পলিটিক্স অফ কনভেনিয়েন্স

পলিটিক্স অফ কনভেনিয়েন্স। শব্দ দুটি আমাকে সম্প্রতি খানিকটা গিলে খাইয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক কর্তাব্যাক্তি ব্র্যাড এডামস। এক আলোচনা সভা শেষে তাঁর কাছে সবিনয়ে জানতে চেয়েছিলাম যে “এই যে আপনারা যে মৃত্যুদন্ড রহিত করে অন্য শাস্তি দেবার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠিপত্র দিচ্ছেন এটা তো বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ। ফাঁসী দেয়া হবে কি হবেনা সেটা নির্ভর করবে বিচারপতিদের বিবেচনার উপর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপর নয়, তাহলে তাকে এড্রেস করে চিঠি দেন কেন? আবার এই আপনারা কেন বলেন বিচারে সরকারী হস্তক্ষেপ হচ্ছে? একদিকে হস্তক্ষেপের জন্য চিঠি পাঠান আবার অন্যদিকে হস্তক্ষেপ হচ্ছে বলে কলাম লেখেন, দুটোই কি কন্ট্রাডিক্টরী নয়?”

ভদ্রলোক আমার এই প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আমার পিঠ চাপড়ানো প্রশংসা করলেন “ভালো প্রশ্ন ছিলো”, এই কথা বলে। পাশাপাশি তিনি একই সাথে প্রসঙ্গ ধরে ধরে আমাকে বললেন আমি নাকি পলি্টিক্স অফ কনভেনিয়েন্স লাইনে কথা বলছি। যদিও কিভাবে তা করছি, এই প্রশ্নের উত্তরে আরেকদিন তিনি আমার সাথে বসবেন এই ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন নি। যাই হোক আজকে এই বড়দিনের সকালে ব্র্যাডের কথা মনে পড়লো খুব।

পলিটিক্স অফ কনভেনিয়েন্সের কথা মনে পড়বার সাথে সাথে ব্র্যাডরা যাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছে তাদের কিছু কর্মকান্ডের কথাও মনে পড়ে গেলো।

(১) বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত খারাপ ব্যাক্তি, তার কথা বিশ্বাস করিনা, তার কথার বেইল নাই কিন্তু তিনি ৩ লক্ষের বদলে ৩০ লক্ষ বলেছেন এইটা মানি। অর্থ্যাৎ বঙ্গবন্ধু যদি ৩ লক্ষ শহীদের কথা বলতেন আমার মনের মাধুরী অনুযায়ী তাহলে মানি। কিন্তু হ্যাঁ বাবা, বঙ্গবন্ধুর অন্য কথায় বিশ্বাস নাই।

(২) বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত খারাপ, বাকশালের প্রবক্তা, এক নায়ক কিন্তু সব রাজাকারদের তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন ১৯৭৩ সালে, উনার এই কাজকে স্বাগত জানাই। উনি এই ক্ষেত্রে মহান। অর্থ্যাৎ বঙ্গবন্ধু খুব মন্দ লোক, শুধু “সব” রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছে এই রকম ডাহা মিথ্যে ছড়ানোর বেলায় কন্ডিশনাল সেই ক্ষমার ব্যাপারটা মানি। কিন্তু হ্যাঁ বাবা, বঙ্গবন্ধুর অন্য কথায় বিশ্বাস নাই।

(৩) মুনতাসীর মামুন খুব খারাপ লোক। তিনি আওয়ামী, তিনি বাকশালী। কিন্তু আমি কামারুজ্জামানের ছেলে ওয়ামী আমার বাবার মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার পক্ষে সাক্ষী দিতে গেলে আমি মুনতাসীর মামুনের বই সাথে করে নিয়ে যাই এবং বিচারপতিকের তা দেখাই। কেন দেখাই? কারন ফরিদপুরের রাজাকার লিস্টে মুনতাসীর মামুন সাহেব আমার বাবার নাম লেখেন নাই। কিন্তু হ্যাঁ বাবা, মুনতাসীর মামুন স্যার অত্যন্ত মন্দ লোক।

(৪) মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মরতেই পারেনা কিন্তু হেফাজতের তান্ডবের সময় ৬-ই মে তারিখে তিন হাজার ব্যাক্তিকে কয়েক মিনিটে দেড় লক্ষ গুলি খরচ করে বাকশালী সরকারের পুলিশ মেরে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত ৩০ লক্ষ কিংবা তারও অধিক সংখ্যা মিথ্যা, সেইটা গণনা করা দরকার কিন্তু ৫ মিনিটে তিন হাজার মেরে ফেলার গল্প গননা করা দরকার নাই। হুঁ বাবা, এইগুলা গণনার দরকার লাগেনা।

