শিল্পকলা ও অর্থনীতিঃ শেকলে আবদ্ধ সৃজন

লিখেছেন: শাঈখ বনি

প্রাণী হিসেবে মানুষ বেশ অদ্ভুত। সে বারবার চেষ্টা করে নিজের অন্তর্গত চেতনা ও স্বপ্নকে প্রকাশ করতে, জোর গলায় চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সবাইকে জানাতে। নিজের চেতনাকে প্রকাশের এই তীব্র আকাঙ্খা তার মাঝে সৃষ্টির তাড়না জাগায়, একসময় যে তাড়নাই জন্ম দিয়েছে চিত্রকলার, সঙ্গীতের, সাহিত্যের। এখন, এই তাড়না কি সবসময়ই প্রভাবকহীন নিরপেক্ষ তাড়না ছিল? এই তাড়নার ফসল শিল্পকলা কি সবসময়ই স্বাধীন ছিল, নাকি অদৃশ্য শেকলে তার হাত-পা বাঁধা ছিল সবসময়ই?

শিল্পকলা হল সমাজের দর্পণ। একটি সমাজের শিল্পকলা, সেই সমাজের বিভিন্ন অঙ্গকে ফুটিয়ে তোলে আমাদের সামনে, সেই সমাজের মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে তুলে ধরে, তাদের চিন্তাচেতনা-মানসিক উৎকর্ষ-সামাজিক সমস্যা—সবমিলিয়ে পুরো জীবনধারাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেজন্যেই বিলুপ্ত সভ্যতাগুলোর জীবনযাত্রার পরিচয় জানতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেই সভ্যতার শিল্পকলার উপর আলোকপাত করেন। এক হিসেবে, শিল্পকলা তার পীঠস্থানের সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। আর সেই সমাজ কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি। নিয়ন্ত্রণ করে, এটা বলার চেয়ে সম্ভবত এটা বলাই ভাল, যে অর্থনৈতিক কাঠামোতেই পুরো সমাজ গড়ে ওঠে, দাঁড়িয়ে থাকে। সমাজটাকে এখন আর মানবিক সম্পর্ক চালায় না, বাহ্যিকভাবে দেখতে গেলে অর্থনীতিই চালায়, খাওয়ায়-পড়ায়, বাঁচিয়ে রাখে। সুতরাং শিল্পকলা যেমন সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত, তেমনি অর্থনীতির সাথেও তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। যুগে যুগে সেই সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়েছে, শিল্পকলার উপর অর্থনীতির প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রভাব নিত্যনতুন শিল্পধারা জন্ম দিয়েছে কখনো, কখনো শিল্পের চাকাকে গতিশীল করেছে, কখনোবা রুদ্ধ করেছে তার উন্নয়নের পথ। যখনই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড়সড় পরিবর্তন এসেছে, তখনই শিল্পের মাধ্যম, বিষয়বস্তু, আঙ্গিকের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

শিল্পকলা বলতে আমরা এই লেখায় ‘আপাতত’ চিত্রশিল্প, ভাস্কর্যশিল্প, স্থাপত্যকলা অর্থাৎ দৃশ্যমান এবং প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত শিল্পকলার শাখাকেই বুঝব। শিল্পকলার আধুনিক সংজ্ঞায়নে শিল্পকর্মকে এখন আর আর শিল্পীর কারিগরী দক্ষতার নমুনা হিসেবে দেখা হয়না, যেমনটা দেখা হতো প্রাচীনকালে। বরং একটি শিল্পকর্ম হল তার স্রস্টার চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গী, তার মানসিক উৎকর্ষ আর সৃজনশীলতার সম্মিলন। শিল্পী তো আর বনজঙ্গলের প্রাণী না, সেও মানুষ। একজন শিল্পী যতোই খাপছাড়া জীবনযাপন করুক না কেন, সেও সমাজেরই একজন সদস্য। তাই তার চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধ, তার আকাঙ্ক্ষা সবই সমাজের বিদ্যমান অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর সমাজের সামগ্রিক অবস্থা তার অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। পুরো সমাজের চিন্তাধারাকে যখন অর্থনীতি প্রভাবিত করে, তখন সেই ‘প্রায়-দলছুট’ শিল্পীটাও বাদ পড়ে যান না। তিনিও গর্তে পা দেন অল্পবিস্তর, আর এভাবেই অর্থনীতি শিল্পকলাতেও নিঃশব্দে নিজের থাবা বিস্তার করে। যুগে যুগে এই প্রভাব কীভাবে শিল্পকলাকে প্রভাবিত করেছে, সেটাই আমরা আলোচনা করব এখানে।

