মুসলমানদের ঈদ আজও সংকীর্ণ

ইহুদীদের ঈদ ৬টি। ঈদুল ফেসাখ, ঈদুল মাতছ, ঈদুল খেমিশশিম, ঈদুল সুক্ক, ঈদুল হানাকা, ঈদুল ইয়ম কিপ্পু। এছাড়া মদিনাতে পৌত্তলিকদের নওরোজ এবং মিহিরজান নামের দুটি উৎসব মদিনাবাসীরা জাঁকজমকভাবে পালন করত। নবী মুহাম্মদ মদিনা যাবার পর এই উৎসবগুলো সম্পর্কে জানতে পারেন। বিশেষত ইহুদীদের ঈদ পালন করতে দেখে তিনি মুসলমানদের জন্য নতুন দুটি ঈদের প্রচলণ শুরু করেন ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার। ইহুদীরা পশু কুরবাণী করে আগেই একটি ঈদ উদযাপন করত ঈদুল ইয়ম কিপ্পু নামে। ঈদুল আজহার যে ইহুদীদের ইয়ম কিপ্পু থেকে ধার করা সেটা পরিস্কার। ইহুদীদের ঈদ উৎসব করতে দেখে মুহাম্মদ যে মুসলমানদের জন্য দুটি ঈদ চালু করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সহি হাদিসে (Ahmad ibn Hanbal, Musnad, vol. 4, 141–142, no. 13210) যেখানে মুহাম্মদ তার সাহাবীদের বলছেন মদিনার জাহেলিরা যা পালন করছেন তার চেয়ে বেটার কিছু আল্লাহ তাদের ঈদুল ফিরত আর আজহার মাধ্যমে দিয়েছেন…।

আরবদের নওরোজ বা মিহিরজানে সবাই অংশগ্রহণ করত। এমনকি প্রতিবেশী ইহুদীদের ঈদে পৌত্তলিকদের অংশ গ্রহণও বাধা ছিল না। মদিনার প্রথম যুগের মুসলমানদের এইসব অনুষ্ঠানে যোগদানে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন মুহাম্মদ। এমনকি তিনি মুসলমানদের ইহুদী কিংবা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় কিতাব পড়তে দেখলেও ভয় পেতেন। শুধু তাই নয়, কবি সাহিত্যিকদের বিষয়ে তিনি বিরক্ত ছিলেন। এটা নিয়ে পরবর্তীতে আলাদা একটা লেখা লিখব বলে আজ এ বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকছি। তো, মুসলমানরা যাতে অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে যোগদান না করে, তারা যাতে একটা ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনে না আসতে পারে তার জন্য মুহাম্মদ বিধর্মীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে প্লাণ মুহাম্মদের ছিল সেটা ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা থাকলে সম্ভব হতো না। মুসলমানদের মধ্যে ইহুদী-খ্রিস্টান পৌত্তলিকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ আনতে না পারলে সশস্ত্র জিহাদে মুসলমানদের আক্রশ জাগানো যাবে না। তাই দুই ঈদ প্রবর্তন করে মুহাম্মদ তার অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন, যে ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের আল্লাহ লানত (অভিশাপ) করেছেন তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা আল্লাহর আযাব ও গজব নাযিলের কারণ হতে পারে।(ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম ১/২০৭)।

মাজমুউল ফাতাওয়াতে বলা আছে, “মোদ্দাকথা, বিধর্মীদের উৎসবের নিদর্শন এমন কিছুতে অংশ নেয়া মুসলমানদের জন্য জায়েয নয়। বরং তাদের উৎসবের দিন মুসলমানদের নিকট অন্য সাধারণ দিনের মতই। মুসলমানেরা এ দিনটিকে কোনভাবে বিশেষত্ব দিবে না” (মাজমুউল ফাতাওয়া (২৯/১৯৩)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “খ্রিস্টানদের উৎসব বা ইহুদিদের উৎসব যেটা তাদের সাথে খাস এমন কোন উৎসবে কোন মুসলমান অংশ গ্রহণ করবে না” (তাশাব্বুহুল খাসিস বি আহলিল খামিস, মাজাল্লাতুল হিকমা (৪/১৯৩)। অথচ দেখা যাচ্ছে ইসলামের ঈদ উৎসবটাই ইহুদীদের কাছ থেকে ধার করা! ইহুদীদের ঈদ উৎসব কিন্তু তাওরাত অনুসারে পালন হচ্ছে না যে মুসলমানরা দাবী করবে এটা তাদের আল্লাহই মুসা নবীর কওমের জন্য ফরজ করেছিলেন যা পরবর্তীতে আল্লাহ মুসলমানদের জন্যও ঈদ দিয়েছেন। ইহুদীদের ঈদের কারণগুলো জানলেই দেখা যায় তাওরাত লেখার অনেক পরে ইহুদীরা নানা রকম সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আনন্দ উৎসব হিসেবে প্রচলণ করে।

পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো আজকের যুগে ধর্মীয় চেহারা হারিয়ে যেখানে সার্বজনীন হয়ে উঠছে সেখানে ঈদ এখনো চরম ধর্মীয় একটি উৎসব। আব্দুর নূর তুষার তো একবার নাস্তিকদের ঈদের সেমাই না খেতে ফতোয়া দিয়েছিলেন! আসলে তার মত শিক্ষিত মানুষের মনজগতও এরকম সংক্রীর্ণতা জুড়ে বসেছে উপরের হাদিস ও ফতোয়ার প্রভাবে। আজো মুসলিম সম্প্রদায় ভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে যোগদান করাকে তাদের জন্য হারাম মনে করে। এই মনে করার পিছনে কুরআন হাদিসের নির্দেশনাই দায়ী। এসব কারণে মুসলিম সমাজ ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য একটা বড় বাধা। পৃথিবীর দেড়শো কোটি মানুষ যদি মনের ভেতর এরকম অসম্প্রীতি জিইয়ে রাখে সেটা পৃথিবীর জন্য কোন ভাল খবর নয়। রমজান শুরুতে তথাকথিত অমুসলিম বিশ্ব মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ঈদের শুরুতেও একইভাবে শুভেচ্ছা জানাবে। আমরা কি কখনো সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র প্রধানদের বিশ্ববাসীকে খ্রিস্টমাস বা অন্যান্য ধর্মীয় দিবসে শুভেচ্ছা জানাতে দেখি? এত ছোট মন নিয়ে কি করে তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেন?