বাংলাদেশে বরাবরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আসছে আর এর পিছনে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল এবং নীতিহীন রাজনীতি দায়ী৷ বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সরকারী দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম৷ একেবারে নেই বললেই চলে৷ তাই এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা সব সময়ই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যায়। যার ফলাফল এ ধরনের অপরাধের বিস্তার।
কেবল ধর্ম অবমাননার গুজব তুলেই নয় জাতীয়সহ বিভিন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও চলে ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন। এককথায় স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে সব সময়ই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মামলা হয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয় প্রতিশ্রুতি। চলে দোষারোপের রাজনীতি। কিন্তু কিছুদিন যেতেই এই ইস্যু চাপা পড়ে যায়। অপরাধীরাও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে।
একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৭৫ পরবর্তী কোনো জাতীয় নির্বাচন সংখ্যালঘুদের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। এনেছে নির্যাতন আর আর্তনাদ। অনেকেই ঘরবাড়ি হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মন্দির-মণ্ডপে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা প্রচুর ঘটেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের এইসব ঘটনার কুশীলব হিসেবে ছিলেন পরাজিত ও জয়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও দলীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সংখ্যালঘু অজুহাতে নির্যাতনের সময় নীরব ভূমিকা পালন করে এসেছে । অতীতের রেকর্ড সেই প্রমাণই দিচ্ছে। যা কেবল হতাশই করে সংখ্যালঘুদের।
পরিসখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুন হারে বেড়েছে হিন্দু নির্যাতন। ২০১৯ সালে সারা বছর ধরে যে পরিমান নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, ২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসেই তার চেয়ে বেশি হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে সারা বছরে হত্যা করা হয়েছিল ১০৮ জনকে, ২০২০ এর ৬ মাসেই হত্যা করা হয়েছে ৭২ জনকে। ২০১৯ সালে আহত করা হয়েছিল ৪৮৪ জনকে, এদিকে ২০২০ এর প্রথম ৬ মাসেই আহত করা হয়েছে ৫১২ জনকে। ২০১৯ এ বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল ৪৩৪টি পরিবারকে আর ২০২০ এর প্রথম ৬ মাসেই বসত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪৮৯টি পরিবারকে, উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ টি পরিবারকে, উচ্ছেদের হুমকি পেয়েছে ১ হাজার ৮০১ পরিবার।
এরপরে করোনা ভাইরাসের দুর্যোগময় মুহুর্তেও ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’র মত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মঠ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা, জমি দখল, দেশ ত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ৫০০টি আদিবাসী পরিবার, ৪৫টি হিন্দু পরিবার এবং গারো, ত্রিপুরা এবং মারমাদের ৪০টি গ্রাম শুন্য হয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায় ভারত ও মায়ানমারে আশ্রয় নেয়। গত ৬ মাসে ১৫ জন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, ২ জনকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। ২ হাজার ৪৮৬ জনকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ২৯৩ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা করা হয়েছে। ৭টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের ঘটনা ঘটেছে। মিথ্যা মামলা হয়েছে ৬৯টি, মিথ্যা মামলায় আসামী, গ্রেফতার, বরখাস্ত করা হয়েছে ৩৩ জনকে, ৩৪৩টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ৫টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অপবিত্র করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেয়া হয়েছে ১৫টিতে। গরুর মাংস খাইয়ে অপবিত্র করা হয়েছে ৫০ জনকে। মিথ্যা রাজাকার বানানো হয়েছে ৩ জনকে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ২৫টি। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে ৭ লাখ হিন্দু শিক্ষার্থীকে ধর্মীয়ভাবে আঘাত দেয়া হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কখনোই সেই অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করে নাই। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ধিক্কার জানালেও সেই সমস্ত নির্যাতনকারী অপরাধীদের একজনও শাস্তি পায়নি। হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছে। কিন্তু সরকার দাবী দুটির প্রতি কর্ণপাত করে নাই। যে কারনে দিন দিন হিন্দু নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
একটি স্বাধীন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের জানমাল, সম্পদ নিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, ধর্মপালনসহ যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করবে, সেটা তার নাগরিক অধিকার। এখানে কে শ্রেষ্ঠ, কে বড়, কে ক্ষুদ্র এজাতীয় কোনো আলোচনার অবকাশ নেই। আর এই বক্তব্য সুস্পষ্ট করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।রাষ্ট্র তার আইন, কাজ ও ন্যায়গত আচরণ দিয়ে দেশের সকল জনগনের দেখভাল করবে।
এইদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুরা যদি নির্যাতনের শিকার হয় রাষ্ট্রকে সেই দায় নিতেই হবে, এর জবাবদিহি করতেই হবে। যে রাষ্ট্র নিজেই নিজের কপালে ধর্মের টিকিট লাগিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাকেই প্রমাণ করতে হবে, সব ধর্মের অধিবাসীরাই তার সন্তান। আইন তার নিরপেক্ষ গতিতে সবার জন্যই সমান বিচার করে। সেখানে দল-মত-ধর্ম কিছুই প্রাধান্য পায় না।
দিন শেষে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরাও নিশ্চিতভাবেই ‘সব’ জনগণের আওতাভুক্ত, এ কথা আশা করি রাষ্ট্র-প্রশাসনও বিশ্বাস করেন।