প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রগুলোতে আমরা দেখি শিকারের ছবি, কী ক্ষীপ্রতা সেই ছবিগুলোতে! ছুটন্ত বাইসন আর পাথুরে অস্ত্র হাতে আদিম মানুষ, ছবিগুলোতে গতিময়তার অদ্ভুত প্রকাশ দেখি। এবং, ছবিগুলো দেখে আমরা এটাও বুঝে নেই, যে আদিম সমাজ ছিল পশুশিকারনির্ভর। স্পেনের আলতামিরা, ফ্রান্সের লাস্ক্যো কিংবা ভারতের অজন্তা-ইলোরা, সবগুলো গুহাচিত্রই রচিত হয়েছিল আদিম সমাজের ‘বর্বর’ সদস্যদের হাতে। সেই আদিম অর্থনীতি ছিল শিকারনির্ভর, তাই আদিম চিত্রকলাতে শিকারের ছবির এত প্রাধান্য। সমাজ, শিল্প, অর্থনীতি, সভ্যতা—সবারই তখন শৈশবকাল। এই শোইশবকাল আস্তে আস্তে কৈশোরের দিকে গড়াল, আর সেই পরিবর্তনটাও সূক্ষভাবে গুহাচিত্রগুলোতে ধরা পড়েছে। প্রাচীন প্রস্তর যুগের গুহাচিত্রতে যেখানে পশুর ছবি প্রাধান্য পেতো, নব্যপ্রস্তর যুগে প্রাধান্য পেতে লাগল দলবদ্ধ শিকারের ছবি। গোষ্ঠীপ্রথার উদ্ভব যে ততোদিনে ঘটে গেছে, তারই সাক্ষ্য হয়ে আছে ছবিগুলো। সমাজের বিকাশের ধারায় একসময় এল দাসভিত্তিক অর্থনীতি। মিশরীয় পিরামিডের গায়ে উৎকীর্ণ হাই রিলিফ, লো রিলিফ,সাঙ্কেন রিলিফগুলোতে আমরা সেইসময়ের দাসভিত্তিক অর্থনীতির রূপটা দেখলাম। সাধারণ মানুষ নিয়ে তখন কারো মাথাব্যথা ছিল না (এখনো সত্যি বলতে কারোরই মাথাব্যথা নেই), সব চিন্তা বরাদ্দ শুধু ফারাওয়ের ভোগবৃদ্ধির কাজে। ফারাও, পুরোহিত আর অভিজাতদের ব্যক্তিগত ভোগই তখনকার সমাজব্যবস্থার মূলধারা। মিশরীয় শিল্পকলাতেও তাই শুধু তাদেরই গুণগান দেখি, তাদের মৃত্যুপরবর্তী জীবন দেখি, আর দেখি তাদের ঈশ্বরতুল্যতা। সাধারণ মানুষ অথবা শিল্পীর নিজস্ব চেতনা?—স্রেফ অনুপস্থিত।

ধীরে ধীরে সমাজ বিকশিত হতে লাগল, রাজায় রাজায় অজস্র কাটাকাটি চলল, লক্ষকোটি উলুখাগড়ারও প্রাণান্ত হল। আর শিল্পকলা অনুগত পোষ্যের মত তাকে অনুসরণ করে গেল, শিল্পীদের নিজের চিন্তার কোন চিহ্নই আমরা খুঁজে পাবো না এতে। ফরাসী বিপ্লবের জনতা কর্তৃক রাজতন্ত্রের উৎখাত এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পরিণামে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ শিল্পকলার মোড়টাই ঘুরিয়ে দিল। বিশেষ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব, সাম্যের আকর্ষণীয় বক্তব্য শিল্পে এক ভিন্নরূপী রোম্যান্টিক চেতনার পরিস্ফুটন ও বিকাশে সাহায্য করল। তখন থেকে শিল্পে স্থান করে নিতে লাগল সাধারণ মানুষ। গুস্তাভ কুর্ব্যে, জ্যঁ ফ্রাঙ্কোয়া মিলে, অঁরে দমিয়্যের প্রমুখের হাত ধরে ইউরোপে যে রিয়ালিজমের জন্ম হল, তাতে সাধারণ মানুষ খুঁজে পেল নিজেদের কথা, অর্থনৈতিক শোষণে নিষ্পেষিত শ্রমিকদের কথা। রাজপরিবারের বিরক্তিকর পোর্ট্রেটগুলো আর ধর্মীয় কেচ্ছাকাহিনীর বিরক্তিকর দৃশ্যগুলো থেকে শিল্প মুক্তি পেলেও, শিল্পীর চিন্তা মুক্তি পেল না। এক প্রভুর দুয়ার থেকে আরেক প্রভুর দুয়ারে স্থানান্তরিত হল, এই যা। শিল্পকলার ইতিহাস তাই নিছক শৈল্পিক কৌশলের উন্নয়নের যাত্রা নয়, বরং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ইতিহাস, তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ইতিহাস।

অর্থকড়ি নামে একজন প্রভু আছেন, তিনি অনেকটা তেলাপোকার মতন। বিপ্লব হয়, প্রতিবিপ্লব হয়, সভ্যতা গড়ে, সভ্যতা ভাঙে, কিন্তু এই ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয়না, তিনি তেলাপোকার মত টিকে থাকেন। সব সমাজে, সব কালে, সব দেশেই তিনি পূজনীয়, সকল কিছুর মাঝেই ‘বিরাজমান’ । নিজের ঘিনঘিনে হাতটা তিনি সবকিছুর

ভেতরই ঢুকিয়ে রাখেন, শিল্পকলাও এর বাইরে নয়। শিল্পীকেও তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে। তাই তাকে খুঁজতে হবে ক্রেতা, যে শিল্পকর্মের বিনিময়ে তাকে অর্থপ্রভুর সান্নিধ্য দিবে। কোন মালিকই একজন মিস্ত্রীকে অপ্রয়োজনীয় শিল্পসৌকর্যপুর্ন বস্তু সৃষ্টির জন্যে পয়সা দিবে না। তার জানার দরকার নেই, এই কাঠের আলমারি শিল্পের মানবিচারে উৎকৃষ্ট নিদর্শন কি না, তার শুধু জানা দরকার ওতে কতটুকু কাপড়চোপড় আঁটে। শিল্পীও তাই একজন নগণ্য মিস্ত্রীর মতোই কাজ করে যান, তার শিল্পকর্ম এখন আর শুধুই তার চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং ক্রেতার প্রয়োজনকেও মাথায় রাখছে। অর্থাৎ, শিল্পকর্মকে শুধু উৎপাদকের অন্তর্গত তাড়নার ফসল হলেই চলবে না, বরং ভোক্তার চাহিদা ও প্রয়োজনের অংশ হয়ে উঠতে হবে। শিল্পীর অন্তর্গত স্বপ্ন ভোক্তার কাছে অপ্রয়োজনীয় ঠেকলে সেই স্বপ্ন আর বাস্তব আলোর মুখ দেখবে না, স্বপ্নীল চোখের স্বপ্ন হয়েই রয়ে যাবে। এটা কি শিল্পের বিকাশে একটা বিরাট বাধা নয়?

