ধার্মিকদের মন

হাজি শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের ঈদের নামাজ ও জুম্মার নামাজ পড়তে নিষেধ করেছিলেন কারণ ইসলামী মতে কাফেরদের দেশে মুসলমানদের জন্য ঈদের ও জুম্মার নামাজ পড়া নিষেধ। আজকে আইএস ঈদের নামাজ পড়তে নিষেধ করে ঠিক একারণেই। ইসলামী মতে পৃথিবীটা দারুল হরব (কাফের শাসিত)- একে দারুল ইসলাম (মুসলমানদের দেশ) না করা পর্যন্ত মুজাহিদদের জন্য ঈদ জুমার নামাজ পড়া হারাম। শরীয়তুল্লাহ’র ফরায়েজী আন্দোলনে এরকমই হাজারো ফরজ কর্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো মুসলমানদের…। তাই যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতেই পারে,- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কেমন করে ‘ফরায়েজী’ আন্দোলনকে অন্তর্ভূক্ত করা হলো? আমরা আমাদের শৈশবে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ ‘বাঁশের কেল্লাকে’ ইতিহাসের বইতে পড়েছিলাম ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে। মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের ফরজ নিয়মগুলো প্র্যাক্টিসিলি প্রতিষ্ঠার জন্য হাজি শরীয়তুল্লাহ ১৮৮৮ সালে যে আন্দোলন শুরু করেন তাকেই ‘ফরায়েজী’ নামে ডাকা হয়। শরীয়তুল্লাহ ভারতকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামে জিহাদে কাফেরদের অঞ্চলগুলোকে দারুল হরব বলা হয় যেখানে জিহাদ করে মুসলমানরা দারুল ইসলাম অর্থ্যাৎ মুসলমানদের দেশ বানাবে। শরীয়তুল্লাহ’র এই রাজনৈতিক বিশ্বাস কেমন করে তাকে ভারতের মূল স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্তর্ভূক্ত করবে? সন্দেহ নেই তখন ইংরেজরা ক্ষমতায় ছিল বলে শরীয়তুল্লাহর জিহাদটা ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে গিয়েছিল।

২.
শরীয়তুল্লাহ মারা যাবার পর তার পুত্র দুদু মিয়া এরপর ফরায়েজী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। এ সময় দুদু মিয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের সঙ্গে। ১৮৮৭ সালে তিতুমীর হজ শেষে ভারতবর্ষে ফিরে এসে ইসলামী আন্দোলন শুরু করেন। ইংরেজ নীলকর ও বর্ণবাদী হিন্দু জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেন। এসব কারণে তিতুমীরকে অনায়াসে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা হিসেবে দেখানো যেতোই। কিন্তু তিতুমীরের স্বপ্ন ছিল মুসলমানদের ঈমান ও আমলের হেফাজতের কল্পে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা। সেই লক্ষ্যে তিতুমীর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, ফরিদপুরের কিছু অংশের জমিদারকে পরাস্ত করে দখল করে নেন। তারপর সেখানে স্বাধীন শরীয়তপন্থি ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। তিতুমীর স্থানীয় বাঙালী মুসলিমদের ঐসব উৎসব অনুষ্ঠান বর্জন করতে ফতোয়া দেন যেগুলো কুরআন-সুন্নায় অনুমোদন নেই। অর্থ্যাৎ তিতুমীর আজকের পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানী বলাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বা তিনিই বাঙালী মুসলমানকে ধর্মের প্রশ্নে কট্টর করে তোলার কারিগর। মুসলমানদের জন্য দারুল ইসলামের কথা যিনি ভেবেছিলেন তিনি কি করে ভারতবর্ষের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হোন?

৩.
