামূলকভাবে দেখানো। আমরা কি করে একটি ব্যাপার যেটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে সেটিকে নিজের অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতির নিরিখে ব্যবহার করি তার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষন-ই নিচের লেখাতে দেবার চেষ্টা করব। ধর্ম ধর্ম করে পৃথিবীর যত মানুষ উচ্ছাসিত থাকে, তার প্রত্যেকটির ভেতর রয়েছে আসলে পাওয়া বা না পাওয়ার হিসেব। এখানে বেহেস্ত বা স্বর্গ লাভের জন্য ভালো কাজ করা হয়। স্বর্গ-নরক, বেহেস্ত-দোজোখ এগুলো না থাকলে মানুষের আসল চেহারা আসলে দেখা যেতো।
প্রখ্যাত চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র অকাল মৃত্যুর পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনসহ সাধারণ জনগণের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। একইসাথে চলচ্চিত্র শিল্প ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কারণ, সালমান শাহ অভিনীত বেশ কিছু চলচ্চিত্র তখনও মুক্তির অপেক্ষায় ছিল; আরও ছিল তার অভিনয়-অসমাপ্ত চলচ্চিত্রে লগ্নীকৃত অর্থ জলাঞ্জলির সম্ভাবনা। যেহেতু নায়ক সালমান শাহ’র জনপ্রিয়তা তার মৃত্যুর পরে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, তাই তার গুণমুগ্ধ দর্শক ও শ্রোতাসাধারণের ভালোবাসা ও আবেগকে পুঁজি করে সুযোগসন্ধানী চলচ্চিত্র প্রযোজকগণ চলচ্চিত্র ব্যবসার এক মোক্ষম ফন্দি আঁটেন, যাতে করে তারা প্রয়াত নায়কের অভিনীত চলচ্চিত্রে লগ্নীকৃত অর্থ উদ্ধারের পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত মুনাফাও অর্জন করতে পারেন।
আর সেই মোক্ষম ফন্দিটি হলো, সালমান শাহ অভিনীত মুক্তি প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্রকে তার জীবনের শেষ চলচ্চিত্র বলে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন। যেন আবেগপ্রবণ দর্শকবৃন্দ মৃত সালমান শাহ’র জীবৎকালীন শেষ অভিনয় দেখতে পঙ্গপালের ন্যায় প্রেক্ষাগৃহে ছুটে আসে এবং চলচ্চিত্র ব্যবসায় রমরমা অবস্থার উদ্ভব হয়। অর্থাৎ চলচ্চিত্র ব্যবসায় সালমান শাহ’র মৃত্যু যেন শাপে বর হয়ে দেখা দেয়।
যথারীতি আমাদের শহরের একটি প্রেক্ষাগৃহে সালমান শাহ’র শেষ অভিনীত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আনা হলো। মাইকে উক্ত চলচ্চিত্রটিকে সালমান শাহ’র অভিনীত শেষ সিনেমা বলে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হলো। এমন কৌশলী প্রচারণায় প্ররোচিত হয়ে বাংলার হুজুগে দর্শকবৃন্দ প্রচণ্ড আগ্রহসহকারে প্রেক্ষাগৃহে ছুটলো। তারা প্রেক্ষাগৃহের টিকেট কাউন্টারে এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল যে, প্রেক্ষাগৃহের টিকেট কাউন্টার ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্রটির হাউসফুল বা পূর্ণগৃহ প্রদর্শনী হলো। পরের সপ্তাহে শহরের আরেক প্রেক্ষাগৃহে সালমান শাহ অভিনীত আরেকটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আনা হলো।
আর প্রচার করা হলো সেই একই ঘোষণা, ‘সালমান শাহ অভিনীত শেষ সিনেমা।’ এমন ঘোষণায় প্রয়াত নায়কের অনুরাগী দর্শকবৃন্দ কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও সালমান শাহ অভিনীত আরো একটি শেষ সিনেমা দেখার জন্যে এবার সেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটলো। যথারীতি সেই প্রেক্ষাগৃহেও চলচ্চিত্রটির সপ্তাহব্যাপী পূর্ণগৃহ প্রদর্শনী হলো। তার পরের সপ্তাহে শহরের আরেক প্রেক্ষাগৃহে সালমান শাহ অভিনীত আরেকটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আনা হলো।
আবারও সেই একই ঘোষণা প্রচারিত হলো, ‘সালমান শাহ অভিনীত শেষ সিনেমা।’ এবার হুজুগে দর্শকবৃন্দ পূর্বের তুলনায় অধিকতর মাত্রায় বিভ্রান্ত হলো; কিন্তু বিভ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তারা সেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটলো সালমান শাহ অভিনীত শেষ সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে। আর যথারীতি সেই প্রেক্ষাগৃহেও চলচ্চিত্রটির প্রায় সপ্তাহব্যাপী পূর্ণগৃহ প্রদর্শনী হলো। তবে এই সিনেমার মধ্য দিয়েই যে সালমান শাহ অভিনীত শেষ সিনেমা প্রদর্শনের ধারা থেমে গেল, বিষয়টি এমন নয়।
পরবর্তীতে কয়েক মাসব্যাপী সালমান শাহ অভিনীত বেশ কিছু চলচ্চিত্র একইরকম কৌশলী প্রচারণাকে অবলম্বন করে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ক্রমান্বয়ে প্রদর্শিত হতে থাকলো। আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের এমন প্রতারণাপূর্ণ ধারা ক্রমাগত চলতে থাকায় সালমান শাহ’র অনুরাগী দর্শকবৃন্দ যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়লো, তেমনি তাদের আগ্রহেও ভাটা পড়লো। অর্থাৎ এভাবে বারবার বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়ে অবশেষে তাদের সালমান শাহ’র শেষ সিনেমা দেখার বাসনাও নিবৃত্ত হলো। কারণ, মিথ্যা ও চটকদার বিজ্ঞাপনে বারবার প্ররোচিত হয়ে প্রয়াত নায়কের অনুরাগী দর্শকবৃন্দ নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদিন যে চলচ্চিত্রসমূহ দর্শন করেছেন, তার কোনোটাই বিজ্ঞাপনে প্রচারিত ও প্রতিশ্রুত ‘সালমান শাহ’র শেষ সিনেমা’ নয়। এমন প্রচারণায় তারা মূলত প্রতারিত হয়েছেন।
তেমনি প্রতারণার এক চরম উদাহরণ হলো, বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত। ১৯৬৬ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পূর্বেকার ন্যায় এবারও টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমার আসর বসেছে। বিশ্ব ইজতেমায় দেশ-বিদেশের অসংখ্য মুসলমান অংশগ্রহণ করে থাকে; উদ্দেশ্য – প্রচুর সংখ্যক মুসলমান এক জায়গায় সমবেত হয়ে কুরআন-হাদিসের বয়ান শোনা এবং প্রতিক্রিয়াশীল বোধে উজ্জীবিত হয়ে ধর্মীয় মৌলবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রচারের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আর উপরি পাওনা হিসাবে গুনাহ মাফ এবং জান্নাতের মদ, মধু, দুধ ও যৌনাবেদনময়ী হুর-গেলমান ভোগের নিশ্চয়তা লাভ। তাই সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ শেষে এমন আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে। আখেরি শব্দের অর্থ শেষ বা অন্তিম এবং মোনাজাত শব্দের অর্থ প্রার্থনা।
সেই বিবেচনায় আখেরি মোনাজাত কথাটির অর্থ শেষ প্রার্থনা, অর্থাৎ যার পরে আর কোনো প্রার্থনার অবকাশ নেই। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী মুসলমানগণ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও পরবর্তী কালে আরও অসংখ্য প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে থাকে। এমনকি বিশ্ব ইজতেমার প্রতিটি আসরে সমবেত হয়ে প্রতিটি আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে থাকে। অথচ আখেরি মোনাজাতের অর্থ ও শর্ত অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় একবার আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে থাকলে পরবর্তীতে আর কোনো মোনাজাত বা প্রার্থনায় তার অংশগ্রহণের অধিকার নেই।
যেমন, কারও মৃত্যু হলে পুনরায় তার মৃত্যুবরণের সম্ভাবনা নেই, তেমনি কেউ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করলে পুনরায় কোনো প্রকার মোনাজাতে তার অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কারণ ‘আখেরি মোনাজাত’ কথাটির মধ্য দিয়ে অন্তিম প্রার্থনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তেমন প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে কেউ যদি পুনঃপুনঃ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে থাকে, তবে সে নিশ্চিতভাবে মুনাফেকের দলভুক্ত হয়ে পড়ে। কারণ, মুসলমানদের নবী মুহম্মদের মতে মুনাফেকের লক্ষণ তিনটি, যথা – মুনাফেক মিথ্যা কথা বলে, অঙ্গীকার করলে বা প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে এবং আমানতের খিয়ানত করে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে উপর্যুক্ত লক্ষণসমূহের অন্তত দু’টি লক্ষণ স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যায়। যেমন, তারা আখেরি মোনাজাতের কথা বলে পুনঃপুনঃ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে, যা মিথ্যা কথার সামিল। আর আখেরি মোনাজাত কথাটির মধ্য দিয়ে শেষ প্রার্থনার প্রতিশ্রুতি দিলেও পুনঃপুনঃ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। অথচ বারবার মিথ্যা কথা বলা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সত্ত্বেও মুনাফেক হিসাবে তারা বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করে না।
যেমন লজ্জাবোধ করেনি সালমান শাহ অভিনীত চলচ্চিত্রের প্রযোজকগণ। যারা বারবার মিথ্যা প্রচার চালিয়ে এবং প্রয়াত নায়কের শেষ অভিনীত সিনেমা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেছে। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের নিকট মৃত সালমান শাহ যেমন এক তামাশার নাম, তেমনি তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের নিকট আখেরি মোনাজাত হলো এক মহা তামাশার নাম। যা শুধু নামেই আখেরি, কাজে নয়। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ তেমনি আখেরি মোনাজাত প্রসঙ্গে বলা যায় – ‘আখেরি হইয়াও হইল না আখেরি।’
তাই বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত যেন সালমান শাহ’র শেষ সিনেমা, যা শুধু মুনাফেকদের পরিচয়কেই স্পষ্ট করে।