দলীয় ট্রেডমার্ক

“আপনি কোন দলের?” এই জঘন্য প্রশ্নটি আপনি আপনার জীবনে কখনো শোনেন নি এটা হতে পারে না। বাংলাদেশের মোটামুটি কিছু লোকের ধারনা যে একজন মানুষকে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতেই হবে। ঠিক যেমন ছোট বেলায় আমরা জিজ্ঞেস করতাম একজন আরেকজনকে, “কিরে তুই আবাহনী না মোহামেডান?”, আসলে দলাদলির ব্যাপারটা আমাদের জন্মগত, মজ্জাগত আর অভ্যাসগত। পাছার মধ্যে দলীয় একটা ছাপ না থাকলে যেন আমাদের আর কোনো পরিচয়-ই নেই। যেন আমরা দল ছাড়া বেওয়ারিশ কুকুর। ৩০ লক্ষ বা তারো অধিক মানুষকে ধরে ধরে খুন করে ফেললো, শেয়াল-কুকুর-শকুন লাশ খেয়ে ফেললো আমার বাবাকে-ভাইকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে, ৪ লক্ষ বা তারো অধিক নারী নির্যাতিত হোলো, সন্তানের সামনে নয়তো স্বামীর সামনে নয়তো পিতার সামনে নয়তো ভাইয়ের সামনে ধর্ষিত হোলো মা, স্ত্রী, সন্তান কিংবা বোন।

বাবার রক্তে রঞ্জিত দেহ ফেলে রেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়েছিলো সন্তান, মায়ের ধর্ষিত দেহ টপকে নিজের জীবন বাঁচাতে লুকিয়ে থেকেছে কন্যা কিংবা কন্যার জীবন বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছে বাবা, প্রিয় ঘর ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে, প্রিয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অপমান, লঞ্ছনা, তীব্র কষ্টের ভেতর প্রতিটি মূহূর্ত পার করেছিলো আমাদেরই বাবা, চাচা, মা, বোন, ভাই, খালা, ফুফু, মামা, প্রতিবেশী, সকলে। একটা দেশকে ঘাতকেরা খুঁড়ে খুঁড়ে, পুড়িয়ে পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দিয়ে গিয়েছিলো। লক্ষ প্রেম হারিয়েছিলো সেসময়, লক্ষ প্রেমিকা হারিয়েছিলো সে সময়, হারিয়েছিলো লক্ষ প্রেমিক, হারিয়ে ছিলো অযুত নিযুত স্বপ্ন, ভালোবাসা ম’রে দগদগে ঘা হয়েছিলো এই বুকের ভেতর, রক্তাক্ত হয়েছিলো আমার বাবার শরীর।

এইসব তীব্র বেদনার, যন্ত্রণার, লাঞ্ছনার, অপমানের, কষ্টের, বিষাদের, নির্যাতনের বিচার আমি চাইতে পারব না? এই বিচার চাইতে গিয়ে চিৎকার দিয়ে আমি “জয় বাংলা” বলতে পারব না? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি আওয়ামীলীগ? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি ফ্যাসিস্ট? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি নাস্তিক? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি হিন্দু? এই বিচার চাইতে গেলেই আমার বোন বেশ্যা? মা বেশ্যা? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি দলীয়? এই বিচার চাইতে গেলেই আমি কুৎসিত? এই বিচার চাইতে গেলেই কেন আমাকে শেয়ার বাজারের কথা মনে রাখতে হবে? এই বিচার চাইতে গেলেই কেন আমাকে মনে রাখতে হবে পদ্মা ব্রীজ? হান্ডিজ, মেঘনা, যমুনা ব্রীজের কথা? এই বিচার চাইতে গেলেই কেন আমাকে মনে রাখতে হবে দ্রব্য মূল্যের কথা? এই বিচার চাইতে গেলেই কেন আমাকে জীবনের অন্যান্য দাবীকে খিচুড়ী বানিয়ে চাইতে হবে?

পদ্মা ব্রীজ চাইতে গেলে কি আপনি আমার বাবার খুনের কথা বলেন? শেয়ার বাজারের কথা বলতে গেলে কি আপনি আমার মায়ের নির্যাতনের কথা বলেন? দ্রব্য মূল্যের কথা বলতে গেলে কি আপনি আমার ৪২ বছর আগের হারানো ভাইয়ের কথা বলেন? তবে কেন আমি এসব হত্যার বিচার চাইতে গেলে আপনারা এইসব প্রশ্ন আমার মুখের উপর চেপে ধরেন? কেন? কিসের জন্য?

আমি আজ শুধু আমার মা’কে হত্যার, বাবাকে হত্যার, ভাইকে হত্যার, বোনকে হত্যার বিচার চাই। আমি কোনো দলকে চিনি না। আমি কোনকে দলকে বুঝি না। আমি রাজনীতি বুঝি না, আমি জটিলতা বুঝি না, আমি কোনো দলের নই, আমি দলীয় নই।

আমি বিচার চাই। আমি শাহবাগের ওই তীব্র কন্ঠের কাছে গিয়ে বলি আমি বিচার চাই, আমি শহীদ জননীর কাছে গিয়ে বলি আমি বিচার চাই, আমি জনে জনে গিয়ে বলি বিচার চাই, আমি আইনের কাছে বিচার চাই, আমি ট্রাইবুনালের কাছে বিচার চাই, আমি রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাই। আমাকে আমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দাও। আমি তবেই শাহবাগ থেকে ঘরে ফিরব। ৪২ বছর ঘরেই কাটিয়েছি আমি। আর না। আর একটি মুহুর্তও না। আমি আমার স্বজন হত্যার ন্যায্য বিচার চাই আজ এবং এখুনি।

নিজের ভেতর মরেছি অসংখ্যবার। আর কতবার মরে গেলে আমি বিচার পাব?