গল্পঃ টিস্যু

বাসায় আমি ছাড়া কেউ নেই, ঈদের আগের রাত থেকে। ছেলেরা চলে যাওয়ার আগে তাদের বিছানা ঠিক ঠাক করে রেখে যায় নি, বিছানার ওপর দুটো টিস্যু পড়ে ছিল ( এসি ছেড়ে বরফ ঠান্ডা করে ঘুমায়, চিরকালিন সর্দি )। বালিশের ডান পাশে। আমি চাদর টেনে ঠিক করে দিলাম কিন্তু টিস্যু দুটো ফেললাম না। ছেলেরা এসে ফেলুক ! সকালে উঠে দেখি টিস্যু দুটো বালিশের পাশ থেকে সরে গেছে । গুরুত্ব দিলাম না। বাতাসে হতে পারে ( যদিও ঘর বন্ধ ছিল )। তারপর সারাদিন ঘর বন্ধ, আমি বাইরে । সন্ধ্যার আগে ফিরে দেখি বিছানার চাদর এলোমেলো, টিস্যু দুটো একটু সরেছে মনে হল । এবারে অবাক লাগলো । রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে দেখি চাদর আরও একটু এলোমেলো, টিস্যু দুটো বিছানার মাঝ বরাবর । তারপর রোজ টিস্যুগুলি অবস্থান পরিবর্তন করছে। এখন টিস্যু দুটো আছে বাম পাশের নিচের দিকে।

দুটোর মাঝে খানিকটা তফাৎ আছে। বাসার পোষা বেড়াল ( জুম ) আগে সুযোগ পেলেই ঐ বিছানায় যেয়ে শুয়ে থাকত। পরশু জুমকে নিজেই টেনে ধরে ঐ বিছানায় শুইয়ে দিলাম । ও রাগে গরর গরর করছিল , চোখ দুটো বড় বড়, লেজ আর কান খাড়া। আমার হাতে কামড়ে দেয়ার চেস্টা করায় ছেড়ে দিলাম আর ওমনি ছুটে পালিয়ে গেল। কাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বিছানার দিকে তাকিয়ে টিস্যুর অবস্থান পরিবর্তন দেখেছি। রাতে শোবার সময় কি মনে হল , বিড়বিড় করে বললাম – এটা আমার ঘর। এখানে আমার অনুমতি ছাড়া কিছু করা ঠিক না । মনে হল পট পট করে শব্দ শুনলাম, যেন কেউ বুট ভাজা খাচ্ছে। আজ সকালে দেখি টিস্যু দুটো একসাথে , বিছানার মাঝ খানে, চাদরটা টেনে সুন্দর করে রাখা, দরজার পর্দা টেনে জানালার গ্রিলের মাঝে আটকে দেয়া। জুমকে সেদিনের পর থেকে আশে পাশে দেখা যাচ্ছে না, কতবার চেচিয়ে ডাকলাম ! এমন না এটা পোড়োবাড়ি।

এই বাড়ি একেবারে নতুন । ভাড়া একটু বেশি কিন্তু ৩ দিক খোলা, হু হু করে বাতাস , নীরব । আমরাই প্রথম ভাড়াটে । আগের বাসাটা পুরনো , কেমন গা ছম ছম করা ছিল। কিছু ঘরে দিনের বেলায় আলো জ্বালাতে হত । ওটা বিরাট বাসা ছিল। সে বাসাতেও এমন সমস্যা ছিল। সবাই ঈদের ছুটিতে গ্রামে চলে গেলে, আমি একা থাকতাম । একবার বেজায় জ্বর । বিছানা ছেড়ে ২ হাত দুরের টয়লেটে যেতে পারি না। পানির তেস্টায় বুক ফেটে যায় এমন অবস্থা। ঘোরের মধ্যে দেখি মানুষের মত আবার মানুষ নয়, কিছু একটা মেঝের ওপর দিয়ে ভেসে আসছে ( হাঁটছে না )। ওটার মুখ নেই, আমি বিছানায় গড়িয়ে অন্য দিকে চলে গেলাম – ও মা ! ওটা দেখি সেই দিকেই দাঁড়িয়ে ! তীব্র বিস্ময় আর আতংকে জ্বর ছেড়ে গেল। ঘেমে নেয়ে অস্থির । অনেকক্ষণ বসে ভাবার চেস্টা করলাম ।

নিজেকে বুঝ দিলাম – অসুস্থতার কারণে এসব ঘোর লেগেছে । কিন্তু সারাদিন ঘুরে ফিরে সেই অশরীরী আমার মন জুড়ে রইল । আমি কোনদিনও বিছানার পাশে পানির গ্লাস রাখি না বা বিছানায় পানি খাই না। বিছানায় বসে কিছু খাওয়া অসহ্য লাগে । কিন্তু মাঝ রাতে উঠে দেখি বিছানার পাশে পানির গ্লাস ! সকালে উঠে দেখি চুলার ওপর চায়ের পানি ! চুলা জ্বালানো হয় নি । বিড়বিড় করে বলেছিলাম – আগুনে ভয় নাকি ? মনে হল কেউ আমার মাথার ভিতরে উত্তর দিচ্ছে – আগুন লাগলে কেউ বাঁচবে না ! আগুনে সবার ভয় ! সেবারে ছেলেরা ফিরে আসার পর এই ভাইজানের গল্প বলেছিলাম। তারা বেশ মজা পেয়েছিল। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি ! মন দ্রুত নরম হয়ে যাচ্ছে !