মাদ্রাসায় মূলত কারা পড়তে যান? যদি প্রশ্নটা করি বাংলাদেশের পার্স্পেক্টিভে তাহলে উত্তরটা একদিকে বড়ই করুন এবং অন্যদিকে আতংকের।
শেষ বয়সে কোনো দম্পত্তির একটা ছেলে বা মেয়ে হয়েছে ব্যাস দম্পত্তি মানত করে বসলো যে তাকে আল্লাহর রাস্তায় পাঠিয়ে দেব, কোনো দম্পত্তির সন্তান হচ্ছেনা, ব্যাস তাঁরা কোনো দর্গায় গিয়ে বা মসজিদে গিয়ে বা ঘরে বসে মানত করলেন যে এইবার যদি একটা সন্তান হয় তাহলে তাঁকে আল্লহর রাস্তায় দিয়ে দেবেন, ঘরের সবচাইতে দুষ্টু ছেলেটাকে শান্ত করতে হবে? ব্যস তাকে পাঠিয়ে দেন মাদ্রাসায়। অর্থ কড়ির সমস্যা? স্কুলে পাঠাবার টাকা নেই? ব্যস তাকে পাঠিয়ে দিন মাদ্রাসায়।
এইরকম নানাবিধ আরো অনেক আনেক্সপেক্টিং সিচুয়েশন গুলোতে মূলত একজন মানুষের জন্য নির্ধারিত হয় মাদ্রাসা। কখনো সেটি পিতা-মাতার পরকালের বাসনা, কখনো অর্থনৈতিক কিংবা কখনো সামাজিক।
মাদ্রাসায় গিয়ে একজন ছাত্র বা ছাত্রী কি পড়েন?তাঁদের সিলেবাস কি? শহুরে মাদ্রাসার কথা আমি বাদ-ই দিলাম। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসাগুলো কিভাবে চলে? গ্রামের বেশীরভাগ মাদ্রাসা বানায় ঐ এলাকার কতিপয় দানবীর। কখনো মৃত মায়ের নামে, কখনো মৃত বাবার নামে। সারাজীবন নানাবিধ কর্ম করে একটা বয়সে একটা চৌচালা টিনের ঘর বানিয়ে, দুটো চাটাই কিনে দিয়ে আর একজন হুজুর রেখে দিয়ে দিলেন মাদ্রাসা। ব্যসা, দ্বীনের কাজ শেষ। পরকাল নিশ্চিত করে ফেললেন সেই দানবীর।
এইসব মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয়, কি পড়েন তাঁরা? কি শেখেন তাঁরা, কারা এই কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা দেন? কি শিক্ষা দেন? তাঁদের জ্ঞান কতদূর? কি তাদের পরিধি? আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল আমি আলোচনা-ই করলাম না, দেশীয় পরিমন্ডলে তাঁদের স্থান কোথায়? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। দাখিল কিংবা কামিল পরীক্ষার পাট চুকিয়ে (কারো কারো সেটিও ভাগ্যে জোটে না) মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে মিলাদ পড়ানো এবং একটু চতুর হলে ওয়াজটা শিখে মাহফিল করে আয় করা ছাড়া বেশীরভাগ মাদ্রাসার ছাত্রের কপালে কি আছে বা কি থাকে?