অর্থনৈতিক বিকাশের নানা স্তর পেড়িয়ে আমরা এখন উপনীত হয়েছি পুঁজিবাদে। এখন এই পুঁজিবাদ কীভাবে শিল্পকে প্রভাবিত করছে? এই প্রভাব ভালো, না মন্দ? মানুষের অর্থনৈতিক তৎপরতা, যেমন উৎপাদন, ভোগ ও বিনিময় সম্পর্ক অনেক পুরনো, কিন্তু বাজারনির্ভর অর্থনীতি অতীতে এতোটা প্রভাবশালী ছিল না। এখন পুরো অর্থনীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজারনির্ভর। অর্থনীতি তো অর্থনীতি-কোন নীতিই এখন আর বাজারের থাবার বাইরে নয়, তা হোক সেটা রাষ্ট্রনীতি, অথবা সমাজবিধি। অবার উপর এখন পণ্য সত্য, মুনাফা সত্য। আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতি জাতীয় গালভরা নাম দিয়ে যতই মহিমান্বিত করার চেষ্টা করি না কেন, সত্যি কথা হচ্ছে এখানে পণ্যের রাজত্ব চলে, মানুষের নয়। বাজার অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি অর্থনীতি যেটা বাজারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়, উৎপাদন যেখানে সম্পূর্ণরূপে বিক্রয়নির্ভর। বিক্রয়নির্ভর উৎপাদন মানে মুনাফার জন্যেই উৎপাদন, শখের জন্যে নয়, আত্মচেতনা প্রকাশের জন্যে নয়। মানুষের মেধা, তার সৃজনী অর্থশাস্ত্রের কাছে তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে যখন এগুলো মুনাফার খোরাক যোগাচ্ছে। একজন শিল্পী যখনই তার সৃজনীকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, তখনই অর্থনীতি তাকে গুরুত্ব দিয়েছে, নইলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে অন্ধকারে।পণ্যের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবেই এখানে শিল্পীর গুরুত্ব, নইলে সে গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয়। মানুষের যে ক্রিয়া, যে সৃষ্টিকর্ম পণ্য-অর্থনীতির সম্প্রসারণে সাহায্য করে না, নিজেকে বিরত রাখে মুনাফা উৎপাদকের ভূমিকা পালন থেকে, বাজার অর্থনীতি তাকে চোখ বন্ধ করে বর্জন করে। তার শিল্পমান, গভীরতা যা ইচ্ছে থাকুক, অন্ধ অর্থনীতি সেটা গোণায় ধরে না। মায়ের মমতা মানব অস্তিত্বের জন্যে অপরিহার্য, কিন্তু প্রচলিত অর্থনীতিতে তা র্যাাশনাল বিহেভিয়র নয়, কারণ এটা থেকে আসে না কোন মুনাফা, এটি না পারে নিজেকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে (অবশ্য মাদারস ডে জাতীয় ব্যাপারগুলো মাতৃত্বকে পণ্য হওয়ার বরকত নাযিল করেছে, বলেন মারহাবা ), না আছে এর বিনিময়মূল্য। তাই অর্থশাস্ত্র এর ভূমিকা বা প্রয়োজন নিয়ে চিন্তিত নয়। যেখানে মায়ের মমতাই নাম লেখাচ্ছে বর্জনের খাতায়, সেখানে শিল্পকলা টিকে থাকবে তার স্বকীয়তা সহ, এটা ভাবাই অবান্তর। তাকে অভিযোজিত হবে, পাল্টাতে