সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ না হলে তা হবে জাতীয় লজ্জা (ডয়েচে ভেল রিপোর্ট)

‘‘সব সরকারের আমলেই আক্রান্ত হচ্ছে সংখ্যালঘুরা” – বর্তমান সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এমান মন্তব্যই করেন৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন শুরু করে৷ বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া, জমি দখল করা, মারধোর, এমনকি সংখ্যালঘু পরিবারের নারীদের ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িতে পড়ে তারা৷ এরপর ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ৷ প্রথমদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর খুব একটা নির্যাতন না হলেও, বছরখানেক যাবৎ নির্যাতনের ভয়াবহ মাত্রা যুক্ত হয়েছে৷ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা সংখ্যালঘুদের জমি দখল করে নিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেককে দেশত্যাগেও বাধ্য করা হচ্ছে৷ অথচ সরকারের তরফ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷”

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যেখানে অমুসলিমদের সংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৭ শতাংশে৷ রানা দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘সংখ্যালঘুদের প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ রোধ করা না গেলে, তা হবে ১৯৭১-এ অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় লজ্জা৷ তাই সরকারকে এখনই দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷”

সর্বশেষ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় গত বৃহস্পতিবার রাতে এক খ্রিষ্টান দম্পতিকে মারধর করে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে যায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তর৷ সাবেক স্কুলশিক্ষক গ্যাব্রিয়েল কস্তা ও তাঁর স্ত্রী বীণা পিরিসের ঘরে ঢুকে তাঁদের পিটিয়ে অচেতন করা হয়৷ ঘটনার পর কয়েকদিন চলে গেলেও পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে দায় সেরেছে৷ কিন্তু মারধোরের কারণই এখনও তারা শনাক্ত করতে পারেনি৷ পুলিশ শুধু বলছে, ঘটনাটি রহস্যজনক৷

ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নেতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, পূজা উৎযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ ৮টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা৷ গত ৮ জানুয়ারি অনুসন্ধান দলটি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের প্রতিবেদন উপস্থান করে৷ সেখানে ৮টি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন৷

অডিও শুনুন01:40

‘ক্ষমতাসীন জোটেরও কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন৷’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনাতে এমপি দবিরুল ইসলাম সরাসরি জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ এছাড়া ফরিদপুরে ঘটনাতেও একজন মন্ত্রীর নামও এসেছে৷ পিরোজপুরের এমপি একেএমএ আউয়ালও একইভাবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করছে৷ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ক্ষত্রিয় পরিবারের ৫৫টি পরিবারের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে৷ এর সঙ্গে জড়িত এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার৷ এরা সবাই সরকারি দলের মন্ত্রী ও এমপি৷”

সেখানে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়, ‘জোরপূর্বক ভূমিদখল, সহিংস হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা একাধিকবার ঘটছে৷ পুলিশ এ সব বিষয় জানলেও, এখন পর্যন্ত এ সব ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি৷ কোনো নির্যাতনকারী গ্রেপ্তার হয়নি৷ স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাও বিস্মিত করছে৷ শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের একের পর এক একই ধরণের ঘটনা এবং তাতে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা দেখে আমরা হতবাক হচ্ছি৷’

ঐ অনুষ্ঠানে ঠাঁকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা ভুক্তভোগী জিতেন চন্দ্র সিং এমপি দবিরুলের ছেলে মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে তার ছোট ভাই ভাকারাম সিংয়ের উপর হামলার বর্ণনা দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা জমি দখল করতে এসেছিল৷ এক পর্যায়ে তারা ভাকারামকে পায়ে-পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপায়৷” ওই হামলার পর তাঁর ছেলে অভিলাল সিং পালিয়ে দিল্লি চলে গেছে বলেও জানান জিতেন চন্দ্র সিং৷

অডিও শুনুন01:40

‘ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমিই যদি দখল হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ হিন্দুদের অবস্থা কেমন হবে?’

মহানগর পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯০৮ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি ছিল ২০ বিঘা৷ বিভিন্নভাবে দখলের পর এখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি আছে মাত্র ৬ বিঘা৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমিই যদি এভাবে দখল হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের অবস্থা কত কঠিন? সারাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পুরো চিত্র মিডিয়ায় আসে না৷ কিছু আসে, কিছু লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়৷ কিন্তু একটি ঘটনায়ও কোনো আসামী গ্রেপ্তার বা বিচার পাওয়ার কোনো নজির এই সরকারের আমলেও নেই৷”

সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ দাবি করে সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি৷ একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করে সংগঠনটির নেতারা এই দাবি জানান৷ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘আমরা সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি তুলে ধরেছি৷ মন্ত্রী আমাদের প্রস্তাবকে নীতিগতভাবে সম্মতি জানিয়েছেন৷” আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷”

ডয়চে ভেলের অপর এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সরকার ও সব রাজনৈতিক দলকে দ্রুততার সঙ্গে সংখ্যালঘু সেল গঠন করে বিশেষ বিবেচনায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছি৷ একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় ঠিক পাকিস্তানি আমলের মতোই সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়নের চেষ্টা চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন জোটেরও কেউ কেউ অনাকাঙ্খিতভাবে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন৷”

শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত নির্যাতনের ক’টি সচিত্র খবরের ভিত্তিতে অত্যন্ত উদ্বেগ জানান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা৷ ২০১০ সালের শেষের দিকে গঠিত ‘শাহাবুদ্দিন কমিশন’-এর সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদও দিয়েছেন তিনি৷

২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাতটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্তবলেন, ‘‘১৫ জন আদিবাসীকে হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনসহ সাতজন আদিবাসী নারীকে হত্যা, ১২৬ জন আদিবাসীকে শারীরিক নির্যাতন, ৫৪টিরও বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া এবং উত্তরবঙ্গে ৬০টি পরিবারের ৩০০ জন আদিবাসীকে ভয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ নির্যাতনের কারণে ক্রমাগত এমন দেশত্যাগের ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমছে৷

বন্ধু, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারণ কী বলে আপনার মনে হয়? জানান নীচের ঘরে৷