কোরআন অবমাননা এবং মন্দিরে হামলা 

বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রধান এবং প্রথম শর্তও এটি। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায়- অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার রোধ ও ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা। এক কথায়: ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।
কিন্ত দেখা গেছে এই ধর্মের ঘারে বন্দুক রেখে বারবার এই বাংলার মাটিকে রক্তাক্ত হতে। হিন্দুদের উপাসনালয় মন্দিরে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ থাকার কথা নয়। একইভাবে মুসলমানদের প্রার্থনালয় মসজিদেও হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গীতার প্রয়োজন হয় না। কারণ দুই ধর্মের প্রার্থনার পদ্ধতি ভিন্ন। সুতরাং কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন শরিফ অবমাননা করা হয়েছে বলে যে গুজব অথবা খবরের ভিত্তিতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল, সেখানে খতিয়ে দেখা দরকার, কে বা কারা মন্দিরে কোরআন রেখে এসেছেন। সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো লোক মন্দিরে কোরআন রেখে আসবেন আর এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে— সাধারণ মানুষ এতটা অবিবেচক নয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো লোক অবমাননার উদ্দেশ্যে ওই মন্দিরে কোরআন নিয়ে গেছেন— এটা ভাবার যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি কোনো সাধারণ মুসলমানও হিন্দুদের ওপর দোষ চাপিয়ে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর জন্য সেখানে কোরআন রেখে আসবেন— সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রশ্ন হলো- আসলেই মন্দিরে কোরআন ছিল কি না? থাকলে কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে সেখানে কোরআন রেখে এসেছেন? আর কেউ যদি সৎ বা অসৎ যেকোনো উদ্দেশ্যেই মন্দিরে কোরআন রেখে আসেন, তাতে কোরআনের অবমাননা হয়েছে কিনা? কারো অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য কোন ধর্মগ্রন্থের পবিত্রতা নষ্ট হতে পারেনা।
আমরা খুব সহজেই অতীত ভুলে যাই। আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) যখন পবিত্র কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করলেন, তখন কিন্ত কেউ কোরআনের অবমাননা হয়েছে বলে অভিযোগে করেনি। কেউ তখন এই প্রশ্ন তোলেনি যে, একজন হিন্দু কেন কোরআন শরিফের অনুবাদ করবেন? কেউ তখন এটা বলেনি যে, যেহেতু একজন হিন্দু কোরআনের অনুবাদ করেছেন, অতএব কোনো মুসলমানের এই অনুবাদ পড়া উচিত নয়। কুরআনের অপমান করা হয়েছে কিংবা কুরআনের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে।
কোরআন শরী এমন এক গ্রন্থ যা শুধু মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। সুতরাং কোনো মন্দিরের পুরোহিত বা পূজারি যদি মনে করেন যে, আন্তধর্মীয় সম্পর্ক বোঝানোর জন্য তারা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করবেন, সেজন্য কেউ যদি কোরআন শরিফ মন্দিরে নিয়ে যান, যদি এখানে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে কী তখন কুরআন অবমাননা করা হয়েছে বলা যাবে?
আবার কোনো মসজিদের ইমাম যদি মনে করেন যে, তিনি হিন্দুদের কোনো দর্শন সম্পর্কে জানা বা বোঝার জন্য গীতা পড়বেন, এমনকি জুমার খুতবায়ও তিনি যদি মনে করেন যে, এটা থেকে রেফারেন্স দেবেন—তাতে কি গীতার অবমাননা হবে এবং এজন্য মসজিদে হামলা চালানো হবে? সব ধর্মের মূল বাণীই তো হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের অবমাননা হয়েছে— এই যুক্তিতে মানুষ কী করে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালায়? ধর্মীয় অনুভূতি এত ঠুনকো হলে সেই দায় কার?
কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা এবং এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেককে গ্রেপ্তারের পরে যে প্রশ্নটি বার বার সামনে আসছে তা হলো- ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা বা মানদণ্ড কী? অর্থাৎ কোন বক্তব্যে বা কী কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে?
মানুষের যদি বাকস্বাধীনতা থাকে আর সংবিধান যদি নাগরিকের বাকস্বাধীনতা স্বীকার করে নেয় তাহলে সেই নাগরিকরা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কেন প্রকাশ্যে, উপাসনালয়ে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা ও বিতর্ক করতে পারবে না? আন্তধর্মীয় বিতর্কও হতে পারে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই বিতর্ক প্রয়োজন। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোয় অবস্থা এমন হয়েছে যে, ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে কথা বললেই সেখানে অবমাননার গন্ধ খোঁজা হয়। এর ফলে গঠনমূলক আলোচনা কিংবা সুস্থ বিতর্কের স্পেসও সংকুচিত হচ্ছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা এবং তারপরে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এটি কোনো ধর্ম সমর্থন করে? কোরআন অবমাননা হয়েছে বলে একজন লোককে পিটিয়ে মারা তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা, মন্দিরে হামলা, হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ এর নাম কিভাবে ইসলাম হয়? এসব স্পষ্টতই ইসলামের অবমাননা। কোনো মন্দিরে হামলা বা প্রতিমা ভাঙচুরই ইসলামের অবমাননা। ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, তাদের জানমালের ক্ষতি করা বরং ইসলামের অবমাননা।
মানুষ কেন ‘ধর্মের অবমাননা’ হয়েছে শুনলেই উত্তেজিত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং হত্যার মতো জঘন্য কাজে শামিল হয়? ধর্মীয় শিক্ষার কোথাও কি তাহলে একটা বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে? ধর্মের উদ্দেশ্যই যেখানে মানুষকে আরও বেশি মানবিক ও সহনশীল করা, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ শুনলেই মানুষ কেন হিংস্র হয়ে ওঠে? এই ধর্মান্ধতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়।