বিচারপতিদের অপসারণ বিষয়ে

সামনেই সুপ্রিমকোর্টে একটা রিটের রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে যা জাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার কাছে বিবেচিত হচ্ছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের আদেশ সোমবার ঘোষণা করবেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হচ্ছে সেই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান যারা আদালতের বিচারপতিদের বিভিন্ন কারণে অপসারণ এবং বরখাস্ত করতে পারতো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথাটি তুলে দিয়ে সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করে। এই পরিবর্তনের ফলে বিলুপ্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিচারপতি অপসারণের কাজটি সরাসরি জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত হয়, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়, যার রায় ২০১৬ সালের ৫মে সরকার কতৃক আনিত ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষনা করে।

এই রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুদ্ধ সরকারপক্ষ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং গত ৮ মে আপিলের শুনানি শুরু হয়। শুনানী শুরুর পূর্বে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই শুনানীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ‘অ্যামিক্যাস কিউরি’ নিয়োগ দেন। (অ্যামিক্যাস কিউরি হচ্ছে বিজ্ঞ এবং প্রবীন আইনজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টিম যারা আইনের বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরবেন। এক কথায় যাদেরকে প্রধান বিচারপতির “উপদেষ্টা বা পরামর্শক” হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।)

হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। আদালত বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সংসদ সদস্যদের সবসময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।’ অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ে সরকারকতৃক ষোড়শ সংশোধনীকে আদালতের স্বায়ত্বশাসনের বিরুদ্ধে একধরণের হুমকী হিসেবে দেখছেন।

আদালতে আপিলের শুনানিকালে অভিমতদাতা নিয়োগকৃত ১০ জন ‘অ্যামিক্যাস কিউরির’ মধ্যে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দিয়েছেন এবং বাকি নয় জন, অর্থাৎ ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে বা সরকারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অভিমত দেন।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গিয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিক্যাস কিউরিদের অভিমতের পাল্লা যেদিকে ভার হয়, রায়ও সেদিকেই যায়। যার প্রেক্ষিতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, সরকার কতৃক আনিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ হিসেবেই রায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার বাধ্য হবেন পূনরায় ষোড়শ সংশোধনী পরিবর্তণ করে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রথায় ফিরে যেতে, যা বাহাত্তরের সংবিধানের পরিপন্থি।

ফুটনোটঃ অ্যামিক্যাস কিউরিদের মধ্যে যারা সরকারের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে অভিমত দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একাধিক “বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা” রয়েছেন। তাঁদের এই “বিপক্ষ অভিমত প্রদাণ” কি স্ববিরোধীতা নয়? না-কি সরকারবিরোধীতা?