বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। বিভিন্ন সময় এই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। অনেকের ধারণা, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের অনুপস্থিতি, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা, এরকম অপপ্রচার বিভিন্ন সময় ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু আসলেই কী তাই? নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা মানে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পথ বন্ধ করা। প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু ধর্মহীনতা নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা মানে একটা সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে সবাই মিলেমিশে থাকা, স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করা। বিশেষ করে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে এর গুরুত্ব আরো বেশি। কারণ, মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়কে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আর এই জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির পেছনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেছে। পরবর্তীতে এই অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে স্বাধীন এবং স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।
ধর্মকে হাতিয়ার করে চলার রীতি আজকে থেকে চলছে না। একটু পিছনে ফিরে তাকালেই আমরা দেখব, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় প্রবল পরাক্রমশালী মুসলিম লীগও ধর্মকে হাতিয়ার করে মাঠে নামে। মাত্র অর্ধযুগের ব্যবধানে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মোহ কাটিয়ে মানুষ মানবতাভিত্তিক, মর্যাদাভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতে চেয়েছে। কিন্ত আসলেই তা পেরেছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
মাঝেমধ্যে দেখা যায় ধর্ম নিয়ে কিছু বললে বা লিখলে তার সত্যমিথ্যা যাচাই-বাছাই না করেই একজনকে মুরতাদ ঘোষণা করে ফাঁসির দাবি জানানো হয়। অথচ যারা কিনা এমনটা করছে তাদের ব্যক্তিজীবনে অনেকেই হয়ত ধর্মকর্মের ধারেকাছে নেই। আবার সবসময় ধর্মীয় অনুভূতি মূখ্য হয়না। ধর্মকে ঢাল বানিয়ে আড়ালে অন্য স্বার্থ চরিতার্থ করার বিষয় থাকে। আবার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বিষয়টি তো রয়েছেই। এখন বিষয় যেটাই হোক না কেন সেই বিষয়ের অনুসন্ধান জরুরি। তার গভীরে যাওয়া জরুরী।
বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে ভোটের রাজনীতি অনেক বড় রাজনীতি। আর বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে এই ধর্ম বরাবরই অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। প্রধান দলগুলোও ধর্মকে ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যেহেতু এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এবং এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের চর্চা না করলেও এবং সারা জীবন মিথ্যা ও দুর্নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও নিজের ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থের কথিত অবমাননার খবর পেলেই লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে; ফলে রাজনীতিবিদরাও জানেন মানুষের এই হুজুগকে ভোটের মাঠেও কাজে লাগানো সম্ভব। যে কারণে আমাদের শীর্ষ রাজনীতিবিদরাও নিজেদেরকে যতটা ‘মানুষ’ তার চেয়ে বেশি ধার্মিক হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত থাকেন। সাধারণ নেতাকর্মীরাও তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের কে কত বড় ধার্মিক, ধর্মীয় বিষয়ে তাদের কার কী অবদান, কে কতগুলো উপাসনালয় বানিয়েছেন— সেই তথ্য গর্বভরে প্রচার করে বেড়ায়। মোটকথা মানুষের সিম্প্যাথী নেওয়ার জন্য নিজ নিজ নেতা/নেত্রীকে ধর্মভিরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই ভোটের দৌড়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকা যায়। সেই সুযোগ তারা হাতছাড়া কেনই বা করবে। ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে পাখি শিকার করা এদের কাছে তেমন বড় কোন বিষয় নয়।
অথচ শীর্ষ এবং আদর্শ রাজনীতিবিদদের উচিত, ধর্ম নিয়ে যতটা সম্ভব কম কথা বলা। কিন্তু তারা কম কথা বলেন না। কারণ ধর্ম তাদের কাছে ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় নয়। তারা জানেন, ধর্ম এই দেশে বিরাট রাজনৈতিক অস্ত্র— যে অস্ত্র ভোটের বৈতরণি পার হতে সহায়তা করে। অতএব কুমিল্লার ঘটনার পেছনে যে সাধারণ মুসলমান বা হিন্দুর প্ররোচনা নেই, বরং এটি যে কোনো অসৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক গেমের অংশ— তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। তবে এই রাজনীতি খুঁজতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে রাজনীতি না করে যাতে প্রকৃত অপরাধীরাই ধরা পড়ে— সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি।