মোল্লা ইউনুসের জীবন বিড়ম্বনা

খুব ভোরবেলা রওনা দিয়েছিল ইউনুস। ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটা দিয়েছিল স্টেশনের দিকে। স্টেশনে পনেরো-বিশ জনের একটা গ্র“প থাকবে, ওদের সঙ্গে গিয়ে সে-ও যোগ দিবে। এরকমই কথা হয়েছে কাল এশার নামাজের পর মসজিদে। বড় হুজুর ডাক দিয়েছেন। এইটা ঈমানী দায়িত্ব। ইসলাম আজ বিপন্ন। জীবন দিয়ে হলেও ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। ঢাকায় সেই উদ্দেশ্যেই যাওয়া।

সকালবেলা কিছু খেয়ে আসেনি। এখন খুব খিদে পেয়েছে। মঞ্জু বলেছিল কই যাও?
ইউনুস বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ঢাকায়!
মঞ্জুও সমান বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিল, ঢাকায় ক্যান?
ঢাকায় ক্যান তুই জানোছ না। দরজা লাগা।
বাজারের ট্যাকা দিলা না?
যা পারছ কর। আমার হাতে ট্যাকা নাই।
ট্যাকা নাই ঢাকায় যাইবা ক্যামনে?
আল্লায় নিবো।
ক্যামনে নিবো আকাশ দিয়া উড়াইয়া উড়াইয়া!
ঐ আল্লারে নিয়া মশকরা করবি না। তুইও দেহি বগারগো মত হইছত। জুতাইয়া তোর মুখ ভাঙ্গাই দিমু। নাস্তিক মাইয়াছেলে কোথাকার!
নাস্তিক শব্দটা ইদানিং খুব শোনা যাচ্ছে। এটা ব্যবহার করতে এখন ইউনুসের খুব ভালো লাগলো।
বগার আবার কারা? কার কথা কও? মঞ্জু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো।
‘বগার’ কারা ইউনুস নিজেও জানে না। শুনছে কমপুটারের মধ্যে এরা আল্লার রসুলরে নিয়া আকতা-কুকতা কয়। কয়, রসূলের চরিত্র নাকি খারাপ। নাউজুবিল্লাহ!
এই সমস্ত তুই বুঝবি না। ইসলামের শত্র“গো কামকাজ। ইউনুস বিরক্তি দেখিয়ে নিজের অজ্ঞতাকে বউয়ের কাছে ঢাকার চেষ্টা করে। আলনা থেকে গেঞ্জি, লুঙ্গি নিয়ে ঝোলার মধ্যে ঢোকায়। মঞ্জু পিটপিট করে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখে সন্দেহ, অশ্রদ্ধা।
ইউনুস রোগা পাতলা ঢ্যাঙ্গা আকৃতির। মাকুন্দা বলে সারা গালে দাড়ি-গোঁফের কোন চিহ্ন নেই। শুধু থুতনিতে বালকের বগলের পাতলা লোমের মত একটু দাড়ি। মাথায় হাতে বুনানো টুপি। পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরিহিত ইউনুসকে পরিচিত সবাই মোল্লা নামে ডাকে। সে পেশাদার মোল্লা না। কোন এক শবে-বরাতের রাতে অতি অল্প বয়েসে সে মুসল্লি হয়ে পড়ে। তারপর থেকেই ধর্মকর্ম নিয়ে অতি মাত্রায় মেতে উঠা। ক্লাশ সেভেন পর্যন্ত পড়া ইউনুস ইসলামের জন্য মরতেও প্রস্তুত। প্রয়োজনে ইসলামের দুশমনদেরকে মারতেও তার হাত একটুও কাঁপবে না।

৯০-এর দশকে যখন সালমান রুশদীর ফাঁসির দাবীতে সারাদেশের তৌহদী জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে তখন ইউনুস নেহাত বালক। সে কোন মাদ্রাসার ছাত্র নয়। তবু প্রিয় নবীরে নিয়া খারাপ কথা বলছে শুনে সে আর স্থীর থাকতে পারেনি। যদিও সে জানে না সালমান রুশদি কে? কি করেছে সে । কোথায় তার বাড়িÑএসব কিছুই তার জিজ্ঞাসায় আসেনি। নবীরে বেজ্জইত করছে এটাই বড় কথা।

