তারা যে হাজার হাজার টুপি দাড়িঅলার মিছিল দেখেই ভয় পেয়েছে তা নয়। হাজার হাজার কন্ঠে নারায়ে তাকবির আল্লাহো আকবর ধ্বনির অর্থ তারা জানে। এই ধ্বনি বাংলাদেশী বৌদ্ধরা ঘরপোড়া গরুর মতই রামু ঘটনা ভেবে আঁতকে উঠে। কিন্তু এসবও ততখানি তাদের ভীত করেনি যতটা করেছে এদেশের ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভদ্রজনরা। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভাল করেই জানে এদেশের ‘অসাম্প্রদায়িকতার’ গোড়ায় একটু গভীর চাড় দিলেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘৃণা অবিশ্বাস আর বিভক্তি বেরিয়ে পড়ে।
এই কথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাংবাদিক, অধ্যাপক, লেখক, কবি, সংস্কৃতিজীবী, নাস্তিক, সংশয়বাদী সবাই এখন আঙ্গুল তুলেছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর। মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গাকে এরাও ইসলামপন্থিদের মত ধর্মীয় দাঙ্গা হিসেবে প্রচার করছে। এই প্রচার দেশের বৌদ্ধদের মধ্যে কী ভীতির জন্ম দিয়েছে সেটা বুঝা যায় সংঘরাজ ভিক্ষু সত্যপ্রিয় মোহাথেরোর কথাতে। তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমার বৌদ্ধ রাষ্ট্র হলেও দুই দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই’।
দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবাজদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণাতেই দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় বাধ্য হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম এবং সম্প্রদায়কে ডিফেন্স করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ বৌদ্ধ ফেডারেশনের সভাপতি অসিম রঞ্জন বড়ুয়া বলেছেন, ‘মিয়ানমার সরকার যা করছে তা বৌদ্ধ ধর্মে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’। বাংলাদেশ বৌদ্ধ ক্রিস্টি প্রচার সংঘের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট পি আর বড়ুয়া মিয়ানমারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, গৌতম বুদ্ধের অহিংস শিক্ষাকে মেনে চলুন…। ইসলামপন্থিদের পক্ষে বাংলাদেশে কোন কাফের জনগোষ্ঠিকে ধর্মীয় কারণেই সহ্য করার কথা নয়। ইসলামের সমস্ত ফিকরাই একমত যে মুসলমানদের দেশে কোন পৌত্তলিকের বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তবে আহলে হাদিস হলে তারা জিজিয়া কর দিয়ে নতমস্তকে বাস করতে পারবে। বাংলাদেশে কাগজে কলমে ইসলামী খিলাফত নেই।
মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানেও খিলাফত ঘোষিত হয়নি। পুরোপুরি ইসলামী শাসনে কোন সুস্থ মানুষই সহ্য করতে পারে না। মুসলমানরাও এটা ভাল করে জানে। যে কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও আধুনিক জীবনাযাপনে অভ্যস্থরা কখনই শরীয়া শাসন চায় না। তারা তখন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শাসন চায়। ৯৯ বা ৯০ শতাংশ কোন মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মুসলমানরা সেক্যুলারিজম চায় কাদের জন্য? এটা চায় তারা ইসলাম থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। পাকিস্তানের রূপকারদের মধ্যে যারা পরে প্রগতিশীল বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন তারাও নিজেদের জন্যই সেক্যুলার রাষ্ট্র চেয়েছিলো। অমুসলিমদের কথা ভেবে তারা সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করেনি। সেটা করলে তো তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয়ে পৃথক দেশ চাইত না।
এই ‘সেুক্যলারদের’ সঙ্গে ফান্ডামেন্টালিস্টদের বিরোধ ইসলামী শাসন নিয়ে। আহমদ ছফা এদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে প্যান ইসলামিজমকে তো নিজের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে নিয়েছিলেন। তার ভারত বিরোধীতা ছিলো হিন্দু বিরোধীতার বর্হিপ্রকাশ। বদরুদ্দিন উমারের কথাই ধরেন, তিনি তো ইসলামপন্থি নন। কিন্তু তার হিন্দু বিরোধীতার কারণ না বুঝতে পারার কথা নয়। দেশে লাগাতার মন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাংচুর, হিন্দু সম্পত্তি ক্ষমতার জোরে দখল, নাসিরনগরের হামলার পর এই কমিউনিস্ট নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে তো থাকলেনই না উল্টে দেশে কোন হিন্দু নির্যাতন ঘটে না বলে দাবী করে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, কিন্তু এক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হচ্ছে, মুসলমানরা অনেক অধিক সংখ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি নিহত হলেও কেউ বলে না যে, মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। কিন্তু কোনো হিন্দু এভাবে নির্যাতনের শিকার হলেই কিছু লোক সমস্বরে বলতে থাকে, ‘হিন্দুদের’ ওপর নির্যাতন হচ্ছে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নির্যাতন হিন্দু বলে হচ্ছে না’।
উমার তার লেখায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেটা এরকম, ধরুন ঢাকা শহরে এক মাসে ৩০০ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসেবে মুসলমানরা ৯০ শতাংশ। কাজেই দেখা যাবে ছিনতাইয়ের ৯০ ভাগই ঘটছে মুসলমানদের উপর। বাকী দশভাগে হিন্দু বড়জোর ৪ শতাংশ। এতেই প্রমাণিত হলো এদেশে কোন ধর্মের মানুষ বেশি ছিনতাইয়ের শিকার- অবশ্যই মুসলমানরা! এরকম ইতর টাইপ ব্যাখ্যা একজন পন্ডিত ব্যক্তি যখন দিবেন, কোন সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার সম্প্রদায়ের প্রেক্ষাপটে- তখন বুঝতে হবে তার ঐ সম্প্রদায়ের প্রতি আজন্ম কোন ক্ষোভ আছে। উমারের কথা অনুসারে ধরলে তো পৃথিবীর কোথাও কোন সম্প্রদায়িক সমস্যা নেই। ক্ষেত্রে কিন্তু উমার আবার ১৮০ ডিগ্রী পল্টি মারেন তড়িৎ! ভারতের কাস্মির, ফিলিস্তিনী, রোহিঙ্গা ইস্যু আবার উনার কাছে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন। এখানে ‘মুসলমানরা নির্যাতিত’ হচ্ছে!
বাংলাদেশের আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন এদেশের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ সার্টিফিকেট তাদেরই আছে এবং এই সার্টিফিকেট তারাই লোকজনকে দেয়ার অধিকার রাখেন। দেশ বিভাগের পরই এই উপমহাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ নামের এক সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। আর এর পুরো ফয়দা লুটে ভারতের কংগ্রেস আর বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। ৬ দফার পরই এদেশের হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে তাদের বন্ধু করে নেয়। তারা মনে করে আওয়ামী লীগ তাদের এদেশে সত্যিকারের সমান অধিকার দিবে। আওয়ামী লীগও মনে করে দেশভাগের মাধ্যমে বাঙালী হিন্দুর মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। হিন্দুরা কোনদিনই এদেশে মুসলমানদের প্রতিদ্বন্দ্বি হতে পারবে না। কাজেই পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের ভোট নিয়ে বিনিময়ে তাদের নিরাপত্তা দিলে ক্ষতি নেই। এদেশের রাজা উজির হলে হবে মুসলমানরাই।
সেই লক্ষেই পাকিস্তান তৈরি হয়েছিলো। ষাটের দশকের প্রগিতশীলতার আন্দোলন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের কথা ভেবে করা হয়নি। এটা মুসলমানরা ইসলামের প্রগতি বিরোধী শরীয়া শাসন থেকে নিজেদের বাঁচাতেই করেছিলো। ৬৫ সালে ভারতের দালাল বলে বাংলাদেশ থেকে খেদিয়ে দেয়া হিন্দুদের স্বাধীন বাংলাদেশে স্থান হবে না বলে বিশিষ্ট আওয়ামী বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এমআর আখতার মুকুল সেই ৭১ সালেই কোলকাতাতে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্নটা হলো, ৬৫ সালে প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগকারীদের পরিচয় যদি মুসলমান হতো তাহলে কি মুকুল এই সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন? কোটি টাকার প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। যাক বাদ দেন, ৪৬ বছর আগের কথা।
লীগ আমলে দেশের রেকর্ড সংখ্যালঘু নিপীড়নের সময় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক স্যার মুনতাসির মামুনের বক্তব্য কি আপনাদের এখনো শ্মরণ আছে? তিনি হিন্দুদের দেশত্যাগ সম্পর্কে বলেছিলেন তাদের দেশপ্রেম নেই আর ভারতে তার স্বধর্মীয় মুসলিম ভাইদের প্রবল দেশপ্রেমের কারণেই তারা ভারত ত্যাগ করে না বাংলাদেশ থেকে অনেক ভয়াবহ নিপীড়ন সহ্য করেও। অসাম্প্রদায়িক মামুন স্যার জনকন্ঠে লিখেছিলেন,’…অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে (পাঞ্জাবের কথা বাদ দিলে) ভারত থেকে মুসলমান খুব একটা আসেনি। এখন তো আসেনই না। তারা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের থেকে সেখানে ভাল আছেন? মোটেই না। অনেক ক্ষেত্রে খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। তবুও ‘মুসলমানদের দেশ’ বাংলাদেশে আসেন না কেননা, তারা ভারতকেই দেশ মনে করেন। তারা বাংলাদেশে সহায় সম্পত্তিও করেন না, ছেলেমেয়েও পাঠিয়ে দেন না। পার্থক্যটা কেন হচ্ছে, সেটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের বুঝতে হবে’।
মুনতাসির মামুনদের উত্তরসুরী ঐতিহাসিকরাই হয়ত এদেশে ইতিহাস লিখতে গিয়ে একসময় বলবেন, এদেশের হিন্দুরা ইন্ডিয়াতে চলে গেছে নিজেদের ইচ্ছাতে। বাংলাদেশের প্রতি তাদের কোন টান ছিলো না। হিন্দুরা ইন্ডিয়াকেই নিজেদের দেশ মনে করত। বাংলাদেশ থেকে চাকরিবাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকা-পয়সা ইন্ডিয়াতে রেখে আসত। তারপর এক সময় ইন্ডিয়াতেই চলে যেতো। এ কারণে বাংলাদেশে এখন আর কোন হিন্দু নেই…
এই রকম ইতিহাস খোদাই করে লিখে সঙ্গে মুনতাসির মামুন, বদরুদ্দিন উমার, সলিমুল্লাহ খান, মুন্নি সাহা, অপু উকিল, অঞ্জন রায়সহ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের অমৃত বচন গুচ্ছ- ‘বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এদেশে হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই হয়ে বসবাস করে আসছে। গুটিকয় স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা যাবে না’…ইত্যাদি ফুটনোট হিসেবে ব্যবহার করলে ভবিষ্যতের কোন ঐতিহাসিকের বাপের সাধ্য নাই খুঁজে বের করবে কি করণে এদেশের শেষ হিন্দুটি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।
প্রবারণা পূর্ণিমাতে ফানুস না উড়িয়ে, সেই টাকা রোহিঙ্গা ভাইদের দান করেও এদেশের মুসলমানদের কাছে কোন কাফের কোনদিন ভাই হতে পারবে না। ইসলাম ধর্মে পরিস্কার করে মুসলমানদের বিধর্মীদের শত্রু হিসেবে নিতে বলেছে। ইসলামের নবী বলেছেন, ‘ইহুদী ও নাসারাদের আমি অবশ্যই আরব থেকে বের করে দেব, এখানে মুসলিম ছাড়া কেউ থাকবে না (আবুদাউদ-৩০২০)। হযরত উমার তার নবীর নির্দেশ মেনে তার শাসনকালে নাজরান ও ফিদকের ইহুদীদের আরব ভূমি থেকে বহিস্কার করেছিলেন (আবুদাউদ-৩০২৪)।
পরম্পরায় মুসলমানদের এই রাষ্ট্রীয় প্রক্টিস সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে এখন প্রবাহিত। এমন একটা মুসলিম রাষ্ট্র নেই যেখানে অমুসলিমরা ভাল আছে। রাষ্ট্র যে ‘মুসলিম’ হয় এটা একমাত্র মুসলমান ছাড়া অন্য কারোর কনসেপ্টে নেই। মুসলিমরাই অন্যদের ‘অমুসলিম রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে। আরব রাষ্ট্রগুলোতে ইহুদী-খ্রিস্টানদের কোন নাগরিত্ব নেই। আরবের পৌত্তলিক আর ইহুদী-খ্রিস্টানরা সব গেলো কই? এখানেও আপনাকে একই ইতিহাস শোনাবে, ওরা সব স্বেচ্ছায় ইসলামের ছায়াতলে এসে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো।