বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের একটি সাধারণ ছক আছে৷ আর এখন এরসঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে৷ কিন্তু প্রশাসন ও পুলিশ সব কিছু জেনেও আগে কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷ হামলা বা আক্রমণের পর তারা সক্রিয় হয়৷
ভোলায় কথিত ফেসবুক মেসেজ নিয়ে যে সংঘর্ষ এবং হিন্দুদের ওপর হামলা হলো তা হঠাৎ করে ঘটেনি৷ অভিযুক্ত যুবক বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফেসবুক আইডি হ্যাকের ঘটনা আগেই জানতে পেরেছিল পুলিশ৷ যারা হ্যাক করেছে তাদেরও আটক করা হয়৷
পরবর্তীতে পুলিশ স্থানীয় ‘তৌহিদী’ নেতাদের সাথে বৈঠক করে৷ তারা সমাবেশ করবে না বলার পর পুলিশ আশ্বস্ত হয়৷ কিন্তু পরবর্তীতে শুধু সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনাই নয় প্রায় একই সময় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে৷
হিন্দুদের যেসব বাড়ি ঘরে হামলা হয়েছে তা থানা থেকে মাত্র থেকে দুইশ গজের মধ্যে৷ কিন্তু পুলিশ ওইসব এলাকায় আগাম কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়নি বলেই জানা গেছে৷ একটি মন্দির, একটি দোকান ও নয়টি ঘরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়৷ কিন্তু পুলিশ আগাম কোনো নিরপত্তার ব্যবস্থা নেয়নি৷ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশ না নিলে আর কে নেবে?
২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলাও হয়েছিল ঠিক একই পদ্ধতিতে৷ রসরাজ নামের একজন ফেসবুকে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে পোস্ট দিয়েছিল বলে গুজব ছাড়ানো হয়েছিল৷ পরে জানা যায় রসরাজ সেই পোস্টই দেয়নি৷ ফেসবুক সম্পর্কে তার কোনো ধারণাও ছিল না৷ কিন্ত তথ্য প্রযুক্তি আইনে পুলিশ ঠিকই তাকে গ্রেপ্তার করে৷ পেশায় জেলে রসরাজ তিনমাস কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পায়৷ কিন্তু এক্ষেত্রেও পুলিশ আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ অথচ কয়েক দিন ধরেই ওই কথিত ফেসবুক পোস্ট নিয়ে উত্তেজনা চলছিল৷ ছক কষে কেউ আর ধরা পড়ে অন্য কেউ এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হয়।
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে হিন্দুদের বাড়িঘরেও একই পদ্ধতিতে হামলা করা হয়৷ টিটু রায় নামে একজনের বিরুদ্ধে ফেসবুক ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়৷ পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ কিন্তু তদন্তে জানা যায়, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া তো দূরের কথা সে লেখা পড়াই জানে না৷ টিটুর ছবি দিয়ে আরেকজন তার নামে ফেসবুকে আইডি খুলেছিল৷ কিন্ত যথারীতি সেই মাস্টারমাইন্ড রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রামুর বৌদ্ধ পল্লিতে হামলার পেছনেও একই কৌশল অবলম্বন করা হয়৷ পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননা করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে- এ অভিযোগে ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে হামলার ঘটনা ঘটে। সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বৌদ্ধপল্লিতেও। দু’দিনের ওই সহিংস ঘটনায় আহত হন বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯টি বৌদ্ধবিহার। তখন এলাকা ও দেশত্যাগ করে কয়েকটি বৌদ্ধ পরিবার। যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল ঐ হামলার পর থেকে উত্তম বড়ুয়া নিখোঁজ আছেন৷ কি ছিলো তার উদ্দেশ্য? কেনইবা হলেন নিখোঁজ সে উত্তর মেলেনি।
এই প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে হামলার আগে পুলিশ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল৷ উত্তেজনা ছড়ানো, মাইকিং করার পরও তারা আগাম কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি৷
ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছাড়িয়ে রামু, উখিয়া, টেকনাফ, পাবনা, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, ভোলার বোরহানুদ্দিনসহ আরো অনেক জায়গায় আমরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা দেখেছি৷ প্রতিটি ঘটনায় হামলার আগে পরিবেশ নানাভাবে উত্তপ্ত করা হয়৷ আর পুলিশ যথারীতি নির্বিকার থাকে৷ এমনকি যারা এই গুজব ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধেও পরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আর হামলাকারীরাতো বিচারের আওতায় আসেই না৷
আসলে ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন চলছে ডিজিটাল উপায়ে গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়া। ২০১২ সাল থেকে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনে ফেসবুকের মত ডিজিটাল ব্যবস্থাকে গুজব ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে৷ আগে অন্যভাবে গুজব ছড়ানো হতো৷ বাকি অন্যান্য কৌশলগুলো একই আছে৷
পুলিশ ও প্রশাসন যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে এই গুজবের প্রতিটি ঘটনাই ঠেকানো যেত৷ কারণ প্রতিটি ঘটনাই পরিকল্পিতভাবে হয়েছে৷ হামলার কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রুপগুলো প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছে৷ মাইকিং করেছে, বিদ্বেষ ছড়িয়েছে এবং লোকজনকে সংগঠিত করেছে৷ আর প্রতিটি ঘটনায়ই দেখা গেছে ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার গুজব বা অন্যরা তা পোস্ট করে সংখ্যালঘুদের ফাঁসিয়েছে৷ যা আগেই পুলিশ জানত৷
তাহলে পুলিশ প্রশাসন আগাম ব্যবস্থা নেয় না কেন? এর উত্তর খুব সহজ। পুলিশের ওপর একটা রাজনৈতিক চাপ থাকে৷ একটা ভয়ের পরিবেশে তারা কাজ করেন৷ তারা সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করে তারা চায় কিছু একটার মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুকূলে নিতে কিংবা চাপ কমাতে৷ আর এই নিস্ক্রিয়তার মধ্যে একটি ব্যবসাও আছে৷ ঘটনা ঘটলে মামলা হয়৷ এর বেনিফিট বেশি৷ মামলা হবে, অজ্ঞাতনামা আসামি হবে৷