তাসলিমা নাসরিন নামের এক মেয়েছেলের কথাও তার মনে আছে। চুড়ান্ত বেয়াদপ। কয় কি, খোদা মানি না! কোরআন বদলাও! রসূল মানি না! সেই বেটিরে এক্কেবারে দেশছাড়া করে ছেড়েছে সেবার তারা। বলা বাহুল্য, এর সবক’টাতে ইউনুস শরিক হয়েছে। এসব হচ্ছে ঈমানী দায়িত্ব। দ্বিনের কাজ। আল্লার দুশমনগো বিরুদ্ধে যে কোন যুদ্ধে ইউনুস সামনে থেকে লড়বে।

এই যে এখন একদল নাস্তিকরা বাইর হইছে, এগো বিরুদ্ধেও ইউনুস ঘরে বসে থাকতে পারেনি। বড় হুজুর বলছেন, প্রত্যেক মুসলমান তার জান-মাল দিয়া আল্লার পথে নামবে। এইটা মুসলমানের ফরজ! তার মাল নাই, জান আছে। প্রয়োজনে সে সেটাই দান করবে।
আবছা অন্ধকার ঘরে ঘামের কটু গন্ধ আর শিশুদের প্রস্রাবের গন্ধে একাকার হয়ে গেছে। ঘরটা গুমট। আলো বাতাস ঢোকে না। এক কামড়ার এই ঘরটার ভাড়া মাসে দুই হাজার। পাঁচটি সন্তান ইউনুসের। বড় মেয়েটি প্রায় বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। পরের তিনটিও মেয়ে। সবচেয়ে ছোটটির বয়েস দেড় বছর। তবু ফের মঞ্জু পোয়াতী। তার যখন-তখন অবস্থা। যে কোনদিন ডেলিভারি হয়ে যেতে পারে। সবই আল্লার ইচ্ছা। মানুষের জন্মেও উপর কোন হাত নাই। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ এই তিনে কারোর হাত নাই। আল্লাপাক এই তিনটা জিনিস অনেক আগেই ঠিক করে রাখেন বান্দার জন্য। ইউনুস তাই দুঃশ্চিন্তা করতে গিয়েও চেপে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবে, মুখ দিছেন যিনি, আহার দিবেন তিনিÑআমি কে ভাবার? আল্লা ভরসা!

ইউনুস ফুটপাথে হাকারী করে। পুরোনো জামাকাপড় বেচে। তার ক্রেতারা মূলত রিকশাঅলা, ঠেলাঅলা, মুটেঅলারা। সে ছোট ব্যবসী। রোজগার অনুযায়ী সংসার বড় হয়ে গেছে। সংসার চালাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। বাজারে অনেক ঋণ হয়ে গেছে। তার একার রোজগারে এখন আর সংসার চলতে চায় না। তার পূঁজি কম। বলতে গেলে এখন পুঁজি ভেঙ্গেই খাচ্ছেন। এমতবস্থায় এক রাতেরবেলা মঞ্জু প্রথম কথাটা পারে।
তোমার রোজগারে তো আর সংসার চলতাছে না।
ইউনুস তেজ দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে বলে, তা আমি কি করুম!
তোমারে কিছু করতে হইবো না। খালি আমার একটা কথা শোন। মঞ্জু নরম হয়ে বলে।
ইউনুস একই রকম গোঁয়ারের মত পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে। কোন কথা বলে না।
মঞ্জু সাহস পেয়ে বলে, আমি ঠিক করছি শেফালিরে কাজে পাঠামু। আমি নিজেও…
ইউনুসের বিদুৎ স্পর্শের মত অবস্থা হয়। সে তড়াক করে উঠে বসে বিছানায়। চুলের মুঠি ধরে ঝাকায় বউরে।
শুয়োরের বাচ্চা! আমার ঘরে থাইকা বেলাইল্লাপনা দেখাবি! কাম করার নামে ব্যাটাগো লগে ঢলাঢলি করবি গিয়া?