ইংরেজদের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও সমরনীতির কাছে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা দুঃস্বপ্নের মত ধসে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ও পরবর্তীকালে তিতুমীরদের ব্যর্থতায় বহু ফরায়েজী মুজাহিদকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। নেতা গোছের লোকজন মক্কায় গিয়ে আশ্রয় নেন বা আশেপাশে সীমান্ত অঞ্চলে। অনেকেই ইংরেজ আইনে দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাগারে নিক্ষেপ হয়। জিহাদের বাস্তবতা উপলব্ধি করে এরপর ফরায়েজীরা সিদ্ধান্ত নেন সশস্ত্র যুদ্ধের ধারা স্থগিত করে আপাতত ইসলামী চেতনার মুসলিম যুবকদের তৈরি করাই হবে ভবিষ্যত ইসলামী শাসনের ক্ষেত্র। ইংরেজদের প্রণিত পাঠ্যসূচী মুসলিমদের ইসলামী চেতনা অর্থ্যাৎ ইসলামের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে এই আশংকায় এ সময় ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ প্রতিষ্ঠা হয় ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে। এর মূল লক্ষ ছিল এখানে মুসলিম যুবকরা নানা বিষয়ে শিক্ষা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের রাজনৈতিক লক্ষের প্রতি সচেতন থাকা। দেওবন্দের ছাত্র-শিক্ষকরা নানা সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা স্বীকার করেছেন। এ কারণে ইংরেজ আমলের শেষদিকে আমরা দেখতে পাই দেওবন্দ ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড। ১৯০৯ সালে শাইখুল হিন্দ তার একনিষ্ঠ ছাত্র মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে দিয়ে ‘জমিয়তুল আনসার’ নামের এক মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তুলেন। ‘জমিয়তুল আনসারের’ লক্ষ ছিল তূর্কী আনোয়ার পাশার সঙ্গে চুক্তি করে তুর্কী বাহিনী আফগান হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমন করলে স্থানীয় মুজাহিদরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করবে।… এসব কর্মকান্ড যে ইংরেজদের ভারত থেকে বিতারণের সংগ্রাম ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি বিশেষ ধর্মীয় শাসন ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষে যে আন্দোলন তা আসলে কাদের স্বাধীন হবার কথা বলে?

৪.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তুরষ্কের খেলাফত ও তাদের খলিফাকে নিজেদের খলিফা বা শাসক দাবী করে ভারতীয় মুসলমানরা ‘খিলাফত’ আন্দোলনের ডাক দেয়। এ যেন ১৮৮৮ সালের ‘ফরায়েজী’ আন্দোলনের মতই একটি আন্দোলন তবু এর মননে বেশ তফাত রয়েছে। ফরায়েজী আন্দোলনকে যদি প্যান ইসলামিক বলা যায় তো খিলাফতকে জাতীয়তাবাদ বলতে হয়। মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার ফলে যে আধুনিক মুসলিম সমাজের সূচনা শুরু হয়েছিল, দেওবন্দী ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমদের থেকে যারা পোশাকে, চেহারায় ভিন্ন সেই তারাই খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে বা সমর্থন করে ভারতীয় মুসলিমদের আত্মপরিচয়কে ফের ঘোলাটে করে ফেললেন। ভারতের অমুসলিশ প্রগতিশীল সেক্যুলাররা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কোথাকার কোন তুরষ্কের খলিফা কি করে ভারতীয়দের শাসক হন? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ খেলাফত আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কংগ্রাসের রাজনীতিতে থেকে গেলেও বেশির ভাগ মুসলিম নেতারা তুরষ্কের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য মুজাহিদ পাঠানোর অঙ্গিকার করে এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী খিলাফত গঠন করার লক্ষ্যে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ গঠন করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে। মহাত্মা গান্ধি খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন মুসলিমদের ইংরেজ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত করার আশায়। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল একটি বড় রকমের ভুল। এর মাধ্যমে ধর্মের প্রশ্নে দেশভাগের রাস্তা খুলে দেয়া হয়। যাই হোক, তুরষ্কের খিলাফতকে বাতিল করে এ সময় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হোন প্রগতিশীল তুরষ্কের জনক কামাল পাশা। ভারতীয় মুসলমানরা এবার দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল খিলাফতের সমর্থক আরেক দল যারা প্রগতিশীল বাঙালী মুসলমানদের প্রথম পুরুষ তারা কামাল পাশার সমর্থক। বাঙালী মুসলিম প্রগতিশীলদের প্রথম পুরুষদের একজন সাহিত্যিক কাজী আবদুল ওদুদ লিখেন-“মুসলমান-জগতের, বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের, আবেদন-নিবেদন, কান্না-অভিমান, হুঙ্কার আর আস্ফালন, যখন এক বিদ্রুপের চেহারা নিয়ে জগতের শক্তিমানদের সভায় মনোরঞ্জনের কার্যে ব্যাপৃত ছিল, তখন একদিন কামালের বজ্রহস্তে উদ্যত হলো তাঁর জন্মভূমির এককোণে নিরালায় শাণিত তলোয়ার। সেবারকার মতো শক্তিমানদের আরাম আর কৌতুকের উপর যবনিকা পতন হলো; আর মুসলমানজগত বিস্ময়, পুলক, আর তারীফের বন্যায় দিকহীন লক্ষ্যহীন হয়ে ভাস্তে লাগলো। আমাদের তরুণ কবির সেদিনকার যে প্রাণময় উচ্ছ্বাস– ‘কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই!’ সেদিন ঐ-ই ছিল আমাদের সকলেরই অন্তরের অন্তরতম কথা”।

৫.
কবিতাটি লিখেছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। আধুনিক উদার মুসলিম সমাজের পথিকৃতরা কেন প্যান ইসলামপন্থিদের অনুরূপ ‘মুসলিম উম্মাহ’ রোগে আক্রান্ত সে এক বিব্রতকর প্রশ্ন। এই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথ থেকে দেশবন্ধু সকলের মনেই এসেছিল বৈকি। শরৎচন্দ্র তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন এই বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মুসলিমদের চিন্তার জগত নিয়ে দুর্ভাবনায় দেশবন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি হিন্দু-মুসলমান ইউনিটি বিশ্বাস করেন? শরচৎচন্দ্রর উত্তর- না। দেশবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, কিন্তু এ ছাড়া আর কি উপায় আছে বলতে পারেন? এরিমধ্যে তারা সংখ্যায় পঞ্চাশ লক্ষ বেড়ে গেছে। আর দশ বছর পর কি হবে বলুন তো? … দেশবন্ধুর মনে কি ভাবিকালের দেশভাগের একটা চিত্র খেলে গিয়েছিল? আজকের ধর্মীয় হানাহানিতে রক্তাক্ত উপমহাদেশ কি তার মাসননেত্রে ভেসে উঠেছিল? রাজনীতিবিদরা নাকি ভবিষ্যতদ্রষ্টা হয়ে থাকেন। অনেকদূর পর্যন্ত তারা দেখতে পান…। কোথাকার কোন মধ্যযুগীয় শাসনের একজনকে নিজেদের শাসক বলে স্বীকার করাটা ছিল ভারতীয় হিসেবে গ্লাণিকর। এমন কি কমাল পাশার মত প্রগতিশীল কেউ তুরষ্কের দায়িত্ব ভার নিলেও তার নামে নেচেগেয়ে উল্লাস করাটা কতখানি প্রীতিকর ছিল? ভারতীয় মুসলমান তো ভারতীয় হিন্দুর মতই এই মাটির সন্তান। তাহলে কেন এই হীনমন্যতা? নিরোদ সি চৌধুরী কোলকাতার রাস্তায় হারমনিয়াম বাজিয়ে মুসলিম যুবকদের নজরুলের লেখা কামাল পাশা কবিতাকে সুর করে গাওয়া নিজের চোখে দেখেছিলেন তার জানালা থেকে। তিনি সে সম্পর্কে লিখেছিলেন, “১৯২২ সালে মোস্তফা কামালের বিজয়োপলক্ষে রচিত নজরুলের একটি কবিতা আওড়াইতে আওড়াইতে মুসলমানদের একটি শোভাযাত্রা যাইতেছিল। আমি তাহা ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটে আমার বাসার জানালায় দাঁড়াইয়া উপর হইতে দেখিতেছিলাম। দেখিয়া আমার কি রকম ঘৃণা যে হইয়াছিল তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছি না…”।

৬.