হবে নিজেকে, পণ্য হয়ে উঠতে হবে, নিজের বিনিময়মূল্য বাড়াতে হবে। এবং হচ্ছেও তাই, শিল্পকলা নিজেকে পালটে ফেলেছে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, নিজেকে বাজারের উপযোগী করে তুলছে ; এই নতুন রূপে তার নান্দনিকতা ধ্বংস হলে হোক, বাজারের কাছে নন্দনের মূল্য নেই, দামাদামির কর্কশ ক্রন্দনের মূল্য আছে। শিল্পীর নন্দনসত্ত্বা আর বাজারের চাহিদা এখানে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে যেখানে শিল্পীর সত্ত্বার হাতে অস্ত্র বলতে কিছুই নেই, আর বাজারের আছে টিকে থাকার নিশ্চয়তা।
অর্থনীতি মানুষের সব কাজকেই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে, সেটা র্যালশনাল না ইর্যা শনাল তা যাচাই করে, তার উপযোগ দেখে, তার অপেক্ষমূল্য হিসেব করে। ভালোবাসা, যৌন সম্পর্কও এর আওতা বহির্ভূত নয়। শিল্পকলাও নয়। পূঁজিবাদী অবস্থায় আসতে আসতে শিল্পকলার অনেক পুরনো শৃঙ্খল শিথিল হয়েছে, অনেক শৃঙ্খল বিলুপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকলা মুখোমুখি হয়েছে নতুন সব শৃংখলের। পূঁজিবাদের চমৎকার উপহার হচ্ছে, এটি শিল্পকলাকে রাজদরবারের ক্ষুদ্র গণ্ডী থেকে টেনে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। একটা সময় শিল্পকলা ছিল রাজপরিবার, অভিজাত সম্প্রদায় আর ধর্মবণিকদের জন্যে, যারা স্বর্গের চমৎকার সব ছবি দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন হাড় জিরজিরে ক্ষুধার্ত মানুষকে। এখন শিল্পকলা চলে এসেছে সাধারণের উপভোগের জন্যে। কারণ, প্রাক-পূঁজিবাদী ব্যবস্থার মত সমাজের সীমিত অংশের জন্যে উৎপাদন আধুনিক পূঁজিবাদী ব্যবস্থায় অচল। এভাবে শিল্পকলা হয়তোবা একটি গণচরিত্র পেল, কিন্তু শিল্পকলা কী মুক্তি পেল শিকল থেকে ? বলা যেতে পারে, এক প্রভুর দরবার থেকে আরেক প্রভুর দরবারে হাজির হল, শিল্পকলা এখনো শৃংখলিত ভোক্তার চাহিদার শেকলে, শিল্পীসত্ত্বা এখনো প্রভাবিত বাজার দিয়ে। রাজার দরবার আর ধর্মগুরুর আশ্রম থেকে বেরিয়ে সে আরেকটি খাঁচায় উপস্থিত হল, যে খাঁচাটা আগের খাঁচার চেয়ে একটু বড়। এই খাঁচাতে অল্পবিস্তর ডানা হয়তো ঝাপটানো যায়, কিন্তু মুক্ত আকাশের স্বাদ তাতে পাওয়া যায় না। সৃজনশীল মানুষকে এখন চিন্তা করতে হয় পণ্য বিক্রির কথা। এখন ব্যক্তিগত বিনিয়োগ থাকে না, থাকে সামাজিক বিনিয়োগ। অসাধারণ শিল্পমান সম্পন্ন বস্তুও যদি বাজারের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই সেই খাত থেকে পূঁজি সরে যাবে, নিজের অবস্থান নিয়ে যাবে লাভজনক বিনিয়োগে। এভাবেই বিশুদ্ধ শিল্পকলা পৃষ্ঠপোষকতা হারাচ্ছে, অনুৎসাহিত হচ্ছে।

শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পকর্ম সংগ্রাহকের লাইনে প্রথম দিকে থাকেন চোরাই টাকার মালিকরা, বহুজাতিক পূঁজিপতিরা। শিল্পকলা নিয়ে তাদের কোন দর্শন নেই, শিল্পকলা জিনিসটা আসলে কোন বাগানের কলা সেটা নিয়ে তারা মাথাও ঘামান না। শুধু সমাজে নিজেকে রুচিশীল হিসেবে উপস্থাপন করাই তাদের লক্ষ্য। তাদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করাই বৃথা। আর সাধারণ জনগণ শিল্পদর্শন থেকে এতোটাই দূরে অবস্থান করেন যে, বিশুদ্ধ শিল্পকলাকে উৎসাহিতকরন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

তবে হ্যাঁ, বিশুদ্ধ শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা যে দুর্লভ, তা নয়। পূঁজির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চেতনার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সৃজনশীল কাজের একধরনের ক্ষেত্র তৈরি হয়, অন্যদিকে পূঁজি আর সৃজনশীলতার অন্তর্দ্বন্দের প্রতিফলনে আরেকটি পালটা পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেখানেই জনগণের চেতনা বিকশিত হয়েছে, সামাজিক আন্দোলন হয়েছে সেখানেই বিপরীত পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে আন্দোলিত দেশগুলোতে স্বাধীন শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছে, অল্প হলেও সেখানে শিল্প মুক্ত হতে পেরেছে পূঁজির শিকল থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে লাতিন আমেরিকার শিল্পকলার কথা। দেয়ালে আঁকা স্প্রে-পেইন্টের কথা বলা যেতে পারে, যেগুলো নিছকই শিল্পীর মনের চেতনাকে স্বাধীনভাবে প্রকাশের জন্যে নির্মিত, তার পেছনে বিপণনের সূক্ষতম উদ্দেশ্য ও নেই, বাজারকে সে গোণায় ধরে না।

আমাদের দেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হচ্ছে প্রায় অর্ধশতাব্দী হয়ে গেছে। অথচ, এখনো আমরা এখানে শিল্পকলার যথার্থ উন্মেষ ঘটাতে পারিনি, পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে। অন্যান্য দেশে তাও বিত্তবানরা শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেন অল্পবিস্তর, আমাদের দেশে সেটাও নেই। কেন? এ প্রসঙ্গে শিল্প সমালোচক কেনেথ ক্লার্কের একটা কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। উনি বলেছিলেন, “সমাজের বৃহত্তর অংশের সাথে শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক তখনই পাওয়া যেতে পারে, যদি জনগণের শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তির মান বা গ্রহণ করার ক্ষমতা একটি বিশেষ পর্যায় লাভ করে। কিংবা মানুষ যদি মনে করে যে, সংশ্লিষ্ট শিল্প তাদের নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।“ প্রাক-স্বাধীন বাংলাদেশে কৃত্রিমভাবে বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়েছিল।কিন্তু কৃত্রিম বিকাশ কখনোই সুস্থ বিকাশের বৈশিষ্ট্যাবলী বহন করে না, ফলে উদ্ভব ঘটেছিল সব পাতি-বুর্জোয়াদের, জ্ঞানের ক্ষেত্রে যারা ছিল বেশ পিছিয়ে পড়া, দূরদৃষ্টির যথেষ্ট অভাব যাদের রয়েছে, সর্বোপরি, যাদের রুচিশীলতার বিশেষ ঘাততি রয়েছে। ব্যক্তির মানসিক উন্নয়নের সাথে সমাজের সামষ্টিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই সমাজের নেতৃত্বের স্থলে যখন অনুকরণপ্রয়াসী রুচিহীন শ্রেণী বসে পড়ে, তখন পুরো সমাজেই তার বাজে প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, দেশের বিত্তবানরা রুচিশীল বাড়িতে থাকার চেয়ে বিশাল টাকা-পয়সা খরচ করে ছাদ অবধি ওয়াশরুমের টাইলস লাগানো বিদঘুটে ঘরে থাকতেই ভালোবাসেন। বিত্তের সাথে চিত্তের সংযোগ না হওয়ার ফসল।

পূঁজিই নিয়ন্ত্রণ করছে শিল্পকলার গতিপথ, আবার পূঁজিপতিদের রুচির অভাব সমাজে শিল্পকে অবহেলায় ঠেলে দিচ্ছে। শিল্পের নন্দন পাখিটা উড়তে চায়, কিন্তু আকাশ কোথায়? এক সময় তাকে বেঁধে রেখেছিল নৃপতি আর ধর্মযাজকের দল, এখন তাকে বেঁধে রেখেছে বাজার অর্থনীতির ইস্পাত শেকল। বারবার শেকল ভাঙার চেষ্টা করছে ছোট্ট সবুজ পাখিটা, কিন্তু শেকল কি আর ভাঙে এত সহজে?