কিন্তু ইউনুসের এই তেজ আজকাল কেমন জোর হারিয়ে ফেলছে। পুঁজি কমে গিয়ে ব্যবসা আরো ছোট হয়ে আসছে। এতগুলো মানুষের ভারনপোষন চালানোর মত টাকা এখন ব্যবসা থেকে আসে না। ছ’মাসে-এক বছরে বাসা ভাড়া বাড়ে নিয়ম করে। বাজারে হু হু করে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। একজনের আয়ে এখন আর সংসার চলতে চায় না।

ইমাম সাব দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, ঈমানী জোর রাখো মিয়া। তুমি আল্লার পরীক্ষার মধ্যে আছো। এইটা হইছে ঈমানী পরীক্ষা। আল্লাপাক নানা রকম পরীক্ষার মধ্যে বান্দারে ফেলেন। বান্দার উচিত সেই পরীক্ষায় পাস কইরা আল্লারে খুশি করা।
তখন দুপুরবেলা। জোহরের নামাজ শেষ। ইমাম সাব তার কামরায় বসে সুখি সুখি মুখে ইউনুসকে হালকা চালে ছবক দিচ্ছিলেন। তিনি আসলে খানার অপেক্ষায় বসে ছিলেন। ইমাম সাবের খানা আসে মসজিদ কমিটির তিন সদস্যের বাড়ি থেকে তিনবেলা । বড় টিফিনকেরিয়ার বাটিতে ভাত, সবজি, ভাজি, মুরগির মাংস, মাছের ঝোল, ডাল, শেষে কাঁচা আমের চাটনি। ইউনুসের মুখে জল এসে গেলো। এতগুলো পদ দিয়ে ইউনুস কোনকালেই খায়নি। ছেলেমেয়েগুলোর কপালেও ভালো কিছু কখনও জুটে না। এক কোরবানীর ঈদের সময় ছাড়া মাংস চোখে দেখে না। মঞ্জুর এই অবস্থায়ও ভালো কিছু ভাগ্যে জোটে না। দুপুরবেলা ইউনুস বাইরে খায়। বাড়ি থেকে সকালবেলা আটার রুটি নিয়ে আসে। সঙ্গে আলু ভাজি কি গুড়। বারো মাস এই খেয়েই তার পেট চলে।
ইমাম সাবের খানার কোন চিন্তা নেই। তার খানাও মাশাল্লাহ সব সময় ফাস্ট ক্লাস হয়। বড় হুজুর ওয়াজের সময় বলেন, আল্লাঅলা লোকের খানার অভাব হয় না। খানার চিন্তা তারা করে না। তারাদের খানা আল্লাপাক জোগার করে রাখে!

ইমাম সাব খানার ইন্তেজান শুরু করলেন। মসজিদের খাদেম এসে থালাবাটি এগিয়ে দিল। ইমাম সাব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এবার ইউনুসের উঠা উচিত। ইউনুস উঠে ইমাম সাবকে সালান দিয়ে বিদায় নেয়ার জন্য দাঁড়ালো। ইমাম সাব তার নূরানী চেহারায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, খানারত কাউরে সালাম দিবা না। খানা খাওয়া অবস্থায় সালামের উত্তর দেয়া যায় না। ইনশাল্লাহ, পরে কথা হবে।

