সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কথা মনে হলেই মনটা কষ্টে নীল হয়ে ওঠে। একটা রায়ের কারনে এই সম্মানিত ব্যাক্তিটিকে কি ভয়ংকর রকমের অপমানিত হতে হয়েছে, অপদস্থ হতে হয়েছে।
আমাদের এই ঘুনে ধরা সমাজের সকল উইপোকাদের ভীড়ে একটা অর্গানের প্রতি মানুষ কিছুটা হলেও আস্থা রাখতে পারত, সেটি হচ্ছে উচ্চ আদালত। কিন্তু এই ১৬তম সংশোধনী বাতিলের রায়ের ফলে যা হলো সেটি এক কথায় ভয়ানক এবং অত্যন্ত বিদীর্ণ করে দেবার মত একটি ঘটনা।
স্যারের রায়ের অনেক কিছুর সাথেই আমার মতামত মেলে না। ইনফ্যাক্ট সূপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পুরো পদ্ধতিটির-ই আমি রিফর্ম চাই কিন্তু সেটি বলতে গিয়ে আমাকে কখনো তাঁকে পাকিস্তানের দালাল, আই এস আই এর এজেন্ট, ছিঁচকে উকিল, ষড়যন্ত্রকারী বলতে হয়নি। কেননা বলবার মত ভাষা আমার খুব সম্ভবত জানা রয়েছে, লিখবার মত সামান্য কন্টেন্টও খুব সম্ভবত আমার কাছে রয়েছে।
এই যে সরকার ১৬ তম সংশোধনী পাশ করেছিলো এবং ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গিয়েছিলো আমার তো সেটিকেই হাস্যকর মনে হয়। কেন মনে হয় জানেন? দেখুন তো ৭২ এর সংবিধানে কি লেখা রয়েছে? ৯৬ এর ২ অনুচ্ছেদে রয়েছে-
(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।
যেখানে অসামর্থ্য ও অসদাচরণ “প্রমাণিত” কথাটি রয়েছে সেখানে দুই তৃতীয়াংশ ভোটের কি প্রয়োজন? তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে যে একজন বিচারপতির অপরাধ প্রমাণিত যদি হয় এবং সেক্ষেত্রে দুই তৃতীয়াংশ ভোট তাঁর বিপক্ষে না যায় তাহলে তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন?
তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা? মানে একজন বিচারপতি অসদারচন করবেন কিন্তু ৩ ভাগের ২ ভাগ ভোট তার বিরুদ্ধে না গেলে তাঁকেই সেই পদে আমাদের দেখতে হবে বাধ্য হয়েই।
এই নিয়মটি কি আসলেই অদ্ভুত নয়? অন্তত আমার বিচারে সেটি তাই। আর বাংলাদেশের মত স্থানে যেখানে প্রধান বিরোধী দল আর সরকারী দল দুই মেরুর সেখানে কি করে ভোটাভুটিতে দুই তৃতীয়াংশ ভোট পাওয়া যেতে পারে কারো বিরুদ্ধে?
ধরা যাক বিচারপতি কলিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অসদাচরনের প্রমান পাওয়া গেলো। এখন এই প্রমান পাবার পর সংসদে ভোটাভুটি হবে। তো দেখা গেলো বিচারপতি কলিমুল্লাহকে বি এন পি পছন্দ করে। আবার সংসদে বি এন পি’র ১৪০ টা আসন আর বাকিটা আওয়ামীলীগ ও অন্য দলের। এখন ভোটাভুটি হলে ধরা যাক বি এন পি বিচারপতি কলিমুল্লাহ্র অপসারনের বিরুদ্ধে থেকে গেলো তাহলে কি দুই তৃতীয়াংশ ভোট পাওয়া যাবে? আর যদি না পাওয়া যায় তাহলে তো একজন অসৎ বিচারপতি (যেটি প্রমাণিত) তাঁর অবস্থানেই থেকে যাবেন।
একই দিকে বিচারপতিদের এই অসদাচারন ও অসামর্থ্য কে প্রমাণ করবে? স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও এই বিষয়ে কোন আইন নেই, নিয়ম নেই। একটি খসড়া করা হয়েছিলো ২০১৪ সালে, সেটিও অত্যন্ত কন্ট্রোভার্সিয়াল এবং অপূর্ণাঙ্গ।
এইভাবে ডিস্পিউটেড অনুচ্ছেদ, প্রভিশান সব কিছু মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। মাঝখান দিয়ে খড়গ পড়েছে এই প্রবীণ, মেধাবী বিচারপতির উপর।
আমি বিষ্মিত হয়ে দেখলাম একটা ব্যাপার। বাংলাদেশের যতগুলো ল্যান্ডমার্ক মামলার রায় রয়েছে তার সবগুলোতেই বলতে গেলে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচারপতি হিসেবে ছিলেন। ১৩ তম, ৫ম,৭ম, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ইত্যাদি।
একজন অফিসার অফ কোর্ট হিসেবে জুডিশিয়ারীর উপর এই আক্রমন গুলো আমার বুকে সূঁচের মত বিদ্ধ হয়। মনে হয় সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে প্রবল অন্ধকার।
এসব সব কিছু দেখে শুধু আমার সিদ্দিকের সেই ছবিটার কথা মনে হয়। একটা কালো সানগ্লাস পরা সিদ্দিক। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তাঁর নিভে যাওয়া চোখ দিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তের মত উপরে তাকিয়ে রয়েছে। যাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো রাষ্ট্রের পুলিশ।
মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, আমরা সকলেই সিদ্দিকের মত। নানান ভাবে আমাদের অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের বুক, আমাদের মুখ, আমাদের চেতনা, আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের আনন্দ, আমাদের হাসি সব কিছু আজ এক তুমুল আবর্তে কেবল ধাবিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার বড় ক্লান্ত লাগে। ক্লান্ত লাগে…