(১) পৃথিবীর কোনো রায়-ই অরাজনৈতিক না। যেখানে রাষ্ট্রে একজন মানুষ রাজনৈতিক উপাদান, সেখানে আইন, আদালত, সবই রাজনৈতিক। এই কথাটা বুঝা দরকার। তবে এই রায় ইচ্ছে করলেই আওয়ামীলীগ অন্যভাবে দিতে পারত এই রকম অর্থে রায়কে রাজনৈতিক বলাটা একরকম স্বীকার করে নেয়া যে এই ট্রাইবুনালে আওয়ামীলীগের হাত ছিলো। সুতরাং এই ধরনের কথা বলাটা হবে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দেবার মতই ভয়ংকর। কেননা স্বাধীনতা বিরোধীরা সব সময়ই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে এটি আওয়ামী ট্রাইবুনাল। আমরা সে ফাঁদে পা দেবো না। কেননা অনেকগুলো মামলার রায় এখন কিউতে জমা হয়ে আছে। এই টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো যেন আমরা মনে রাখি। এটা সকলের কাছে অনুরোধ থাকবে।
(২) এই রায়ে কসাই কাদেরের ফাঁসি হয়নি বলে কি সকল সম্ভাবনার মৃত্যু হয়েছে? খুব সহজ উত্তর হচ্ছে, না হয়নি। এখনো খুব স্পস্ট আশা রয়েছে। কেন এই আশা আমি করছি? এই আশা আমি করছি কেননা, যে অভিযোগের ক্ষেত্রে কসাই মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে (অভিযোগ নাম্বার-৪) সেই খালাশ দেবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করতে পারবে। সুতরাং আমাদের আশা আছে। বাকী রায়ের বিরুদ্ধে কিছু করবার নেই, আপীলও করা যাবে না। কেননা, শাস্তি হবার রায় হয়ে গেলে সেটির বিরুদ্ধে (শাস্তি বাড়ানোর জন্য) বাদী আপীল বিভাগে এই আইন অনুযায়ী আপীল করতে পারবেন না [ধারা ২১(২)], সুতরাং আমাদের হাতে যেই সুযোগ টি রয়েছে ৪ নাম্বার অভিযোগের ক্ষেত্রে, সেটি যাতে আপীল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবিরা ভালো করে, দক্ষতার সাথে, বুদ্ধিমত্তার সাথে লড়তে পারেন আমাদের উচিৎ সেইদিকে ফোকাস করা।
(৩) আমি ট্রাইবুনালের প্রদত্ত রায়ে হতাশ। মাননীয় আদালতের উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, এই রায়ে আমি খুশি নই। কেননা আপনাদের রায়ে যেসব বিষয় আপনারা বিবেচনা করেছেন, যেসব প্রমাণ পেয়ে আপনারা বলেছেন ৫ টি অপরাধ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেই আপনাদের বক্তব্যকেই আপনারা কন্ট্রাডিক্ট করছেন রায়ে এসে। অপরাধের মাত্রার সাথে এবং প্রাপ্ত প্রমাণের সাথে আপনাদের প্রদত্ত রায় ব্যালেন্স করেনি। এটি ভিক্টিমের প্রতি অন্যায্য বিচার হয়েছে। আপনি যেই পরিমাপকের মাধ্যমে বা যেই উপাদানের উপর, প্রজ্ঞার উপর, আইনের উপর ভর করে বাচ্চু রাজাকারকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন, সেই একই অপরাধ কিংবা তার চাইতে অধিক অপরাধের ক্ষেত্রে আপনি শাস্তিকে একটা “যথাযথ” রূপ দিতে তুমুল ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছেন। একটা মামলার রায়ের ক্ষেত্রে অনেক বিবেচ্য বিষয়, যেটি এই মামলার বিষয়ে অবশ্যই কনসার্ণ্ড, সেগুলো আপনারা বিবেচনায় আনেন নি। এটা পুরো ট্রাইবুনালের ব্যার্থতা নয়। পার্টিকুলারলি এই মামলাতে এই সুনির্দিষ্ট রায়ের ক্ষেত্রে আপনাদের তুমুল ব্যার্থতা বলেই আমি বলব। এই মামলার ট্রেন্ড কিংবা রায়ের প্যাটার্ন আমার কাছে প্রচলিত ফৌজদারী আদালতের রায়ের মত মনে হয়েছে। যদিও এটি প্রচলিত ফৌজদারী আদালত নয় এবং এখানে এভিডেন্সের ক্ষেত্রেও অনেক ভিন্নতা রয়েছে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন থেকে। আপনারা সেই সাক্ষ্য বিবেচনা করতে গিয়ে হিয়ার্সি এভিডেন্সকে অনেক গৌণ করে দেখেছেন বলেই, আমার মনে হয়েছে। অথচ এটি স্পেশাল ট্রাইবুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য। আপনারা একদিকে বলছেন সন্দেহ ছাড়া অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, অন্যদিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন, এটি অত্যন্ত অত্যন্ত কন্ট্রাডক্টরী। এগুলো শুধু মাত্র বিচারিক প্রজ্ঞার অভাব থেকে হয় বলেই জেনে এসেছি।
(৪) ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত জনতার শাহবাগে অবস্থান নেয়াটা আমি মন ও প্রাণ থেকে সমর্থন করি। একটি রায়ে জনমানুষের আশা আর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফিলন না হলে মানুষ রাস্তায় নামবেই। ঠিক একই ভাবে নেমেছিলো ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের সময় গুলোতে যখন গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সেটি আজ ভুলে গেলে চলবে না। অনেকেই বলবেন আইন তার নিজস্ব কায়দায় চলবে, নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু আমি এই কথাটি পুরোপুরি মানিনা। প্রথমত এই কাদেরর মামলায় ট্রাইবুনাল তার আগের প্রদত্ত রায়ের যে প্যাটার্ণ সেটি ওভারলুক করেছে বলে মনে করছি, দ্বিতীয়ত, আইনের মধ্যে মানুষের আশা আর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পড়েনি। এই ট্রাইবুনাল শুধু কয়েকজন অপরাধীর অপরাধের বিচারই নয়, এই ট্রাইবুনাল আসলে পুরো বাংলাদেশের একটা চূড়ান্ত আশার স্থানও হয়ে গিয়েছিলো। আমি মনে করি শাহবাগের এই আন্দোলনের মাধ্যমে ও প্রতিবাদের মাধ্যমে মানুষ তার মতামত রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিবে। ট্রাইবুনাল যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে রায় দেবার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে তারা সেসব ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না, এই আন্দলোন সেটি উপলব্ধিরও একটি মাধ্যম বলে আমি মনে করি।
১৯৯৪ সালে রাজাকার সেনাপতি গোলামকে এই দেশের নাগরিকত্ব দিয়েছে আদালত, কিন্তু ২০১৩ সালে এসে এদেরকে কায়দা মত ধরে আবার বাঁচিয়ে তুলবার আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখিনা। বিচারের ক্ষেত্রে আবেগের উর্ধে উঠবার মানে এই নয় যে, আপনি নিজের কথাকেই নিজে কন্ট্রাডিক্ট করবেন, আবেগের উর্ধে উঠার মানে এই নয় যে আপনি অপরাধের গুরুত্ব না মেনে অযৌক্তিক রায় দেবেন। এই রায়কে আমি প্রত্যাখান করলাম।