বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা সব সময়ই ঘটে এসেছে এবং এর কোন প্রতিকারও হচ্ছেনা। মূলত রাজনৈতিক অস্থির অবস্থা এবং নীতিহীন রাজনীতি এর জন্য দায়ী৷ বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলের পরিচিতি বা সমর্থন ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম কিংবস একেবারেই নেই বললেই চলে৷ তাই এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা সব সময়ই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এই ধরনের অপরাধ করে বেড়ায়। যেহেতু এই মূহূর্তে বাংলাদেশে শাসক দলের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তেমন কোনো অবস্থান নেই বললেই চলে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সরকারি দল বা সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে দুষ্কৃতকারীরা বা ওই দলের নেতা-কর্মীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতেই পারে৷ এটা একচেটিয়া নীতিহীন রাজনীতিরই ফল৷
এই দেশে এই পর্যন্ত যেসব সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা দেখা গেছে, তার সিংহভাগেরই টার্গেট হলো তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দখল ও নারী৷ আর আমাদের দেশের যে-কোনো সরকারেরই প্রশাসনিক লোকজন এই সব নির্যাতন-নীপিড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব সময়ই উদাসীন৷ এর একটা কারণ হয়তো ঘটনাগুলাতে বেশিরভাগ সময়ই শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত বা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা লোকজনই জড়িত থাকে৷ আমরা সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরের ঘটনা যদি দেখি, তাহলে দেখবো, তারা ক্ষমতা কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ৷ অধিকাংশ ঘটনায়ই যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন অথবা তাদের আশপাশের লোকজনই এইসব ঘটনায় জড়িত৷ সেটা জেলা বা উপজেলা যেখানেই হোক না কেন৷ রক্ষকই যেন ভক্ষক এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে যেকোন ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷ এর কারণ কি? সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার৷ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য, সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তি লুটপাট ও ভোগ-দখল করার জন্য, সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার জন্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন সময়ে নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সহ অনেক মানবতাবিরোধী কাজ করে থাকে৷ এটা এতটাই নির্মম, পাশবিক, হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী যে, তখন আর কিছুতেই মানুষ হিসেবে দাবি করা যায় না, বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র৷
এটা কেমন দেশ কিছু হলেই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকজন, যারা সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়িতে হামলা করে প্রকৃত পরিস্থিতি অন্য কোনো দিকে আড়াল করতে চায়৷ সংখ্যালঘুদের উপর রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক কোন ধরনের হামলাই গ্রহণযোগ্য নয়। সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি যারা করেন তারা আসলে বিবেকহীন৷ তাদের মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুরা আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অংশ এবং আমাদের জন্য গৌরবের৷ এই দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে তাদের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই৷
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকেও যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতির কবর রচনা করতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। শুধু একটি লাল সবুজ পতাকা এবং একটি ভূখণ্ডের জন্য হয়নি।
একটি কঠিন বাস্তবতা হলো- অধিকাংশ মানুষই ব্যক্তিজীবনে ধর্মের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন না করলেও নিজধর্মের কোনো বিষয়ে ভিন্নমত শুনলেই তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যে মানুষটি নিজে অন্যায় করে, ঘুষ খায়, মানুষ ঠকায়, মিথ্যা বলে— অথচ কেউ যখন কোনো ধর্মীয় নেতা বা ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে তখন তারাই সবার আগে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে বলে হামলা-মামলা করে।
এই অবস্থা থেকে একদিনে সরে আসা না গেলেও ধীরে ধীরে সরে আসতে হবে আর সেজন্য শিক্ষা হতে হবে উদার মানবতার। এই উদারতা প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবেও। তা না হলে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। নৈতিকতার শিক্ষা নিয়ে তবেই কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যাবে। আর বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই এই মুক্তচিন্তাধারা থেকে সরে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে থামছে না কিংবা কমছে না সংখ্যালঘুদের উপরে হওয়া নির্যাতন।