একটা মানুষের মূলত পরাজয় হয় কখন? কখন একটা মানুষ আসলে নৈতিক ভাবে হেরে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আদতে কঠিন মনে হলেও ইদানীং নানা অভিজ্ঞতায় আমি সেসব বুঝতে পারি। অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে গত বেশ কিছুদিন ধরেই আমি আওয়ামীলীগ সরকারের ভেতর নানা কন্ট্রাডিকশান ফেসবুকের মাধ্যমে তুলে ধরেছি। আমি দেখিয়েছি কি করে খোদ প্রধানমন্ত্রী একজন কুখ্যাত রাজাকারের হাত থেকে [ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান] অনুদানের অর্থ নিচ্ছেন, কি করে রাজাকার পরিবারের সাথে সম্পর্ক করে সেই রাজাকারের সাথে টু শব্দ পর্যন্ত হচ্ছেনা [শেখ সেলিমের বেয়াই]। কিন্তু আবার অপরদিকে এই আওয়ামীলীগ সরকার একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমি কাদের মোল্লার ফাঁসীর সময়কার ভূমিকার জন্য আজও তাঁকে লৌহ মানবী বলি। সারাটাজীবনই হয়ত বলব এই পার্টিকুলার ভূমিকার জন্য। কিন্তু আজ যদি কাদের মোল্লার মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হোতো আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী কোনো মন্ত্রীর মেয়ে বা ছেলের সাথে কিংবা এসব বাদ দিলে যদি আজকে কাদের মোল্লা একাত্তরের পর পর আওয়ামীলীগে যোগদান করে আজকে সাচ্চা আওয়ামীলীগে পরিনত হোতো, তবে কি তার বিচার হোতো?
আজকে কেন এই প্রশ্ন করছি? কেন আমাকে আজকে হঠাৎ করে এইসব প্রশ্নগুলোর মুখে নিজেই নিজেকে সমর্পিত করছি? অনেকের হয়তবা এই কথাগুলো ভালো লাগবে না। কষ্ট লাগবে। কিন্তু কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে। বাংলাদেশ আমাকে জন্ম দিয়েছে। এই দেশের সন্তান আমি। বাংলাদেশ আমার ঠিকানা। আজকে চোখের সামনে যে অন্যায় অত্যাচার দেখছি এটা মেনে নেয়া অসম্ভব। খান এ সবুর, শাহ আজিজদের মত বড় বড় রাজাকারদের কেন ১৯৭৩ এর সাধারন ক্ষমার ফলে বের হয়ে যেতে দেয়া হয়েছিলো এটা আমার বরাবরের প্রশ্ন ছিলো। দীর্ঘদিন আমি এগুলো নিয়ে চুপ থেকেছি স্ট্র্যাটেজিক কারনে। কিন্তু আজ যখন এই ঘাতকদের বিচারের এই অবস্থা দেখি তখন মনে হয় সব কিছু ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমার সব স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে। আমরা চেয়েছিলাম প্রতিটি অপরাধীদের বিচার। আজকে আওয়ামীলীগের নেতাদের সাথে সম্পর্কিত বা দলের সাথে সম্পর্কিত রয়েছেন কিন্তু একাত্তরে রাজাকার ছিলো এমন কাউকেই আনা হয়নি। একজনকে আনা হয়েছে অবশ্য ব্রাক্ষনবাড়িয়ার এক সাবেক আওয়ামীলীগ নেতা ইয়াকুবকে। তাও সেখানে ঝামেলা আছে। এই নেতাকে দল থেকে বহিঃষ্কার করা হয়েছিলো।