ইউনুস ঝোলা গুছিয়ে বের হবার তোড়জোড় শুরু করে। মঞ্জু তার অসুস্থ শরীর নিয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে এই বিবেকহীন লোকটাকে নিরবে চেয়ে দেখতে থাকে। তার চোখে দুটো ক্রোধে জ্বল জ্বল করতে থাকে।
ঢাকায় তোমার কি কাম? মঞ্জু কোন মতে ক্ষোভ সম্বরম করে বলে।
ইসলাম দুশমনরা আল্লার রসূলরে নিয়া আকুতা-কুকতা কইতাছে হুনছ নাই?
কইছে তো তোমার কি? তুমি কি করবা?
কি কছ তুই! ইসলাম রক্ষা করতে হইবো না। এইটা আমার ঈমানী দায়িত্ব।
মঞ্জু স্থীর চোখে এই রোগা-পটকা লোকটির দিকে চেয়ে থাকে। ঘরে খাবার নেই। সমত্ত মেয়ের গায়ে কাপড় নেই। ভবিষ্যত অন্ধকার। আর সে যাচ্ছে ইসলাম রক্ষা করতে! ঘৃণা হলো মঞ্জুর। ইউনুস অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে ফেলল। মেয়েছেলের সামনে বেশি থাকাই বিপদ। সকালবেলা ঘর থেকে বের হওয়ার মুখে মেজাজটাই বিগড়ে দিলো। শয়তান মাইয়াছেলে! ইউনুস গজ গজ করতে করতে আর কোন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে পরল। সে এখন ইসলাম ছাড়া আর কোন কিছুই ভাববে না। এই দুনিয়া দুদিনের। সঙ্গে কিছুই যাবে না। যাবে শুধু আমল। দ্বিনের কাজ না করলে কি জবাব দিবে পরকালে?
স্টেশন এসে ইউনুস দেখে প্রায় সবাই এসে গেছে। ইমাম সাব সহ মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র। মুয়াজ্জিন, মালেক হাফেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়া এক ছাত্র। ঢাকায় এসে যখন পৌঁছল তখন মাথার উপর গনগনে সূর্য।

ইউনুসের মাথা ঘুরে গেলো! লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতা গগনবিদারী শ্লোগানে প্রকম্পপিত করছে চারপাশ নায়ারে তাকবির, আল্লাহো আকবর! ইউনুসের চোখে পানি এসে গেলো। ইসলামী জোশে তার বুকটা ফুলে আকাশে উঠে গেলো। এত্তো এত্তো লোক! আল্লার রসূলের অপমানের প্রতিশোধ নিতে আসছে। এরা সবাই মুজাহিদ। কালো মতন একটা ছেলে হাতে লাঠি নিয়ে চিৎকার করে বলছিল, আল্লার কসম! অগো যদি আমি হাতের কাছে পাইতাম, জব কইরা ফালাইতাম! রাস্তার মইধ্যে হালাইয়া আল্লার নামে (হাত দুটো জবাই করার মত অভিনয় করে) আল্লাহ আকবর!

ইউনুস একটু দাঁড়িয়েই বুঝল ‘বগার’ জবাই করার জন্যই ছোকরা পাগল হয়ে উঠেছে। ইউনুস নিজেও একটা ‘বগার’ পেলে ‘কাঁচা খেয়ে’ ফেলতো। একজন পাকা দাড়ির পাগড়ি মাথার মুরুব্বি বলল, কত্ত বড় সাহস, কয়, ঢাকা শহরের সব কয়টা মসজিদ পাবলিক টয়লেট বানানো উচিত!

উত্তেজিত জনতার মধ্যে থেকে একজন জানতে চাইলো কে বলেছে এমন কথা। তার ভাবটা এমন যেন নামটা বললেই সে ধরে নিয়ে আসবে এখানে।
পাকা দাড়ির মুরুব্বি ঘৃণার সঙ্গে বলল, ঐ নাস্তিক বগাররা! ইসলামের দুশমন বগাররা!
বোকা মত একজন ফস করে বলে ফেলল, কইছে যে ক্যামনে জানলেন? অর্থাৎ কোথায় দেখলেন বা পড়লেন জানতে চায় লোকটি।

পাকা দাড়ির মুরুব্বি প্রথমটায় খাবি খায়। কিন্তু চোখে-মুখে রুদ্রমূর্তিটা ধরে রাখে। প্রশ্নকর্তার দিকে সে লাল চোখে চেয়ে থাকে। চ্যাংড়া মতন একটা হুজুর চোখ পাকিয়ে লোকটাকে এবার বিদ্রুপ করতে থাকে, আপনে আছেন কোনহানে মিয়া! কোন খবর রাখেন না? আছেন কোনহানে? কি করছে অরা কিছুই জানেন না!

