রোহিঙ্গারা কি মানুষ নয়?

রোহিঙ্গারা যে মানুষ নয়, তাদেরকে ইতর প্রাণীর বিবেচনা দিয়ে দেখলে চলে- তাতো আমরা সবাই মিলে প্রমাণ করে ছেড়েছি। তাই গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বালিতে মুখ থুবড়ে পড়া রোহিঙ্গা শিশুটির জন্যে না কাঁদলেও চলে। বেঁচে থেকে বড় হলে হয় সে জেহাদী হতো নতুবা ড্রাগ ডিলার- মানুষকে ইতরীকরণের এই কার্যকর তত্ত্ব এখনো আপনাদের মাথায় ভালো করে ঢোকেনি দেখা যাচ্ছে!

রাখাইন রাজ্যের শীর্ষ এক কর্মকর্তা রোহিঙ্গা নারীদের উপর ধর্ষণ প্রসংগে জানতে চাওয়া হলে বলেছিলেন- এটা অসম্ভব, নোংরা রোহিঙ্গা নারীদের আমাদের সেনারা ধর্ষণ করতে পারে না। নিউইয়র্ক টাইমস এই খবর দিয়েছিল। আমি মায়ানমার প্রসংগে খুব কম জানি- তাই জানি না যে সেখানকার বোধসম্পন্ন মানুষেরা সেটার প্রতিবাদ করেছে কী না। তবে বাংলাদেশ প্রসংগে জানি- আমার মিছিলের প্রগতিশীল সাথী, আমার সংগ্রামের বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের ডি-হিউম্যানাইজ করেছেন দক্ষতার সাথে। গত কয়েক বছরে এইবার নিয়ে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা সংকট সামনে আসলেই টের পেয়েছি বিদ্বেষ এবং সংকীর্নতার বিষবাস্প কীভাবে কত অন্তরে নীরবে কাজ করে চলে। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন- আমি আশা করেছিলাম তারা অন্তত নিপীড়িতের ঐক্যের জায়গা থেকে বিষয়টি দেখতে পারবেন। কিন্তু তা না করে তাদের অনেকেই বরং তাদের টিকে থাকার সংগ্রামের বাইনারীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে স্থাপন করে একই কাজ করে গেছেন। জাতিরাষ্ট্রের ফাদ তারা এড়াতে পারেননি। আর এসবকিছুর ফলাফল- কোথাও ধর্মীয় ও জাতিগত বিশুদ্ধতার নামে আর কোথাও বা সীমান্ত ও শৃংখলার নামে মানুষ কোরবানি জায়েজ হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকার পাতায় অথবা সোশাল মিডিয়ায় রোহিঙ্গা সংক্রান্ত খবরগুলো না পড়ে থাকতে চেয়েছি। কত বিষ আর শরীরে নেয়া যায়? এদিকে নাসিরনগর আর গোবিন্দগঞ্জের বিষেই তো নীল হয়ে আছি! কিন্তু এর মধ্যে একদিন পত্রিকার পেছনের পাতায় নূর সাহার নামক এক নারীর শূন্য চাহনিতে চোখ গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। নূর তার ছয়বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন- আসার পথে ছয় সাতদিন ধরে জঙ্গলে ঘুরেছেন। ঘুরতে ঘুরতে জ্বরে পড়েছে ছেলেটি- এখানে এসে অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় পাওয়ার পরদিন ছেলেটি মরেছে। ছেলেটিকে যখন কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঠিক সেই সময়েই নূর সাহারার মুখের উপর ফটোগ্রাফারের ক্লিক পড়েছে। এরপরেও নূর বেঁচে থাকবেন- আট ফিট বাই বারো ফিট একটা ঘরে তার মত আরো পয়ত্রিশ জন নারীর সাথে।

মায়ানমারের নয়জন পুলিশ সদস্য খুন হওয়ার মধ্যে দিয়ে এবারকার ঘটনাক্রম শুরু হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের এক খবরে জানানো হয়- ওই ঘটনার আগেই মংডুতে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাড়িঘর ও স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করা হয়েছিল। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের বৈধ নাগরিক নয়, তাদের ভোটাধিকার নেই। বিয়ে করা বা সন্তান নেয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে তাদের চলাচল করা নিষেধ। আর এভাবে বেঁচে থাকার পরও একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্যে ক্লিনজিং করা হয়। এরপরেও তাদের অপরাধপ্রবণ বা জেহাদী না হওয়ার পেছনে কী যুক্তি আছে?

রোহিঙ্গাদের ক্লিনজিং অভিযানের পুরোধা বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা ভিরাথু মায়ানমারে জাতীয় বীরের মর্যাদা পান- অং সান সূচির এন এল ডির অনেক নেতাকর্মী ভিরাথুর মা বা থা আন্দোলনের সংগে সরাসরি যুক্ত। ভিরাথুর দলের আরেক শীর্ষস্থানীয় নেতা উ পামাউখা সম্প্রতি বলেছেন- ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতই আমরাও আমাদের দেশ ও ধর্মকে ইসলামের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে লড়ছি। যারা ভাবছেন- ব্যাপারটা শুধুমাত্র ইসলামই, তারা ঠিক ভাবছেন না। শ্রীলংকায় তামিল হিন্দুদের উপর ঘটে যাওয়া স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনায় সিংহলী জাতীয়তাবাদের মধ্যে উগ্র বুদ্ধিজমও মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাইলের পর মাইল তামিলদের হাজার হাজার বাড়িঘর এখন শ্রীলংকান সেনাবাহিনীর সম্পত্তি।

ক্ষমা করো প্রভু বুদ্ধ- তোমার নাম নিয়ে গণহত্যা চালানোর এই নির্জ্ঞান পৃথিবীতে এই কালে আমরাও বাস করি।