বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের অংশগ্রহণকে একটা শ্রেণী কখনোই ভালো চোখে দেখে নাই। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা সে জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, আর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি মূলত এরাই ছিল। শিক্ষিত, চাকুরে, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
কিন্তু জিয়াউর রহমান, এরশাদের আমল থেকে এ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। সামাজিক পরিবর্তন প্রভাবক ছাড়া অনেক ধীর গতির একটা প্রক্রিয়া। প্রভাবক আসামাত্র প্রক্রিয়াটি কয়েকমাসের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়।
আমাদের সেক্যুলার শিক্ষিত সমাজ এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। তারা এখনো সেক্যুলারিস্ট ইউটোপিয়ায় বাস করছেন। এখনো তাদের ভাবনায় দেশে সকাল হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে, আর রাত হয় বাঙালিত্বের পরিচায়ক কোনো রিচুয়ালের মাধ্যমে। কিন্তু এ ব্যাপারটা আর সে রকম নেই এখন।
ডেটলাইন ২০১৩ঃ শাহবাগে চলছে সেক্যুলারদের উচ্ছাস। রাজাকারের ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে সেখানে। বাঙালিত্বের সকল উপাদান সেখানে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী লোক।সে কারণে শাহবাগের সাথে আমি একাত্ম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানাই। তবে সেখানে অনেকেই জেনুইন ফিলিং নিয়ে গেছিলেন এটা সত্য।
তবে তাদের অজান্তে সংগোপনে এই আন্দোলনের টেকওভার হয়ে যায় ছাত্রলীগের দ্বারা। আন্দোলনকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল ছাত্রলীগ আর পুলিশ। জনবল যোগাচ্ছিল আওয়ামীলীগের ঢাকা এবং আশেপাশের লোকেরা। পাপেট হিসাবে ইমরান এইচ সরকারকে রাখা হয়, কিন্তু মূল পাপেট মাস্টার সিদ্দিকী নাজমুল আলম।
দেশের বড় বড় মিডিয়া হাউজ ব্যাপারটি বুঝতে পারে নি। বা বুঝলেও এটা নিয়ে আলাপ করার প্রয়োজন বোধ করে নি। কারণ শাহবাগে যারা যায় ওরাই ওদের পত্রিকা/টিভি চ্যানেলের পাঠক/দর্শক। তো শাহবাগে যারা ফাঁসির দাবি তুলে তারাই প্রথম আলো কিনে পড়ে, আর তাদেরই দরকার প্রথম পৃষ্ঠায় ফ্রিজ/টিভি/এসির বিজ্ঞাপন। এর বাইরের জগতটা, ভোগবাদের বাইরের বাংলাদেশকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া।
সেই খালি মাঠকে কাজে লাগিয়েছে বাঁশেরকেল্লা, আমার দেশ আর জামাতপন্থী লোকেরা।
গ্রামে গঞ্জে শাহবাগকে নাস্তিক হিসাবে দেখানোর কাজটা করেছে আমার দেশ। মাহমুদুর রহমানের কোনো ক্ষমতাই ছিল না বাণিজ্যিকভাবে প্রথম আলোকে টক্কর দেবে। কিন্তু জামাতের ছেলেপেলেরা তার পত্রিকাকে ফটোকপি করে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিল তাদের রাজনৈতিক নেতাদের বাঁচানোর জন্যে। ব্যাপারটা একেবারে সিম্বায়োটিক।
সেক্যুলার এলিটদের মূলধারার বাইরে একটা স্রোত ঢাকামুখী হলো যার মূল নেতৃত্বে হেফাজত, যার মাস্তুলে মাহমুদুর রহমান, আর যার লক্ষ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন। এদের ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায় নি কারণ এরা অচ্ছুতজাতি, এরা অশিক্ষিত, গোয়ার। এদের মসীহা হয়ে দাঁড়ালেন ফরহাদ মজহাররা। তিনি তার বাম ধারার বাস্টার্ডাইজেশন থেকে এদের দেখালেন প্রলেতারিয়েত হিসাবে, এদেরই ডিকটেটরশীপ হবে দেশে এখন।
আওয়ামীলীগ পড়লো দোটানায়। মাহমুদুর রহমানের আনা সুনামি তাদের নৌকাকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম, আবার সেক্যুলার এলিটদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন ছাড়া এরা এই ঝড়কে পার করতে পারবে বলে মনে হচ্ছিল না। আওয়ামীলীগ দুই গ্রুপকেই মাইর দিলো। একটা মূহুর্তের জন্যে আওয়ামীলীগ ফ্যাসিবাদের স্বাদ পেয়ে গেল। একই রাতে শাপলা চত্বর আর শাহবাগ খালি করে ফেললো আওয়ামীলীগ। ওরা এখন কারোর পক্ষেই না।
শাহবাগীদের বাঁচার তাড়না থেকে তারা নিজেদের উচ্ছেদকেও সমর্থন দিলো। Awamileague thought they can never lose this!
শাহবাগের উচ্ছেদে হেফাজতও কিছুটা শান্ত হয়ে গেল। কারণ হেফাজতের নেতারা যদিও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস নিয়ে এসেছিলেন, তাদের তৃণমূল এসেছিল নাস্তিকদের উচ্ছেদ করতে। তারা সফল। তাই বিপ্লব দ্বিতীয়বার করার বিড়ম্বনায় তারা আর গেলেন না।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামীলীগ সুবিধা পেয়ে গেল। বিএনপি হেফাজত নেতাদের সাথে যে এরেঞ্জমেন্টে এসেছিল সেটা ভেস্তে গেল কারণ হেফাজত কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ না।
আওয়ামীলীগ এভাবেই ২০১৪’র তুফান পার হলো।