(৫) মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের ব্যাপারটা গুল গপ্পো কিন্তু সেই সময়ে ৫ লক্ষ বিহারী হত্যা করবার ব্যাপারটা খুব সত্য। ফাহাম আব্দুস সালাম ফেসবুক স্ট্যাটাস দিসে সুতরাং এটা সত্য কাহিনী। ৫ লক্ষ বিহারী বাংলাদেশে সেই সময় ছিলো কিনা এইটাও গোনার দরকার নাই, তাদের ভূমিকাও জানার দরকার নাই, তাদের নৃশংসতা, তাদের ভয়াবহতা কিংবা রাজাকারির কাহিনী জানার দরকার নাই শুধু ৫ লক্ষ বিহারীকে বাংলাদেশীরা মারছে এমন গুল গল্প ফেসবুকে পাইসি তাতেই চলবে। কিন্তু বাবা, ৩০ লক্ষ সত্য হতেই পারেনা। কাভি নেহি, এইটা গোনার দরকার আছে।

(৬) আমি আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবি। এই আইনে বইও সাক্ষ্য হিসেবে আনা যাবে। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন মানা হয় নাই সুতরাং এই আইন মানিনা কিন্তু আমার মক্কেলদের জন্য আমি কাড়ি কাড়ি ইতিহাসভিত্তিক বই নিয়ে আসব, শুধু এইটা মানি। এই আইনে হিয়ার্সি উইটনেস এলাউড, এইটা অন্যায় কিন্তু আমার সাক্ষীরা হিয়ার্সি উইটনেসের তল্পি বাহক হলেও কোনো সমস্যা নেই, শুধু এইটুকু ঠিক আছে বাকী সব বাকশালী।

(৭) শাহবাগে শান্তিপূর্ণভাবে মোমবাতি পোড়ায়, এইটা নাস্তেক কাজ। এইটা অগ্নিপূজা কিন্তু আমরা যখন ব্লগারদের কুশপুত্তলিকা বানাই এবং তা আগুন দিয়ে গোল হয়ে পোড়াই সেইটা কোনোভাবেই অগ্নিপূজা না। এইটা গণতন্ত্র। শুধু আমাদের পোড়ানোটা ধর্মীয়ভাবে সঠিক।

(৮) আমি কাদের মোল্লা। আমি একাত্তর সালে খুন খারাপি করি নাই খালি পাকিস্তান না ভাঙুক সেটাই চেয়েছিলাম। এইটা অন্যায় না। কিন্তু আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আমার মামলা চলাকালীন সময়ে জবানবন্দীতে বলেছি আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিং নিয়েছি। যুদ্ধ করেছি। আমি পাকিস্তান ভাঙ্গা চাইনাই আবার পাকিস্তান ভাঙার জন্য যুদ্ধ করেছি। যেহেতু আমার বিরুদ্ধে রাজাকারির অভিযোগ আছে তাই আমার এই দুই রকমের কন্ট্রাডিক্টরী বক্তব্য এই মামলার জন্য সঠিক। আবার আওয়ামীলীগ খুব খারাপ। তাদের কর্মীরাও খুব খারাপ কিন্তু আমি আমার প্রদত্ত জবানবন্দীতে বলেছি যে ১৯৭২ সালের ৩শরা জানুয়ারী আমাকে রাজাকার হিসেবে সন্দেহ করে আটক করলে আমাকে ছাড়িয়ে আনে আওয়ামীলীগের কিছু লোক। এই ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের কর্মীদের রেফারেন্স দেয়া যায় কারন এইটা আমার পক্ষে গিয়েছে। আমি কাদের মোল্লা পাকিস্তান ভাঙুক কিন্তু চাইনাই, আমি কিন্তু আওয়ামীলীগ পছন্দ করিনা।

(৯) আমি নিজামী। আমি হাসিনার পাশে বসে একটা ছবি তুলেছি জাতীয় সংসদে সুতরাং আমার বিচার হওয়া ঠিক না কারন আমি আওয়ামীলীগের সাথে জোটে ছিলাম। আমাদের জামাতের সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামীলীগের সাথে জোটে যাওয়া যায়না কিন্তু আমার বিরুদ্ধে একাত্তরের রাজাকারির অভিযোগ আনলে সংসদের ঐ ছবিটা সামনে নিয়ে আসা যায় কারন ঐটা আমার পক্ষে যায়। কিন্তু হুঁ বাবা, শেখ হাসিনা খুব খারাপ।

(১০) আমি শিবিরের নেতা। আমাদের আগের নাম ছাত্র সঙ্ঘ। আমাদের গুরুরা পাকিস্তান ভাঙ্গুক চায় নাই। এই জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা গণহত্যা করেছি, খুন খারাপি করেছি। কিন্তু এগুলা অন্যায় না। এগুলা খুব ভালো কাজ কারন পাকিস্তান না ভাঙ্গার জন্য এগুলা অত্যন্ত সহি। আমরা পাকিস্তান ভাঙা না চাইলেও ২০১৫ সালের মিছিলে আমরা ব্যানারে লিখতে পারি “আমরাই স্বাধীনতা এনেছি” কেননা এই সময়ে এই রকম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না থাকলে আমাদের চামড়া থাকবে না। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর খুব খারাপ ব্যাপার কিন্তু ব্যানারের এইসব লিখন অত্যন্ত ভালো ব্যাপার।

এইভাবেই চলছে আর কি…