লোকটা থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। আর কিছু বলে না। পাকা দাড়ির মুরুব্বি এবার সামনে ভীড় করে থাকা জনতাকে জিকির করতে বলেন। জিকিরের ফজিলত কত সে সম্বন্ধে বয়ান দিলেন সংক্ষিপ্ত। বড় হুজুর এখনো মঞ্চে আসেননি। তিনি আসলেই জনতার উদ্দেশ্যে ভবিষ্যত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ইউনুস রাস্তায় বসে পড়ে জিকির শুরু করে দিলো। মুহূ মুহূ শ্লোগান আসছে জনতার মধ্য থেকে। ‘নাস্তিক ব্লগার ফাঁসি চাই!’ ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করো!’… ইউনুস গলা মেলালো জনতার সঙ্গে। তার আশে-পাশে সবাই বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্র-শিক্ষক। একদল মাদ্রাসার ছাত্র কোমরে পাঞ্জাবি গুটিয়ে গজারির লাঠি রাস্তায় ঠুকে ঠুকে কার প্রতি যেন ক্রোধ প্রকাশ করছে গালাগালি করে। ইউনুস উঠে সেখানে গেলো। মেতে উঠলো তাদের সঙ্গেও।

সারাদিন গিয়ে সাঁঝ নেমে এলো। রক্তিম হয়ে উঠলো পশ্চিম আকাশ। সাঙ্গ হলো সভা। এবার যার যার ডেরায় ফেরার পালা। ইউনুসের দলের লোকজন আজ থেকে যাবে ঢাকায়। স্থানীয় মাদ্রাসায় তাদের বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের অনুরোধে আজকের রাতটা তারা এখানে কাটিয়ে যাবে। ইউনুস অগাত্যা একাই বেরিয়ে পরলো। গাড়ি-ঘোড়ার সঙ্কট, অর্থকষ্ট, ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাকে অস্থির করে তুললো। বারবার সে নিজেকে বুঝিয়েছে বুঝিয়েছে এই কষ্ট, এই দুর্ভোগ আল্লার রাস্তায় সে ব্যয় করছে। পরকালে আল্লাপাক তাকে এর বিনিময়ে জান্নাত দিবেন! যে জান্নাত একটা ঠান্ডা ছায়াঘেরা বাগান। যেখানে শুধু আরাম আয়েশ। ভোগ-বিলাশ, মজাদার সব খানাদানা। ইউনুসের মুখ ভিজে এলো। তৃষ্ণাত্ব ইউনুস নানা রকম ফলের শরবত কল্পনার চোখে দেখতে পেলো। নানা রকম মজাদার খাবার সে চোখের সামনে দেখতে পেলো। একটা সবুজ ঘাসে মোড়ানো বাগানে নিজেকে আয়েশপূর্ণ জীবন কাটানোর সুখময় একটা ছবি দেখতে দেখতে সে ঘরের কাছে এসে যখন পৌঁছল তখন রাত বারোটা। অত রাতেও তার ঘরের বাইরে প্রতিবেশীদের দেখে হঠাৎ তার বুকটা ধক্ করে উঠলো। এত লোক কেন তার ঘরের বাইরে?
মোবারক নামের পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া ইউনুসকে আসতে দেখে এগিয়ে এসে সুসংবাদ দেবার মত করে স্বল্লাসে বলে উঠলো, মোল্লা, তোর মাইয়া হইছে রে , মিষ্টি খাওয়া!

মাইয়া! ফের … আরো একটা মুখ! তার ভারনপোষন। বিয়ে। দেখতে দেখতে মেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। কেমন করে সে এদের পার করবে, তার একার রোজগারে? একসঙ্গে ভাবনাগুলো এসে তার মাথায় ভীড় করে দাঁড়ালো।

ইউনুস ক্ষণকাল সব কিছু বিস্মৃত হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল সামনের দিকে। মঞ্জু আর শেফালীকে এবার আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না! সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে তার স্ত্রী-কন্যা তার শক্ত মুঠির মধ্য থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার কিছুই করার নেই। কিছুই না…।

লেখকঃ সুষুপ্ত পাঠক