যুবকের মুখে বিশাল দাড়ি আর গোঁফ। গায়ে সাদা জোব্বা। জোব্বার নীচের দিকে খানিকটা কাদা লেগে আছে। পুরো জুতো কাদাময়। মাথায় “সেইভ বাংলাদেশ” লেখা জামাতী সংগঠনের একটা কাগজের টুপি। ছেলেটির চোখ রক্তাভ। এক ধরনের খুনে দৃষ্টি তার চোখে মুখে। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। চকিতেই মুখ ঘুরিয়ে সেন্টু নামের কাউকে ডেকে উঠল। সেন্টু খুব সম্ভবত দাঁড়িয়েছিলো ব্রিক লেনের ঠিক শুরুতে, রাস্তার ওপাড়ে। যুবকের ইংরেজী পুরোপুরি এই বাঙালী জনপদের নিজস্ব তৈরী করা সেই পরিচিত একসেন্টে। বুঝতে পারলাম এই যুবক এখানে বেড়ে ওঠা। ছেলেটি আমার দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছিলো খুব কম সময়ের জন্য। সে এখানে এসেছে আলতাব আলীর পার্কে জামাতের হিংস্র ও বাংলাদেশ বিরোধী সমাবেশে।
টানা অনেক্ষণ স্লোগান দিতে গিয়ে আমিও খানিকটা ক্লান্ত ছিলাম। এক সহযোদ্ধা হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিলো। আমি হ্যান্ড মাইকটা অন্য আরেক যোদ্ধার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আলতাব আলী পার্কের মূল দরজায় এসে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমার আশে পাশে গোটা দশেক পুলিশ দাঁড়িয়ে।
ছেলেটি আমার দিকে খুনে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম এক ধরনের করুনা নিয়ে। হঠাৎ করে মনে হলো এই ছেলেটি জীবনের কত কিছু থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে নিজেকে!!
এই যুবকটি হয়ত একটা সুন্দর পাখি দেখে সেটির ভেতর সৌন্দর্য খুঁজে পায়না, নীল আকাশ দেখে তার অন্য রকম বোধ হয়না, সুন্দরী তরুনী দেখে যুবক সেই সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়না, হয়ত খোঁজ করতে থাকে এই সুন্দরী নারী বোরকা পরেছে কি পরেনি কিংবা হিজাব করেছে কি করেনি। যুবক কখনো বন্ধুদের সাথে হয়ত আড্ডা দেয়নি, গামছা পেতে টুয়েন্টি নাইন খেলেনি, ক্রিকেট খেলেনি, ফুটবল খেলেনি, বন্ধুদের সাথে হয়ত ছেলেটি কখনো ঘুরতে যায়নি এসব হারাম ভেবে। হয়ত এসবের ভেতর দোযখ লুকিয়ে আছে বলে চিরকাল সে ভয় পেয়ে এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৌলবাদী লিফলেট বিলাতে গিয়ে হয়ত সে এসবের কথা কোনোদিন ভাবেই নি। যুবক হয়ত জানেনা পৃথিবীতে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা হয়েছে, গল্প কিংবা উপন্যাস লেখা হয়েছে। সে হয়ত জানেনা বৃষ্টি খুব সুন্দর, বৃষ্টিতে ভেজা আরো বেশী সুন্দর, প্রথম বৃষ্টিতে প্রেমিকাকে ফুল দেয়া যায়।
এই যুবক হয়ত বাংলাদেশের নাম শ্রদ্ধা ভ’রে কখনো মুখে নেয়নি, জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন বলে হয়ত কখনো গায়নি, ইনফ্যাক্ট সে হয়ত জাতীয় সঙ্গীত কাকে বলে এটিই জানেনা, যুবক হয়ত জানেনা যেই দেশে তার পিতা-মাতার জন্ম সেই দেশটি পেতে ৩০ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে মাত্র নয়টি মাসে। নির্যাতিত হয়েছে ৪ লক্ষ নারী। এই যুবক হয়ত শুধু বোঝে বেহেশত আর দোযখ। এই ছেলে হয়ত একটি সুন্দরী নারীকে দেখে আস্তাগফিরুল্লাহ বলে ওঠে, এই যুবক হয়ত সারাদিন নাউজুবিল্লাহ বলতে বলতে এক ধরনের আতংকের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে। এই যুবকের জীবনে ভালোবাসা নেই, প্রেম নেই, সুন্দর নেই, কষ্ট নেই, বিষাদ নেই, বিষ্ময় নেই, আনন্দ নেই, উচ্ছাস নেই। যুবকের ভেতর আছে শুধু ভয় আর শংকা। বেহেশত না দোযখ সেই শংকা। হালাল না হারাম সেই শংকা। নাউজুবিল্লাহ না আস্তাগফিরুল্লাহ, সে শংকা। এ এক অদ্ভুত মানব জীবন…
আমার দিকে রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যুবক হয়ত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে তার বন্ধু সেন্টুও রাস্তার ওপার থেকে তার কাছে পৌঁছেছে। আমাকে কিছু করতে না পারার শোকে মুহ্যমান যুবক সাদা জোব্বা, অদ্ভুত টুপি আর দাড়ি গোঁফ নিয়ে জামায়াতের সমাবেশের দিকে হেঁটে চলে গেলো। এখন হয়ত সে তার এই নোংরা জুতো নিয়ে শহীদ মিনারে উঠে সাঈদীর পক্ষে স্লোগান তুলবে, নিজামী সঙ্গীত গাইবে কুৎসিত কন্ঠে, কে জানে…
একটা দীর্ঘঃশ্বাস নিজের অজান্তেই বের হয়ে আসে বুক চিরে। এমন একটা তরতাজা যুবক যখন লাশ হয়ে জীবন্ত ঘুরতে থাকে কিংবা পরকালের বেহেশতের লোভে পশুর মত হামাগুড়ি দিতে থাকে বিষাক্ত লালা ঝরিয়ে, একজন মানুষ বলেই তা হয়ত সহ্য করতে পারিনা।
বড় কষ্ট লাগে…