সময়টা কতটা ভয়াবহভাবে কেটে যাচ্ছে সেটিরই যেন এক মহড়া হয়ে গেলো আজ। বলতেও কষ্ট হয়। মনে হয় এক ভয়াবহ সময়ে বেঁচে আছি পশুর মত। চারিদিকে শুধু আতংক আর আতংক। কি করব কিছুই বুঝতে পারিনা। কোথায় যাবো তাও বুঝে পাইনা। এই মৌলবাদীদের আতংকে ভালো মানুষো এখন সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছে।
স্ট্র্যাটফোর্ড থেকেই তরুনটিকে আমি লক্ষ্য করছি। তরুনটির মুখে দাড়ি। হাতে অনেক বড় একটা কালো ব্যাগ। অত্যন্ত অভব্যের মত আমি ছেলেটির দিকে কিছুক্ষণ পর পর তাকাই। ছেলেটিও আমাকে লক্ষ্য করলো খুব সম্ভবত। আমি তীব্র চেষ্টা করি চোখ ফিরিয়ে নিতে কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার চোখ চলে যায় ছেলেটির হাতে ধরা ব্যাগটির দিকে। আমি কল্পনার বীজ বুনতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে এই ব্যাগটি থেকে কিছুক্ষন পর ছেলেটি ইয়াবড় এক মেশিনগান বের করে গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলবে। আমি নিজের অজান্তেই প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠতে থাকি। সিদ্ধান্ত নেই ছেলেটি যে ট্রেনে উঠবে, আমি সেই ট্রেনে উঠব না। শেষ পর্যন্ত তা-ই করি।
পরের ট্রেনে উঠলাম। আমার হাতেও একটা কালো ব্যাগ। ভেতরে দু’টো বই। একটা নোট বুক আর আই প্যাড। জুবিলী লাইন ধরেছি। যাব সাউদার্ক। আমার সামনে বয়স্ক এক কাপল বসা। খুব সম্ভবত ইউরোপীয়। আমার দিকে এরা কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে। চকিতেই অনুধাবন করলাম আমার গালেও এক সপ্তাহ শেইভ না করবার দাড়ি জমে গেছে। আমার হাতে কালো ব্যাগ, মুখে দাড়ি। ভয়াবহ অস্বস্তি নিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে একটা বই চোখের সামনে তুলে ধরলাম। হুমায়ুন আজাদের ছাপ্পান হাজার বর্গ্মাইল। এবার আমি ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকাই। ঠিক বুঝতে পারিনা কিন্তু মনে হোলো এদের আতংক কেটে গেছে।
কিছুক্ষন আগে আমি যেই মিথ্যে আতংকে ভুগেছি স্ট্র্যাটফোর্ডের তরুনকে দেখে ঠিক আমাকে দেখে অন্য কেউ তেমন তীব্র আতংকে ভুগেছে। দু’টোর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, কষ্ট, বেদনা, হতাশা সব একই মনে হোলো। ইংল্যান্ডের শীতের একটা খর্বকায় দিন অথচ বাসায় ফিরে মনে হোলো যুগের পর যুগ গ্লানিতে ভুগে কুৎসিত এক সময় কাটিয়েছি।
ঘরে ফিরেই শেভ করেছি। রেজরে লেগে থাকা শেভিং ফোম, সেখানে লেগে থাকা ছোট ছোট দাড়ির কনা দেখে নিজেকে বড় বেশী অসহায় মনে হোলো। এমন অসহায় বোধ করা নতুন অভিজ্ঞতা নয় কিন্তু তারপরেও প্রতিটি ঘটনায় নতুন করে গ্লানিময় হয়ে উঠবার কিংবা অসহায় হয়ে উঠবার মধ্যে যেন কোথায় একটা আর্তনাদ রয়েছে।
হাউজমেটকে ফোন দিলাম কাজ থেকে কখন ফিরবে জানতে। ফোন না ধরাতে আতংকিত হলাম। অকারনেই ৫ বার ফোন করে হাউজমেটকে আতংকিত করে দিলাম। চট করে আবারো কল্পনার ডালপালা গজালো। ট্রেনে কেউ বোম মারেনি তো? গুলি করেনি তো?
হাউজমেট আমাকে ফোন দিলো প্রচন্ড ভয়ার্ত কন্ঠে। “কি হয়েছে? কোনো বিপদ?”, হাউজমেট এর উৎকন্ঠিত কন্ঠ ভেসে আসে ইথারে। দু’জন দু’জনকে বেঁচে থাকবার আর ভালো থাকবার সংবাদ জানাই। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হলো, যাক বাবা আজকের দিনের জন্য বেঁচে থাকলাম।
কি এক জীবন ওরা আমাদের দিয়ে দিয়েছে। রাজনীতি, ধর্ম, বিশ্বাস, অবিশ্বাস…সব কিছু আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আমরা এখন অন্যদের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি, অন্যরা আমাদের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে…
এমন মানবজীবন ক্লান্ত লাগে…ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে…