বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংসতার একটা অন্যরককম তাৎপর্য ছিল। যুদ্ধে পরাজিত সকল সেনাবাহিনী এই ভাবে অধিকৃত অঞ্চলে বুদ্ধিজীবী হত্যা করে না– বুদ্ধিজীবী বলতে এখানে কেবল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যক্তিরাই খুন হননি, সাধারণভাবে শহীদ হয়েছেন যে কোন রকম বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা। যতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তালিকা ছিল আরও বড়। বাড়িতে না পাওয়া যাবার জন্য কিংবা সময় করে উঠতে না পারায় বেঁচে গিয়েছেন অনেকে।
দুটো বিশেষ তাৎপর্য এই হত্যাকাণ্ডগুলোর আছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটা গঠনগত বৈশিষ্ট্য হলো জাতিগতভাবে সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের একটা ধারণা তার অন্যতম ভিত্তি। চিরকাল সামরিক বৃত্তি নির্ভর শাসনের যে স্বাভাবিক অধিকার সে ভোগ করে এসেছে, সেটাকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পাকিস্তানী আবরণ দেয়া হয়েছিল। বাঙলাভাষী বুদ্ধিজীবী সমাজ, সে রাজনৈতিকবাবে সক্রিয় কিংবা নিষ্ক্রিয়– তাদের অস্তিত্বই ছিল এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি একটা উপহাস। জনগণের জাগরণকে তারা চিহ্নিত করেছে বুদ্ধিজীবীদের একক অবদান হিসেবে। প্রতিশোধস্পৃহা তাই এত ভয়াবহ ছিল।
অন্য তাৎপর্যটি অভ্যন্তরীণ। জাতিগত কিংবা সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের এই ধারণা ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মসম্মত হবার কথা নয়। কিন্তু জনগণের প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষার বিকাশে যারা ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত, সেই জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগ, দেশের রাজনীতি থেকে যারা দ্রুত বাতিল হয়ে যাচ্ছিল, পাকিস্তানী হানাদারদের ঢাল বানিয়ে তারা মস্ত সুযোগ নিতে চেয়েছিল তাদের দর্শন চাপিয়ে দেয়ার। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘোরতর ধর্মবিরোধী কাজের পরও তাদের প্রতি নতজানু থেকেই এই ভাবে তারা রক্ষা করতে চেয়েছিল তাদের মতাদর্শ। যে কোন রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সাংস্কৃতিক চর্চাকেই এই দ্বিতীয় দলের, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী অংশটি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় বিশেষভাবে তাদের ওপর বর্তায়।
২. শহীদ সকল বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিকভাবে সমান সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু গয়েশ্বর যেমন বলেছেন, বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধের মত মারা গিয়েছেন, এর মত হাস্যকর কিংবা অসুস্থ চিন্তা আর কি হতে পারে! পাকিস্তানীদের হামলার মুখে সকল বুদ্ধিজীবীর কি ভারতে চলে যাবার কথা ছিল? কিংবা এমন কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে পাকিস্তানীদের ছায়া পড়বে না? মুক্তিযোদ্ধারা যে গোপনে ঢাকাসহ সারাদেশে অজস্র অভিযান চালিয়েছেন, সংবাদ আদানপ্রদান করেছেন, যোদ্ধা সংগ্রহ করেছেন, চিকিৎসা-অস্ত্র-অর্থ সংগ্রহ করেছেন সেটাতে এই বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশসহ দেশের ভেতরে থাকা মুক্তিকামী মানুষেরা যে ভূমিকা রেখেছেন, সেটা কি দেশের মানুষ ভুলে গেছেন? এমনকি বলা উচিত যে, বহুক্ষেত্রে অনেকগুন বেশি দুর্বিষহ জীবন যাপন করেছেন এই অধিকৃত অঞ্চলের মানুষগুলোই, কলকাতা বা আগরতলার তুলনামূলক নিরাপদ পরিবেশের তুলনায়। কিন্তু এই পরিবেশের মাঝেই আলতাফ মাহমুদের মত মানুষেরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, মোহাম্মদ মুর্তৃজার মত মানুষেরা চিকিৎসাসেবা আর আশ্রয় দিয়েছেন। গয়েশ্বর রায়ের মত চতুর তারা হয়তো ছিলেন না, কিন্তু তাদের প্রাণদান তাদের বুদ্ধি আর প্রজ্ঞার স্মারক।
৩. কিন্তু এই সব কথা কেন উঠছে? কেন সংবাদের শিরোনাম হয়েও আলোচনায় আসছে না রুপপুরের পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্বাক্ষর হবার ভয়াবহ সংবাদটি? এই ছোট ভূখণ্ডের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এত বিপদজনক কোন কিছু পাকিস্তান আমলেও হয়নি। কেন আলোচনায় আসছে না এক বছরে দশ হাজার কোটি ডলার পাচার হবার বাস্তবতা? কেন আলোচনায় আসছে না সর্বনিম্ন ৮২০০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার টাকা বেতনের ভয়াবহ বৈষম্যের কথা?
ঘুষ ছাড়া একটা চাকরি এই দেশে আর মেলে না, সেটা নিয়ে আলোচনা কই? সরকারী পদ আর ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিয়োগ বাণিজ্য ক্রয় বাণিজ্য আর নির্মাণ বাণিজ্যে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে সেই আলাপ কোথায়? প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কোন আলোড়ন কি আর আছে? শত শত মন্দিরে হামলা, জাতিগত নিপীড়ন আর মত প্রকাশের ওপর খড়্গ হস্ত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন কোথায়? মানুষ পোড়ানোর ডামাডোলে যে পোষাক শ্রমিকের মজুরির আন্দোলন হারিয়ে গেলো, তাদের জীবন নিয়ে কথা কোই?
৪. এদিক দিয়ে ভাবলে দেখতে পাবেন, ১৯৭১ সালে শারিরীকভাবে হত্যা করতে হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আগেই এনএসএফের মত গুন্ডাবাহিনী বানিয়ে আবু মাহমুদের মত শিক্ষককে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আয়নায় দেখতে গেলে আজকের বুদ্ধিজীবীর যা যা দায়, যা যা কর্তব্য, সেই নিয়ে প্রান্তরময় নীরবতা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা যা বললে পদ-পদবী-খেতাব-পারিতোষিক জোটে, তাই শুধু বলা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার শক্তিকে বলা চলে বোতলবন্দী করে রাখা হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের যদি কোন দায় থাকে, কর্তব্য থাকে, সেটা এইটুকুই: যে ভয়াবহ বাস্তবতায় আমরা বাস করছি, তার মধ্যেই শত্রু এবং মিত্রকে খুঁজে নিতে হবে। এক শত্রুর কবল মুক্ত হবার জন্য জনগণের আরেক শত্রুকে আকড়ে ধরা চলবে না।