টিলিওলজিকাল আর্গুমেন্ট, নাস্তিক্যবাদের পতন না গড অফ দ্যা গ্যাপস উইথ এক্সট্রা স্টেপস?

বাঙালি ইন্টারনেট আস্তিক সমাজে ঈশ্বরের অস্তিস্ত্বের পক্ষের যুক্তি ঐ “মা-বাবার সেক্স দেখেছেন” এর আগে বাড়ে নি। কিছু ইসলামী লেখক কিছু ক্ষেত্রে কিছু ‘ধার করা যুক্তি’ ব্যবহার করেন, কিন্তু তাদের অজান্তেই সেসব যুক্তির খণ্ডনের বয়স শতক ছুঁতে চলল। তবে যাই হোক- টিলিওলজিকাল আর্গুমেন্ট একটা অপচেষ্টা যেটা ফলাফল বিবেচনা করে উপসংহারে উপনীত হয়। এতে মৌলিক কিছু সমস্যা আছে, যার মধ্যে একটা হচ্ছে মধ্যবর্তী ধাপগুলোর উপর ভিত্তি করে অযৌক্তিক উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যার সাথে মধ্যবর্তী ধাপগুলোর কার্যকারণসম্পর্কিত কোন সম্পর্ক নাই। 

টিলিওলজিকাল আর্গুমেন্টের মূল কথা হচ্ছে মহাবিশ্ব এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যেন মানুষের জন্ম হতে পারে, আর সে কারণে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস না করার চেয়ে বিশ্বাস করা বেশি যৌক্তিক। এক দিক থেকে ভাবলে এই যুক্তিটি অতিমাত্রায় Anthropocentric, মানুষের অস্তিত্বের জন্য পুরো মহাবিশ্ব! ভাবতেই কেমন যেন শিহরণ বোধ হয়। নিজেদের বিশেষ কিছু একটা মনে হয়। এই যুক্তির আবেগ-গত একটা আকর্ষণ আছে। সেগানের মতে মানুষ যখন এই মহাবিশ্বে নিজেদের আবিষ্কার করল একা, আর নিঃসঙ্গ, ঐ পরিস্থিতিতে একজন অভিভাবক কল্পনা করে নেয়া আমাদের সাহস জুগিয়েছিল। মহাবিশ্বে নিশ্চয়ই আমাদের কেউ না কেউ জন্ম দিয়েছে, আর সে-ই আমাদের দেখেশুনে রাখবে, আমরা যদি মারাও যাই সেই স্রষ্টা আমাদের রক্ষা করবেন। আমরা আর অভিভাবকহীন না। এমন ভাবনার আবেগী গ্রহণযোগ্যতা আমাদের ব্যাপারে মহাবিশ্বের নির্লিপ্ততার চেয়ে অনেক বেশি সাহস জুগিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। 

আমাদের মহাবিশ্ব মানুষের জন্য নির্মিত? 

মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব আছে, এটা অনস্বীকার্য। অন্ততঃ একটা গ্রহে, পৃথিবীতে, প্রাণ আছে। কিন্তু পুরো মহাবিশ্ব মানুষের জন্য নির্মিত, বা প্রাণের জন্য নির্মিত, এমন দাবি করাটা বোকামি। কারণ, মহাবিশ্বের ৯৯.৯৯% স্থানই খালি। সেখানে কোনো নক্ষত্র নাই। গ্রহ নাই। নাই কোনো উপগ্রহ। ধূমকেতুর গায়ে জৈব্যযোগ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিককালে, কিন্তু মহাবিশ্বের ৯৯.৯৯% স্থানে ধূমকেতুও নাই। মহাবিশ্বে, পুরো ১৪ বিলিয়ন বছর পুরোনো মহাবিশ্বের কোথাও আমাদের জানামতে প্রাণ নেই। শুধু মানুষই, আর কেউ-ই নেই মহাবিশ্বে। অন্যান্য গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত ভাবে জানি না প্রাণ আছে! আর 

পুরো মহাবিশ্বে প্রাণ আছে কি না, না জেনে এমন দাবি করা যে মহাবিশ্ব আমাদের জন্য তৈরি, ব্যাপারটা বোকামী, আর না হয় arrogance। 

মহাবিশ্বে প্রাণ না থাক, পৃথিবীতে আছে। পৃথিবী আমাদের জন্য বানানো হয়েছে। 

এমন দাবিও ভুল। পুরো ব্যাপার বিবেচনা না করেই উপসংহারে চলে যাওয়াটা ভুল। পৃথিবীতে প্রাণ আছে, সত্য৷ কিন্তু একই সময়ে এটাও সত্য যে ৯৯.৯% প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কোনো খেলায় যদি আপনি একশো বারের মধ্যে নিরানব্বই বারই হারেন, তবে আপনি দাবি করতে পারেন না আপনিই এই খেলার ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়। আপনি দাবি করতে পারেন, কিন্তু সেটা হবে বাস্তবতা বিবর্জিত দাবি। আমার মনে হয় ধার্মিক হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে বাস্তবতা বিবর্জিত হতে পারা। 

তাছাড়াও, পৃথিবীর সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের প্রথম এক চতুর্থাংশে পৃথিবী বাসযোগ্য ছিল না। সেটা শুধু মানুষের জন্যেই না, কোনো প্রাণীর জন্যেই বাসযোগ্য ছিল না। ব্যাক্টেরিয়া না, ডায়নোসর না, তেলাপোকা না। কেউই সে পরিবেশে টিকে থাকতে পারতো না। প্রজাতি হিসেবে মানুষ এসেছে ২০ লক্ষ বছর আগে৷ পৃথিবীর বয়সের অধিকাংশ সময় জুড়েই মানুষ ছিল না। যে গ্রহে অধিকাংশ সময় জুড়ে মানুষ ছিল না সে গ্রহ মানুষের জন্য বানানো, এমন দাবি হাস্যকর। এসব কিছু ছাড়াও, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মহামারি, ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তা, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, বরফযুগ, মেরু বরফে জমে থাকা অজানা ভাইরাস, উল্কাপাত, মহাজাগতিক সংঘর্ষ…ইত্যাদি আমাদের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে রাখে। 

পৃথিবী আমাদের জন্যে বানানো এমন দাবি শুধু হাস্যকর আর বাস্তবতা বিবর্জিতই না, ব্যাপারটা ভয়ানকও বটে। 

এর উপরে, পৃথিবীর পুরোটা মানুষের জন্যে বাসযোগ্য না। পৃথিবীর সারফেসের ৩০ভাগ স্থল, ৭০ভাগ জল। এই ৩০ ভাগের মধ্যে আমাদের বাস। কিন্তু সেখানেও সমস্যা আছে। শুষ্ক মরুভূমি আর বরফে ঢাকা মেরু অঞ্চলে আমাদের ঘনবসতি নেই৷ সেখানে ঘনবসতি করাও সম্ভব না৷ স্বাভাবিক কারণেই। 

পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ অনেক পাতলা একটা আবরণ, একটা আপেলের খোসার মত পাতলা। পৃথিবীর পৃষ্ঠ ছাড়া আর কোথাও আমরা বসতি স্থাপন করতে পারি নি এখনো। ভূগর্ভে না, আকাশে না৷ সেটা নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব কী না তাও আমাদের জানা নেই। ভূগর্ভে বেশি গভীরে যেতে পারবো না কারণ আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা কেন্দ্রের দিকে বেশি৷ আকাশে পারবো না কারণ তাপমাত্রা কম, আর অক্সিজেনের পরিমাণ কম। 

বর্তমান সময়ের পৃথিবীও পুরোটা আমাদের জন্য বাসযোগ্য না! 

পৃথিবী আমাদের জন্য বানানো না, আমরা পৃথিবীর বর্তমান সময় কালের ফলাফল হিসেবে জন্ম নেয়া প্রাণের একটা প্রকার মাত্র৷ পৃথিবীর ইতিহাসের ক্ষুদ্র একটা কাল জুড়ে, পৃষ্ঠের ক্ষুদ্র একটা অংশজুড়ে বাস করে আমরা দাবি করছি পুরো মহাবিশ্ব আমাদের জন্য বানানো! বাহ!