সরকারের নাকের ডগার উপর দিয়ে বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে গেলো, সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ইব্রাহিম কুট্টির হত্যা অভিযোগ আনা হয়েছিলো সেটির গুরুত্বপূর্ণ নথি বিবাদী হাজির করতে পারলেও রাষ্ট্রপক্ষ আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত খোদ এটর্নী জেনারেলকে বাধ্য হয়ে পিরোজপুরে যেতে হয়েছে। কিন্তু ততদিনে গায়েব হয়ে গেছে সব কাগজ। সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারকে রাতের আঁধারে খুন করে গেলো ঘাতক। সরকার শেষ পর্যন্ত কি করেছে? কি তার আপডেট? সাকার বিরুদ্ধে আসা সাক্ষী ওয়াহিদুল হক জুনু খুন হোলো। সেটার কি বিচার হয়েছে? কি তার আপডেট? যে সরকার বিচার করছে তার আমলেই সাক্ষীকে মেরে কেটে তক্তা বানানো হচ্ছে কিন্তু সরকার কোনো স্টেপ নিচ্ছেনা।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করে ইংল্যান্ডের ডেইলী টাইমসে সরকার তার গুনকীর্তন করে ক্রোড় পত্র প্রকাশ করেছিলো বহিঃর্বিশ্বে তার নাম ফাটাবার জন্য অথচ এই ট্রাইবুনালকে কেন্দ্র করে একটা পি আর ফার্ম নিয়োগ দিতে পারেনি, একটা লবিইস্ট নিয়োগ দিতে পারেনি এই ট্রাইবুনালকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কথা বলবার জন্য। প্রতিটা পদে পদে সরকার ব্যার্থ হয়েছে। আর এসব কারনেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে যে এই বিচার স্বচ্ছ না, নিরপেক্ষ না, আন্তর্জাতিক মানের না। এই ডাহা মিথ্যে কথা আমাদের হজম করতে হয়েছে শুনতে হয়েছে সরকারের ব্যার্থতার জন্য।
শেখ সেলিমের আপন বেয়াই মুসা বিন শমশেরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে একাত্তরের ভূমিকার জন্য। আমরা সবাই তা জানি কিন্তু আদালতে তা প্রমাণিত নয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য আজকে এত বছরে এই ব্যাক্তির নামে তদন্ত করা দূরের কথা সামান্য কথাও বলেনি সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা। অথচ এখন খবর পেলাম এই লোক পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করছে। আমরা কি তাহলে এমন একজন ব্যাক্তির অর্থে পদ্মা সেতু চেয়েছিলাম? আমরা কি এই আওয়ামীলীগ সরকার চেয়েছিলাম?
এই ট্রাইবুনালে প্রসিকিউটরদের মধ্যে তীব্র কোন্দল চলছে। একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে। নিজামীর মত একজন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে খোদ রাষ্ট্রপক্ষ বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগই আনেনি। ট্রাইবুনাল-১ চেয়ারম্যানের অভাবে বন্ধ ছিলো দেড় মাস!! আইনজীবিরা বার বার তাদের নিরাপত্তার কথা বলেছেন, বলেছেন ভালো কম্পিউটার দেবার কথা, ভালো সুযোগ সুবিধার কথা। কিন্তু কিছু দেয়া হয়েছে কি? সাঈদীর মামলা যে আইনজীবি পরিচালনা করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের, তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি আসামীর সাথে আঁতাত করেছেন, অর্থ খেয়েছেন। এগুলো সবই অভিযোগ। প্রমাণিত নয় কিছুই। কিন্তু সরকার কি সেটি খতিয়ে দেখেছেন?
আপীলেট ডিভিশনের একজন বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া এক একটা রায় লিখতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নিচ্ছেন, কেন নিচ্ছেন? তাঁর কাজের প্রেশার কি খুব বেশী? তিনি যাতে দ্রুত তাঁর নিজস্ব বিচার বুদ্ধিতে দ্রুত রায় দিতে পারেন কিংবা তাঁর উপর অন্য মামলার প্রেশার না দিয়ে এইদিকেই যাতে তিনি মনোযোগ দিতে পারেন এই ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি? আপীলেট ডিভিশানে ৬০ দিনে মামলা নিষ্পত্তি হবার আইন থাকলেও কেন সেটি বছরে গড়িয়ে যাচ্ছে এটার উত্তর আমরা আজও পাইনি। আপীলেট ডিভিশানে আরো বিচারপতি যদি নিয়োগ দিতে হয় কাজের চাপ কমাবার জন্য, সেদিকে কি সরকার নজর দিয়েছে? আমরা উত্তর পাইনি কিছুরই।
রায়ে অসন্তোষ তৈরী হলে জনতা প্রতিবাদ করবে, তারা সঠিক বিচার চাইবে। কিন্তু আদতে কি হয়েছে? গণজাগরন মঞ্চের ছেলে মেয়েদের উপর সরকার গরম পানি মারলো, পেটালো। কেন? এর কারন কি? আজকে যদি সরকারের শেষ সময় হয় এবং জনতা আবারো শাহবাগে গিয়ে ফুঁসে উঠে আমি নিশ্চিত এই সরকার আবার সেই আন্দোলন প্রমোট করবে নিজেদের স্বার্থে। আওয়ামীলীগ সরকার অনেক ভালো কাজ হয়তো করে, কিন্তু সেটা করে পানি ঘোলা করে আর পুরো ব্যাপারটার আনাচে কানাচে রাজনীতির লাভ ক্ষতির বিচারেই।
এইসব হতাশা, বেদনা নিয়ে লিখলেই অনলাইনী আওয়ামীলীগ নামধারী কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। অশ্রাব্য, নোংরা, কুরুচিপূর্ণ ভাষায় তারা আক্রমন করে। এরা মনে করে অনলাইন তার বাবার কেনার সম্পত্তি। এদের ধারনা বউ-বাচ্চা নিয়ে দুইটা ছবি দিয়ে নোংরামি করলেই আমরা থেমে যাবো, বন্ধ করে দিব সত্য কথা। এরা এতই ভয়াবহ যে ওপেন ভয় দেখায় যে দেশে ফিরলে ৫৭ ধারায় ঢুকিয়ে দেবে। তাহলে কি ৫৭ ধারা কি আওয়ামীলীগের নির্যাতনের প্রধান হাতিয়ার এখন? অস্ট্রেলিয়া থেকে এক ব্যাক্তি শুধু হায়েনা লিখে পোস্ট দিয়েছিলো। আওয়ামীলীগের এক কর্মী মামলা করলেন এই বলে যে, হায়েনা বলতে ওই ব্যাক্তি হাসিনাকে বুঝিয়েছে। ব্যাস হয়ে গেলো তার কয়েক বছরের জেল। অথচ আওয়ামীলীগের কিছু অসভ্য অনলাইন পান্ডা এই অনলাইন পৃথিবীকে নোংরাময় করে তুলছে, মানুষকে দিন রাত উত্যক্ত করছে সেটিতে কোনো পদক্ষেপ নেই। আওয়ামীলীগ যেন পুরো বাংলাদেশটাকে নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি করে ফেলেছে আজকে। আমরা কি মধ্যযুগে বাস করি?
ওই যে উপরে প্রশ্ন করেছিলাম যে একজন মানুষের নৈতিক পরাজয় কখন হয়? আজকে তার উত্তর আমি জানি। যখন কোনো মানুষ আরেক মানুষের ব্যাক্তিতের কাছে, তার সুনাম, খ্যাতি কিংবা যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে ব্যাক্তিগত আক্রমন করে তখন তার নৈতিক পরাজয় ঘটে।
আমি না হয় ইংল্যান্ডে থাকি, এখানে ১০ বছর পার করবার সুবাদে সেটেলড হয়েছি। আমার ছেলে ব্রিটিশ নাগরিক। আমরা না হয় দেশে না গেলেই চলবে। না হয় দেশে গেলাম না এই সরকারের ভয়ে। কিন্তু যারা বাংলাদেশে বাস করে তাদের কি হবে? ইংল্যান্ডে থেকেই যেই আক্রমণের স্বীকার হচ্ছি, তাহলে দেশে যারা থাকে তারা কি করে বেঁচে আছেন?
ভাবতেই শিউরে উঠছি…