কোরবানীর কিংবা রোজার ঈদ এলে দলে দলে মাদ্রাসার ছাত্ররা বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে যাকাত, ফিতরা খোঁজেন, কোরবানীর গরুর চামড়া খোঁজেন, মাদ্রাসা চালাবার জন্য ছোট ছোট বাচ্চারা মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে রীতিমত ভিক্ষার মত দু’হাত পাতেন।
যতগুলো মাদ্রাসা আমি গ্রামে গিয়ে দেখেছি সেগুলোর অবস্থা যদি আজ বয়ান করি তাহলে আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন। এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। একটা খর্বকায় টুলের মত বস্তু, তার উপরে কায়দা কিংবা আমপারা। সারি সারি করে রাখা সেসব টুল বা রেহাল। আর একটানা চাটাইয়ের উপর শত শত বাচ্চারা চোখ বন্ধ করে একবার মাথা সামনে আরেকবার মাথা পেছনে নিয়ে চিৎকার করে আরবীতে সেগুলো পড়ে চলেছে। সমান্তরাল করে এই দুই লাইনের ফাঁকে একজন শিক্ষক লম্বা বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ ঘুমে হেলে পড়লে, কেউ একটু কম চিৎকার করে পড়লে চটাশ চটাশ করে বেতের বাড়ি পড়ে তাঁর সেই কোমল শরীরে।
ফিজিক্স নেই, কেমেস্ট্রি নেই, জ্যামিতি নেই, ত্রিকনোমিতি নেই, বাংলা নেই, ইংরেজী নেই, সমাজ বিজ্ঞান নেই, কম্পিউটার সায়েন্স নেই, নিজ ভাষায় ধর্মীয় শিক্ষা নেই, আর্টস নেই, ক্রাফটস নেই, ক্রীড়া নেই শধু আছে একটানা বিষাদ। দিনের পরদিন এই রকম অবহেলায় আর পিছিয়ে পড়তে থাকা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এক একজন মাদ্রাসার ছাত্ররা বড় হয়, বেড়ে ওঠে।
এই কোমলমতি বাচ্চাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের উচ্ছ্বল শৈশব, কৈশোর, ভালোলাগা, নিজের ইচ্ছে সব কিছু। আমাদের সমাজে তাঁরা বেড়ে ওঠেন দূর্দান্ত অবহেলায়, গ্লানিতে ও অপমানে।
বাবা মারা গেলে, মা মারা গেলে, দাদী মারা গেলে, চাচী মারা গেলে এই সব কোমলমতি ছাত্রদের ডাক পড়ে। তাঁরা সেই মৃত বাড়ীতে আসেন, বড় হুজুর কোরান পাঠ করেন, তাঁরাও হুজুরের সাথে সাথে পড়েন তাঁদের মায়াবী কন্ঠে।মৃতের বাড়ী গম গম করে উঠে সুরা আর রাহমানে, সূরা ইউনুস কিংবা সুরা ইয়াসীনে। আগরবাতির কন্ঠের সাথে সাথে পাঞ্জাবী, স্কার্ফ আর হালকা দাড়িওয়ালা এই কিশোর, যুবকেরা সেই মৃতের বাড়ীতে ফেরেশতা আনবার কিংবা তাঁকে পরকালে বাঁচাবার রাস্তায় নিয়ে যাবার জন্য প্রাণপণ কোরান পড়তে থাকে…হাদীস পড়তে থাকে।
সেই গৃহের মালিক বড় আনন্দ পান। মৃত মায়ের জন্য কোরান খতম দিয়েছেন, ১০ পারা পরিয়েছেন, ২০ পারা পরিয়েছেন, কি আনন্দ তাঁর। মৃত মা কিংবা বাবাকে পরকালের পুলসেরাত পার করে দিয়েছেন সেই লায়েক ছেলে।
এইসব যাবতীয় আরবী চিৎকার শেষে তাঁদের লাইন ধরে ভাত খেতে দেয়া হয়। গরম গরম ভাত, গরুর মাংশ, মুরগীর মাংশ। সালাদ…এই একটা দিন যাবতীয় চিৎকারের শেষে তাদের ভাগ্যে জোটে বেহেশতী খাবার। খাবার শেষে তাঁরা আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে বলেন ইয়া রাজ্জাকু, ইয়া রাহীমু এই তোমারই দান…
কিন্তু, এই সমাজে এই অংশটি কি জানে যে তাঁরা বেঁচে থেকেও মৃত? তাঁরা কি জানে এই সমাজে, এই পৃথিবী এই বাংলাদেশ তাঁদের সাথে প্রতারণা করেছে? জ্ঞান, শিক্ষায়, চিন্তায়, আচরণে, ভাবনায় সবকিছুতে তাঁরা পেছনে পড়ে শুধু কষ্ট নিয়ে বেঁচে রয়েছে?
তাঁরা কি জানে তাদের পুলসেরাত পার করবার যে কেউ নেই?