মুসলমানদের প্রার্থনা

বিশ্বজুড়ে কোথাও ঈদের মুনাজাতে মুসলিমরা বিশ্ববাসী তথা মানব জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কমনা করে আল্লার কাছে প্রার্থনা করেছে? করেনি। তারা পরিস্কার করে ‘বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি’ চেয়ে আল্লার কাছে প্রার্থনা করেছে। অথচ খ্রিস্টমাসে পোপ যে প্রার্থনার আয়োজন করে তাতে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ কামনা করা হয়। বৌদ্ধরা তাদের প্রার্থনায় ‘জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক’ বলে শেষ করে। হিন্দুরাও একইভাবে প্রার্থনা জানায়। জীবনে প্রথম যখন জেনে ছিলাম কোন অমুসলমানের জন্য দোয়া করা যাবে না তখন ভীষণ শর্টড হয়েছিলাম।

বাড়িতে হে হুজুর আমাদের আরবী পড়াতেন তিনিই বলেছিলেন হিন্দুদের সালাম দেয়া যাবে না, বড়জোর বলতে হবে আদাব। সালামের অর্থ ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’। হুজুরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম জুম্মার নামাজের শেষে মসজিদের হুজুর খালি মুসলমানদের কল্যাণ চান কেন? আমাদের আরবী পড়াতে আসা মাদ্রাসার সেই ছাত্র যে পুরোপুরি ইসলাম সম্মত কথাই বলেছিলেন সেটা পরবর্তীতে আমার ইসলাম নিয়ে জিজ্ঞাসার সূচনা পর্বেই জেনে ফেলেছিলাম। নবীজি তার নিজের মায়ের জন্যই দোয়া করেননি কারণ তার মা মুশরিক ছিলেন। সারা পৃথিবীতে তাই এমন কোন মুসলিম সমাজ পাওয়া যাবে না যেখানে কেবল মুসলিম উম্মাহ’র সুখ শান্তি কল্যাণ কামনা ছাড়াও বাকী বিশ্ববাসীদেরও কল্যাণ কামনা করা হয়…।

কাল থেকে ইনবক্সে অগুণতি মানুষ আমাকে ঈদ মোবারক জানিয়েছেন। একই সঙ্গে রথযাত্রার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এটি নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক পাঠ। এরকম সরল চিন্তা ত্যাগ করেছি বহুকাল আগেই। বরং সত্য এটাই যে এইসব ধর্মীয় উৎসব এলেই মানুষের মাঝে বড় করে ধর্মীয়ভাবে বিভেদের কথা মনে পড়ে যায়। এক সময় অসাম্প্রদায়িক সমাজের চেতনায় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে দুর্গা পুজাতে হৈ হল্লার করতাম। আবার ঈদের দিনে তাদের নিয়ে নানা আয়োজনে মাততাম। ধর্ম অবিশ্বাসী হয়েও আমার এই অংশগ্রহণ ছিল অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম। কিন্তু নিজের কাছেই ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল, যতই দুর্গা পুজার মন্ডবের সামনে চেয়ার নিয়ে পাঞ্জাবী পরে গোল হয়ে আড্ডায় দেই না কেন- শেষতক এই উৎসবের আমি এক বহিরাগতই। একইভাবে ঈদের উৎসবে যোগ দেয়া আমার হিন্দু বন্ধুও শেষতক ঈদের আমন্ত্রিত এক অতিথিই…। কিন্তু এই জিনিস কখনই পহেলা বৈশাখে অনুভব হয় না। কখনই অন্য কোন সেক্যুলার উৎসবে আমাদের ধর্মীয় পরিচয়টি সামনে এনে দাঁড় করায় না।

আজকে এক সিনিয়র সাহিত্যিকের ফেইসবুক পোস্ট পড়লাম। তিনি শ্লেষ করে বলছেন, রোজা রাখার নাম নেই এদিকে আছে শপিং করার ধুম। খাওয়া আর পরার আয়োজন। টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা- আসল ঈদের যে ম্যাসেজ তার কোন খবর নেই…। শেষটায় তিনি অভাবী গরবীরদের অনাহারী ঈদ প্রসঙ্গ যোগ না করলে পুরো পোস্টটা কোন মাওলানা মুফতির ফেইসবুক পোস্ট ছাড়া অন্য কিছু মনেই হতো না। আমি অনেকদিন আগেই সচেতনভাবে বাংলাদেশী লেখকদের লেখা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। যে লেখক এমন ধর্মীয় আলেমদের মত করে ঈদকে চিত্রিত করেন তাদের লেখা উপন্যাস গল্পের দর্শন যে কি চেহারা হতে পারে তা কি আর নতুন করে বলতে হবে? কোন ক্রিয়েটিভ লেখক কি প্রচলিত ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতে পারেন? তিনি কি বিশ্বাস করতে পারেন কেবল মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনাই করতে হবে নামাজ পড়তে গিয়ে? এমন লেখকের সাহিত্য দর্শন কি সর্ব মানবের উদ্দেশ্যে কখনই শান্তির কথা বলতে পারে?

মানুষের কল্যাণ কামনায় কিছুই হয় না। এমন কি অভিশাপ দিয়েও কোন জাতি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা যায় না। তবে আপনার প্রার্থনা দেখে আপনার ধর্মীয় দর্শনটা অনুমান করা যায়।