ভারতবর্ষ ভাগ হলো। ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও অবিভক্ত ভারতের অবাঙালী মুসলিমরা ‘পাকিস্তানের’ বিরোধীতা করলেন। এই বিরোধীতা বলা বাহুল্য সেক্যুলার কোন চিন্তা থেকে ছিল না। পাকিস্তানে তাদের জাতিগত পরিচয়ে সংখ্যালঘু হয়ে যাবার ভয়ে তারা পাকিস্তান চাইছিল না। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের বাঙালী মুসলমান পাকিস্তান প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে পাকিস্তারের পক্ষে রায় দিল। কোটি কোটি মানুষের চোখের জলে, বুকের তাজা রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত হল পাকিস্তান। ‘বাঙালী মুসলমানের’ ধর্মীয় পরিচয়ে রাষ্ট্র গঠনের এ এক অনন্য ইতিহাস! অস্বীকার করার উপায় নেই বাঙালী মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে তার রায় দিয়ে প্রমাণ করেছিল সে আদতে মুসলমান, এই পরিচয় তার কাছে অনেক বেশি বাস্তব। কিন্তু পাকিস্তান ধর্মীয় পরিচয়ে গঠিত হবার পরও পাকিস্তানের ধর্মীয় নেতারা অসন্তুষ্ঠ রয়ে গেলো। তাদের কাঙিাখত ‘ইসলামী শাসন’ মুসলিম লীগ পূরন করতে ব্যর্থ হয়েছে এই মর্মে তারা ক্ষোভ জানাতে থাকল। যে কারণে তারা মুসলিম লীগ থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে ১৯৫১ সালে পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের লক্ষে ‘নেজামে ইসলাম’ বা ইসলামী শাসনতন্ত্র পার্টি গঠন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মাওলানা ভাষানীর ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ও শেরেবাংলার ‘কৃষক প্রজা পার্টির’ সঙ্গে নেজামে ইসলাম যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে জয় লাভ করে। সেক্যুলার বলে পরিচিত ভাসানী-শেরে বাংলা কেমন করে ইসলামী শাসনতন্ত্র চাওয়া একটা গোঁড়া ইসলামী দলের সঙ্গে জোট করেছিল? ১৯৫৩ সালেই এই জমিয়ত নেতৃবৃন্দ ‘খতমে নবুয়ত’ নামের আন্দোলন তীব্র করে তোলে আহমদিয়া গোষ্ঠিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে। ভয়াবহ দাঙ্গার সৃষ্টি করে শত শত মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার জেরে জমিয়ত নেতা মাওলানা বোখারী, মাওলানা হাজারভি ও জামাত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদির বিচারে ফাঁসি রায় হয়েছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে জমিয়ত ও জামাত প্রতিষ্ঠাতা মওদুদির পক্ষে নিজ খরচে আদালতে লড়ার জন্য আওয়ামী লীগের প্রবাদপুরুষ হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী লাহোর চলে যান। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের বিরোধীতার কারণে মওদুদিসহ অন্যদের ফাঁসি রায় মওকুফ হয়ে যাবজ্জীবন সাজা বহাল হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট বিজয় লাভ করলে সেই যাবজ্জীবন সাজাও বাতিল হয়ে যায়। বুঝায় যাচ্ছে নিবাচনে জয়লাভের জন্য ধর্মাশ্রয়ী দলের সঙ্গে কি ধরণের লেনদেন হয়েছিল। দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরহ মানুষের রক্ত যাদের হাতে লেগেছিল তারা সবাই জেল থেকে বীরের মত বের হয়ে আসল…।

৭.
