হুমায়ুন আজাদের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ, ১৯৯৫। বিডিনিউজ।
রাইসু: আপনার নারী নিষিদ্ধ হওয়ার পর ইত্তেফাক-এ আল মাহমুদ বললেন যে, আপনার লেখার বক্তব্য ও মনোভাব নাকি কুৎসিত। এবং আপনার বইয়ের মাধ্যমে ক্ষতি যা করার তা নাকি করা হয়েছে। এখন আড়াই বছর পরে এই বই বাজেয়াপ্ত করা অর্থহীন। আপনার সতীর্থ আল মাহমুদ, তিনি এ-রকম বললেন!
হুমায়ুন: আল মাহমুদ, একটি অমার্জিত রুচিসম্পন্ন, অসৎ, কপট মানুষ। এই আল মাহমুদ অনেক আগে পাড়ার মসজিদ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনে আনন্দিত হয়ে কবিতা লিখেছে। যে, ‘হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে পাড়ার মসজিদ’। সে জায়নামাজে বসে পরস্ত্রী সঙ্গমের স্বপ্ন দেখে। তার কবিতার মধ্যে রয়েছে। যে একসময় কৃষকেরা এসে সচিবালয় দখল করে ফেলবে এবং দেশে কৃষকের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এই স্বপ্ন দেখেছে। এখন সে একটি রুচিহীন, অসৎ, কপট, জামাতী মৌলবাদী। এবং তার মধ্যে একটি মজার কপটতা হচ্ছে সে যখন বাংলাদেশের পত্রিকায় কবিতা লেখে তখন সে ইসলামের কবিতা লেখে। আর যখন ভারতীয় পত্রিকায় কবিতা লেখে তখন হিন্দু আর বৌদ্ধের কবিতা লেখে। আমি কয়েকদিন আগে তার একটি কবিতা দেখেছি যেখানে সে নিজেকে গৌতম বুদ্ধ হিসেবে দেখেছে। যে, সে যেন পূর্বজন্মে গৌতম বুদ্ধ ছিলো। এইটি একটি অত্যন্ত কপট লোক, এবং সুবিধাবাদী। সে জামাতের অর্থেই এখন পালিত বলে আমি শুনেছি। তার কথায় কিছু আসে যায় না। তার কবিতা সেই ষাটের দশকেই শেষ হয়ে গেছে।
রাজু: তিনি কবে থেকে শুরু করেছেন?
হুমায়ুন: পঞ্চাশের দশকে শুরু করেছিলো, ষাটের দশকে কয়েকটি বই বেরিয়েছিলো। সত্তর আশি এরপর যে সমস্ত কবিতা লিখেছে এগুলো কিছু না।
রাইসু: এগুলো তার ঐ মন্তব্যের কারণে বলছেন স্যার?
হুমায়ুন: তার সম্পর্কে যে দু’চারটি মন্তব্য আমার কয়েকটি প্রবন্ধে করেছি তা-ও একই। ও, আরও একটি কারণ হতে পারে। সে আমার ওপর ক্ষিপ্ত নানা কারণে। একটি কারণ সম্ভবত, ওর একটি খুবই আত্মগর্বী কবিতা ছিলো যে, ‘আমার মাকে যেন কেউ গোলামের গর্ভধারিণী বলতে না পারে’। ঐ কবিতাটিকে আমি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে একটি কবিতা লিখেছিলাম। নাম ‘গোলামের গর্ভধারিণী’। আমি দেখিয়েছিলাম যে, আপনার এই পুত্রটি যদি, হে জননী, এই তিতাসের পাড় ছেড়ে ঢাকায় না আসতো তা হলেই ভালো হতো। আপনার ছেলেটি হয়তো মাছ ধরতো তিতাসে। বা রাখালের কাজ করতো। ভালো থাকতো। এই ঢাকায় মোগলদের শহরে এসে সে যে নষ্ট হয়ে গেছে। সব প্রভুকে সেজদা করতে করতে এখন তার পিঠে একটি বড় রকমের কুজ্ব দেখা দিয়েছে। এখন তার দিকে তাকালে একটি কুজ্বই চোখে পড়ে। আর কিছু চোখে পড়ে না। এখন আপনার যখন মৃত্যু হবে তখন হয়তো দেখবেন যে আপনার কবরের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে এবং শব্দ হচ্ছে যে এখানে একজন গোলামের গর্ভধারিণী ঘুমিয়ে আছে। এবং আল মাহমুদ এখন গোলাম আল মাহমুদের মতো আচরণ করছে।
রাজু: তো এটা স্যার ব্যক্তিমানুষকে আক্রমণ করা হয়ে গেলো না?
হুমায়ুন: আচ্ছা, ব্যক্তি এবং কবিকে আমরা কীভাবে পৃথক করবো? এটা পারি না। এখন বলবো, তিনি কবি হিসেবে এই, আর ব্যক্তি হিসেবে এই — এটা এই সময়ে করা যাবে না। আমরা অবশ্যই দেখবো যে, এই কবিটি ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলো — সৎ ছিলো না অসৎ ছিলো। এটা আমাদের দেখতে হবে। এর রুচি কেমন ছিলো। আরো বলা ভালো যে, এই আল মাহমুদ এরশাদের সময় এরশাদীয় দলে ছিলো, আবার এখন বোধহয় জামাত এবং অন্যান্য শক্তিমানদের সঙ্গে রয়েছে। সুবিধাবাদী মানুষ।
রাজু: আচ্ছা এটা কি সাহিত্যকে কোনোরকম ক্ষতি করে কিনা?
হুমায়ুন: সুবিধাবাদী মানুষের সাহিত্য আসলে সাহিত্যই নয়। আল মাহমুদের যে কিছু লেখা এখন কবিতা নামে ছাপা হয় ওগুলো কবিতাই নয়। ওগুলো হচ্ছে কতগুলো বাজে কথা। ওর একটি আত্মজীবনী আমি পড়েছি। এবং পড়ে মজা পেয়েছি এই জন্য যে পাতায় পাতায় মিথ্যে কথা রয়েছে।
রাইসু: স্যার, মিথ্যে কথাই তো শিল্প, একঅর্থে?
হুমায়ুন: না, মিথ্যে কথা শিল্প নয়।
রাজু: তবে কি সত্য কথা?
হুমায়ুন: সত্য কথাও যে শিল্প হবে তাও নয়। শিল্প মিথ্যা এবং সত্যর বাইরের ব্যাপার। অন্তত এই সামাজিক সত্য এবং মিথ্যার বাইরের ব্যাপার।
রাজু: তার মানে একটি পরম সত্যের দিকে যেতে চায় সে?
হুমায়ুন: পরম সত্য কাকে বলে আমি ঠিক জানি না। আমরা —
রাইসু: অন্য দিকেই গেলে ভালো — ?
রাজু: আচ্ছা স্যার, এই সরকারের আমলে তো আপনি বোধহয় বাকস্বাধীনতার পঞ্চম শিকার।
হুমায়ুন: শিকার বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কারণ আমি মনে করি না যে এই সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করে রাখতে পারবে। আমি এই বইকে নিষিদ্ধ বলেই গণ্য করছি না। আর আমার এক বন্ধু খুব মজা করে বলেছে যে, এই সরকার চলে যাচ্ছে, সঙ্গে তোমার বইটিও নিয়ে যাচ্ছে।
রাইসু: স্যার, আপনি নাকি আঁতাত করে বইটি নিষিদ্ধ করিয়েছেন?
হুমায়ুন: তোমাদের মতো ফাজিলদের সঙ্গে কথা বলা সময়ের অপচয়।
রাইসু: তো, এই যে নিষিদ্ধ করলো, এই নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে একটা প্রবচন বলেন।
হুমায়ুন: … “প্রতিটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ মানুষকে জানিয়ে দেয় যে বর্বররা এখনও সভ্যতাকে দখল করে আছে।”
রাজু: যে সরকার বই নিষিদ্ধ করতে পারে তাদের কাছে বাকস্বাধীনতা চাওয়ার কোনো ব্যাপারই থাকে না। সেক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানেরও স্বাধীনতা থাকার কথা না। এখন আমরা জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি কীভাবে?
হুমায়ুন: বিষয়টি বেশ বড়। প্রথম হচ্ছে যে স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না। স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হয়। এমন নয় যে আমাকে সমস্ত স্বাধীনতা লেখায় দিয়ে দেয়া হবে। এবং আমি আনন্দের সঙ্গে লিখতে থাকবো। স্বাধীনতা প্রতিটি লেখক সৃষ্টি করে নেয় নিজের জন্য। অনেক সময় দণ্ডিত হয়, অনেক সময় দণ্ডিত হয় না। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমানের অবস্থা এবং জ্ঞানের অবস্থা এবং স্বাধীনতা। আমি মাঝে মাঝে একটু দুঃখই পাই যে এই বাঙালি মুসলমানের বিকাশ নানাভাবে প্রতিহত করা হয়। এবং সারা পৃথিবীতে মুসলমানের বিকাশকেই প্রতিহত করা হয়েছে। এই ধর্মানুভূতির নামে। বাঙালি মুসলমান এইজন্য অনেক পিছিয়ে আছে। তার জ্ঞানের জগৎ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। আমাদের যদি জ্ঞানচর্চার অধিকার দেয়া হতো, তাহলে আমাদের নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে আমরা আরো গভীরভাবে জ্ঞানচর্চা করতে পারতাম। মুসলমান সমাজে, সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যেই কিন্তু এটা হয়েছে। যে, বড় বড় প্রতিভারা এই সমস্ত সংকটে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই। বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস হচ্ছে দেখবে এই প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের তর্ক-বিতর্ক এবং দ্বন্দ্বের ইতিহাস। ফলে ঐ দ্বন্দ্ব করতে করতেই, তর্ক করতে করতেই ওদের জীবন শেষ হয়ে গেছে। একটি ভালো বইও আর লেখা যায় নি। আমরা বাঙালি না মুসলমান এই তর্ক করতে করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছি। ফলে বাঙালি মুসলমান এখন সব বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করতে পারে না। তাকে চিন্তা করার অধিকারই দেয়া হয় নি। এজন্যই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় না। আমাদের বিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় না। এবং আমাদের সমাজে নতুন জ্ঞানের অভাব অত্যন্ত প্রকট। আমাদের রাষ্ট্র সাধারণত যারা চালায় তাদের জ্ঞানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ক্ষমতা দখল করে এবং ক্ষমতাকে উপভোগ করে যেতে পারলেই সুখে থাকে। জ্ঞান চুলায় যাক, তাদের কাছে জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু একটি জাতি যদি বিকশিত হতে চায়, তার স্বাধীনতা থাকা দরকার। সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা এবং সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা। আমরা নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। আমি মুসলমানদের ক্ষেত্রেও যে জিনিসটা মাঝে-মাঝে বোধ করি, যেমন ধরো যে মুসলমানদের প্রাচীন ইতিহাস — মুসলমানদের প্রধান প্রধান ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা কিন্তু বলা যাক, প্রশ্ন করতে পারি না। তাদের জীবনকে, তাদের কর্মকে, তাদের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করতে পারি না। ফলে তাদের সঙ্গে কিন্তু আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক হয় না। আমরা একটা ভীতির মধ্যে থাকি। যদি আমরা প্রধান ব্যক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে পারতাম, হয়তো আমরা অনেক সীমাবদ্ধতা বের করতে পারতাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের আমরা ভালোও বাসতে পারতাম। এখন তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালোবাসার হয়ে উঠছে না। এটা মুসলমানদের জন্য একটি ক্ষতিকর দিক। এইজন্য একদল মৌলবাদী হয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু, বলা যাক, ঐ প্রাচীন যারা আছে তাদের মেনে মেনে একেবারে… তাদের মানাই হচ্ছে মুসলমান। আরেকদল আমাদের মতো হয়ে যাচ্ছে।
—————————————————————–
রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমি কিছুতেই বিনা প্রশ্নে তার সমস্ত সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করবো না।…তেমনি যদি আমাদের এ-অধিকারটুকু থাকতো যে মুসলমানদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে আমরা পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবো তাহলে একটি সুস্থ্য চিন্তাশীল মুসলমান জাতি গঠিত হতে পারতো। এই সংকীর্ণ মুসলমানরা মুসলমানদের বড় শত্রু।
—————————————————————–
যেমন, আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানান রকম প্রশ্ন পোষণ করে থাকি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমি কিছুতেই বিনা প্রশ্নে তার সমস্ত সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করবো না। তার সব কবিতাকে মহৎ কবিতা বলে গ্রহণ করতে রাজি নই। ঠিক তেমনি যদি আমাদের এ-অধিকারটুকু থাকতো যে মুসলমানদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে আমরা পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবো তাহলে একটি সুস্থ্য চিন্তাশীল মুসলমান জাতি গঠিত হতে পারতো। এই সংকীর্ণ মুসলমানরা মুসলমানদের বড় শত্রু।
ঢাকা, ২৩/১১/১৯৯৫