একটা ‘অপ্রিয়’ বিষয় নিয়ে দুই চারটা কথা বলি। অপ্রিয়, কারন এই বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। বলতে চাইলে বলে, প্লিজ ধর্ম নিয়া কথা না বাড়ানোই ভালো।
ভারতের বিখ্যাত ‘বাবা’ গুরমিত রাম রহীম সিং! ১৫ বছর আগে তারই ডেরায় দুইজন ‘সাধ্বী’কে ধর্ষণ করার অপরাধে যার ১০ বছরের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। গত শুক্রবার তাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। এর পরপরই, ভারতের কয়েকটা রাজ্যে রীতিমত তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে।
‘বাবা’র শুভার্থীরা অন্তত ৩৮ জনকে হত্যা করেছে। ২০০ জনের বেশি মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। ভাঙচুর, আগুন লাগিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। আজ রায় ঘোষণার আগে, ভারতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ত্রিশ হাজার ‘ভক্ত’ বাবার ডেরায় আস্তানা গেড়েছে। এরা কি ঘটায় কে জানে?
গুরমিত সিংয়ের নাম আমি এর আগে কখনো শুনি নাই। অথচ সারা দুনিয়ায় তার নাকি ৬ কোটি ভক্ত! যার ডেরায় প্রতিদিনের আয় কোটি রুপির বেশি। ২০০ এর বেশি অত্যাধুনিক গাড়ি আছে। বাবার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকে কমপক্ষে ১৬টি গাড়ি। বিশাল এলাকাজুড়ে তার ডেরা। যেখানে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হতে পারে একসঙ্গে। কয়েকদিন আগে মিউজিক্যাল কার্নিভ্যাল নামে এক ‘শো’ হয়েছে; যেখানে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ একত্রিত হয়েছিল। ইউটিবে দেখতে পারেন। চোখ কপালে উঠে যাবে।
বাবা আবার বহু গুনে গুণান্বিত। অভিনেতা, শিল্পী, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক। তার অভিনীত ও নির্মিত সিনেমা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বাবা রংচঙা, দামি জামাকাপড় পরেন। ফলে কেউ কেউ তাকে ‘রকস্টার’ ডাকে।
তার ডেরায় আছে ২০০ এর বেশি ‘সাধ্বী’। যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যে। প্রত্যেকেই রূপবতী। এরা সবাই বাবার শয্যাশঙ্গী। নিজেদের অমতে পালাক্রমে বাবাকে সঙ্গ দিতে বাধ্য থাকতেন। অসংখ্য পুরুষকে তিনি নপুংসক বানিয়ে দিয়েছেন। যারাই তার অবাধ্য হয়েছে, তাকেই হত্যা করা হয়েছে। বাবা প্রকাশ্যে বিজেপি সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। তার আছে বিশাল ক্যাডারবাহিনী। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, আরে বাবা! এ কেমন ‘বাবা’?
আর এর সবই হয়েছে ধর্মের নামে। সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকে। এই একবিংশ শতাব্দীতে! আর মানুষ সেই ধর্ষক, ভয়ানক খুনীকে ঈশ্বর মেনে জীবন দিয়ে দিচ্ছে।
আপনাদের কী মনে আছে যে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল? বাংলাদেশের এক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে সাজা দেওয়ার অপরাধে, এদেশের একশ’র বেশি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সারা দেশের প্রচুর সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল। এখানেও একই ব্যাপার। সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। সেই মহান ব্যক্তিকে আবার চাঁদেও দেখা গেছে।
শুধু সাধারণ মানুষ কেনো বলছি? তথাকথিত প্রগতিশীলরা সেই রায়ের বিরোধিতা করেছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী থেকে ট্রলারে গলাচিপা আসছি। নৌকায় এক ঘোর আওয়ামী পন্থীর সাথে দেখা। তিনি বললেন, ‘আপনি যা বলছেন সবই ঠিক আছে। তবে তিনি মাওলানা মানুষ। তাকে সাজা দেওয়া ঠিক হয় নাই’! আমি ‘থ’ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কি আর বলা যায় এরপর?
অসংখ্য মানুষ হত্যা, দেশজুড়ে হানাহানি, সবই কিন্তু হয়েছিল ধর্মের নামে।
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে রীতিমত বিনাশ করে দেয়া হচ্ছে। একটা জাতিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন! ‘কফি আনান কমিশন’ মিয়ানমারে পৌঁছানোর পর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দলবেঁধে তার প্রতিবাদ করেছে। এই যে মানুষের ভয়াবহ পরিণতি, কেউ কিছু বলছে না। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম দুনিয়াজুড়ে শান্তির ধর্ম হিসেবে পরিচিত।
ধর্মের কত কত ভাল দিক রয়েছে। সে সব প্রায় উহ্য হয়ে গেছে। অথচ শুধু ধর্মের উপর ভরসা করেই চলছে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, যুদ্ধ! সেসবে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না, একজন ধর্ষক, প্রতারক, খুনী, যুদ্ধাপরাধী, কোন একটা জাতির বিনাশকারী কোনক্রমেই ঈশ্বর, মহাপুরুষতো অনেক দূরের কথা, মানুষই হতে পারে না। ১৫ বছর ধরে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তাকে ধর্ষক প্রমাণ করার পরেও মানুষ তার জন্য প্রাণ দিয়ে দিচ্ছে?
এসব ভন্ডদেরকে টাকা পয়সা, সম্মানতো নয়ই, বরং প্রত্যাখান, প্রতিরোধ করা দরকার। যে যেখানে থাকবে সেখান থেকেই প্রতিরোধ করবে।
দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রচণ্ড ক্ষমতাশীল এসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কবে? মানুষ কবে ঠিক-ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারবে?
কবে বুঝবে যে, কোন ডেরায় নয়, ঈশ্বর থাকে প্রেমে, মানুষের মনে!