বাঙালী মুসলমান দেখা যাচ্ছে বরাবরই দুটো ভিন্ন ধারায় তাদের রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রীয় চিন্তা ধারণ করে আছে। কিন্তু কতখানি দুরত্ব ছিল তাদের সেই রাজনৈতিক ভিন্নতায় তা উপরে আলোচনায় আশা করি সংক্ষিপ্তভাবে উঠে এসেছে। বাঙালী মুসলমান ‘অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র’ নির্মাণ করেছিলো ১৯৭১ সালে- এটি আজকে বড় ধরণের বিতর্ক হয়ে উঠেছে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় আচরণের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হবার পর ‘বাংলাদেশ’ কাগজে-কলমে ‘মুসলিম দেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে ওআইসিতে যোগদান ছিল বর্হিবিশ্বের সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলোর কাছে একটি হতাশা। এম আর আখতার মুকুল পশ্চিমবাংলায় শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী সরকারের হয়ে কাজ করছিলেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি একদা ধর্মের পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মনে রাখবেন আজকে আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করছি তাদের অনেকেই এই কলকাতা শহরেই বছর পচিঁশেক আগে হাত মে বিড়ি মু মে পান, লড়কে লেংগে পাকিস্তান করে গেছে। তারাই আবার পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ করার জন্য একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। কিন্তু কেন?…’ এর জবাবে মুকুল তার বালক বয়েসে হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে মুসলিম পরিচয়ে অপমানিত হওয়ার গল্প শোনানো ছাড়া আর কোন বড় রকমের যুক্তি দেখাতে পারেনি। তারপরই মুকুল পাকিস্তান গড়ার চেতনার যৌক্তিকতাই যেন ফের মনে করিয়ে দিতে বললেন, ‘…বাংলাদেশের এই ভয়াবহ দুর্দিনে আপনারা আশ্রয় দিয়েছেন-আপনজন ভেবে কাছে টেনে নিয়েছেন। এ জন্য আপনাদের জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে আপনারা যারা সাতচল্লিশ, পঞ্চাশ, আটান্নো, বাষট্টি কিংবা পয়ষট্টি সালে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আবার তারা এককালের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন…।…বাস্তব ক্ষেত্রে যা ঘটতে যাচ্ছে, সেই নির্মম সত্য কথাটা আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করলাম। অলীক স্বপ্ন দেখলে মানসিক যন্ত্রণাই বৃদ্ধি পাবে।…’ … ১৯৪৭ সালে দেশভাগে এপার-ওপার যাওয়া মানুষের না হয় একটা ‘বৈধতা’ ছিল, কিন্তু যারা পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু হিসেবে তারা ৫০, ৫৮, ৬২, ৬৫ সালে বাধ্য হয়েছিল দেশত্যাগ করতে, শত্রু হিসেবে যাদের সম্পত্তি দখল হয়েছিল সরকারী নির্দেশে তাদের অপরাধটা কি এমআর আখতারের কাছে? আশ্চর্য যে ভারতের শরণার্থী থেকে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহযোগিতায় থেকে, বিপুল সংখ্যাক পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত বাঙালী হিন্দুদের সহযোগিতায় আশ্রয় পাওয়া মুকুল যেন বললেন, মনে রেখো তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোন নৈকট্য নেই। ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালীর ঐক্য এক অলীক স্বপ্ন?… কোলকাতার রাস্তায় কামাল পাশার বিজয়ে উল্লসিত মুসলিম যুবকদের মিছিলকে নিরোদ সি চৌধুর কাছে ‘ঘৃণ্য’ লেগেছিল। কিন্তু কোলকাতার শ্যামবাজার নাট্যশালার হলঘরে মুকুলের বক্তৃতা শুনে উপস্থিত শ্রোতাদের কেমন লেগেছিল জানা যায়নি…।

তথ্যসূত্র: দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহা: ইয়াহইয়া/ শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়, আনন্দ প্রকাশনী/ নজরুল ইসলাম, বাঙালী মুসলমান ও তূর্কি বিপ্লব, সলিমুল্লাহ খান/ ভারত স্বাধীন হল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ/ আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল।