রমেল চাকমা আসলে কে? এত রাগ কেন তার উপরে? বয়স মাত্র ২০ বছর। এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তাও আবার, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী- অর্থাৎ এক চোখে দেখতে পায় না! তাকে সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্র এমন বিপজ্জনক মনে করছে যে পিটিয়েই মেরে ফেলে ক্ষান্ত হয়নি, লাশটাও পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে- পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেললো? বুঝা খুব কঠিন যে, এই সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ, এক চোখওয়ালা ছেলেটির অপরাধ আসলে কি? ছেলেটির বাবা তাকে নিরপরাধ বলছেন, ফেসবুক জুড়ে সকলেই তাকে নিরাপরাধ বলছে- তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রের কাছে তার অপরাধটি কি? গত ৫ এপ্রিল সকালে বাজার করে ফেরার পথে সেনাবাহিনী তাকে ধরে জোন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে দিনভর এমনই পিটানি দিয়েছে যে- পরদিন সেনাবাহিনী যখন তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছে- পুলিশ তার অবস্থা দেখে নিতে চায়নি, স্থানীয় হাসপাতালও তার চিকিৎসার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ রেফার করেছে এবং চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে এসেও তাকে বাঁচানো যায়নি। মৃতপ্রায় অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে ফেলে রাখলেও- সেনাবাহিনী কিন্তু এই বিপজ্জনক ছেলেটিকে তার পরিবার- আত্মীয় স্বজন- বন্ধুবান্ধবের জিম্মায় তুলে দেয়নি, বরং এক মুহুর্তের জন্যেও তাদের নজরদারির বাইরে যেতে দেয়নি। ১৩-১৪ দিন মরার মত মেডিকেলে পড়ে থেকে অবশেষে ১৯ তারিখে মরে গেলেও- সেনাবাহিনীর রাগ কমেনি এতটুকু- লাশটি বুড়িঘাটে পৌঁছলে তা পরিবারের নিকট হস্তান্তর না করে বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনীর একটি দল বোটযোগে অজ্ঞাত স্থানের দিকে নিয়ে যায়, তারপরে লাশটি আবার বুড়িঘাটে নিয়ে এসে বুড়িঘাট বাজারে জাকির সওদাগর নামে এক বাঙালি ব্যক্তির একটি পরিত্যক্ত আলাদা ঘরে রাখা হয় বিপুল সংখ্যক আর্মি নজরদাড়ির মধ্যে – এবং এক পর্যায়ে পরিবারের কোন সদস্য ও জ্ঞাতিজনদের অনুপস্থিতিতে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির প্রতি কোন প্রকার শ্রদ্ধা সম্মান না দেখিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেট্রোল ঢেলে পুঁড়িয়ে ফেলছে লাশটি! ফলে বুঝাই যায়- কি ভয়ানক রাগ এই রমেল চাকমা নামের এই ছেলেটির উপরে! কিন্তু কেন?
মিডিয়া ঘেটে দুটো তথ্য পেলাম। গত ২৩ জানুয়ারিতে নানিয়ারচর উপজেলায় একটা গ্রুপ চাঁদা চেয়ে না পেয়ে দুটো ট্রাকে আগুন লাগিয়ে দেয়, একটা ট্রাক তার সমস্ত মালামালসহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ধারণা করি, ট্রাকগুলো ছিল বাঙালি ব্যবসায়ির। নিরাপত্তা বাহিনীর বরাতে একটা খবরে পেলাম যে, এই আগুন লাগানোর কর্মকাণ্ডের মূল হোতা হচ্ছে নাকি রমেল চাকমা নামের এই ছেলেটি। ফলে, এই ভয়ানক অপরাধের অভিযোগেই তাকে সেনাবাহিনী এরকম পিটিয়ে মারতে পারে, কেননা ছেলেটি পাহাড়ী আদিবাসী। আরেকটি তথ্য পেলাম, রমেল চাকমা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। সে পিসিপি, নানিয়ারচর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিল। পিসিপি পাহাড়ীদের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করে, পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে কথা বলে। ফলে মহা অপরাধই বটে।
রমেল চাকমার ঘটনা নতুন না। সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নানা অভিযোগে ধৃত হয়ে অমানুষিক নির্যাতনে মারা যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম না। ডুরান চাকমার একই পরিণতি ঘটেছিল ২০১৪ সালে। কুসুম চাকমার একই পরিণতি ঘটেছিল ২০০৯ সালে। IWGIA একটি রিপোর্ট Militarization in CHT তে বলা হয়েছে ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৫টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ গ্রেফতারের ঘটনাতেই অভিযুক্ত সম্মুখীণ হয় ভয়ানক নির্যাতনের। পাহাড়ে লাশ পুড়ানোর ঘটনাও নতুন না। ২০১৪ সালে সেনাবাহিনীর হাতে ধৃত ডুরান চাকমা মারা গেলে- ময়নাতদন্তের পরপরেই রাতের অন্ধকারে তাকেও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়! আর সেনাবাহিনীর হাতে অপহৃত কল্পনা চাকমার হদিস আজও মেলে নাই।
ফলে, বুঝাই যাচ্ছে- রমেল চাকমা সহ অন্যদের একমাত্র অপরাধ, তারা পাহাড়ি, তারা বাঙালি না! এই দেশে বাঙালি না হওয়া মস্ত অপরাধই বটে।