সমকামিতা আর এই ঘুণে ধরা সমাজের কিছু প্রশ্ন, পর্ব -১

সমাজের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সমস্যা জর্জরিত প্রশ্নবাণ একে একে সামনে এসে যায় যখন কোনো সমকামী মানুষ এই সমাজের আর ৫/১০ জন মানুষের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায়। বেঁচে থাকতে চায় তাদের মত করে। সমাজবদ্ধ এই মানুষগুলো অতি পরিচিত যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয় আমার মত সমকামী মানুষগুলো, সেগুলো এতটা সহজ বা স্বাভাবিক প্রশ্নগুলোর মত হয় না। অদ্ভুত সব প্রশ্ন। এই যেমনঃ    

সমকামিতা অর্থই অবাধ যৌনতাকে সমর্থন তা ঠিক না। তবুও কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর বার বার দিতে হয়। এমনকি আমার বন্ধুদেরকেও দিতে হয়েছে বহুবার। আমি এখানে পয়েন্ট আকারে সেগুলো তুলে ধরছি।

১) সমকামিতা কি একটি মানসিক বিকৃতি?

উত্তরঃ

না, একেবারেই না।

১৯৯৩ সালের আগে মেডিক্যাল সায়েন্স-এ মনে করা হতো যে, এটা মানসিক রোগ। কিন্তু বিস্তর গবেষণায় দেখা গেছে, এটা কোন মানসিক রোগের শর্ত পূরণ করে না। যেমন, সমকামীরা অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই, সামাজিক বা প্রফেশনাল কাজে সমান পারদর্শী। বস্তুতপক্ষে, এদের মন মানসিকতা অনেক উদার, নরম, অন্যের প্রতি মায়া মমতায় ভরা। এ কারণেই, ১৯৯৩ সালে মনোরোগের টেক্সট বই থেকে রোগ সমকামিতাকে তুলে নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর সকল মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মিলে এদের বিরুদ্ধে কোন বৈষম্য করাকে বেআইনি বা অন্যায় বলে মতামত দেন।

খুব সাধারণভাবে সবার জন্যে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশিরভাগ রোগ, বিশেষ করে ক্রনিক রোগগুলোর জন্যে বহুবিধ কারণ দায়ী। এটাকে বলা হয় মাল্টি ফ্যাক্টোরিয়াল মডেল। যেমন ধরুন স্তনের ক্যান্সার। কারো স্তন ক্যান্সারের বংশগত জিন শরীরে থাকে, কিন্তু তা থাকলেই যে রোগ হবে, এমন কথা নেই। হয়তো খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, বয়স ইত্যাদি অন্যান্য ফ্যাক্টর বা উপাদান মিলিয়ে একজনের স্তন ক্যান্সার হয়। ডায়াবেটিসও তাই। শরীরে জিন থাকে কিন্তু তারপরও খাবারের অভ্যাস, ব্যায়াম না করা, এমন কি কী পরিবেশে বড় হলো – সব মিলিয়ে তার রোগটি হবে।

সমকামিতার ব্যাপারটাও তাই। আগে ডাক্তার, বিজ্ঞানী কেউ বুঝতে পারে নি যে, এটা কোন রোগ না। মানসিক রোগের কোন শর্তও এটা পূরণ করে না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ, যাদের আমরা প্রতিদিন দেখি, তারা সমকামী, কিন্তু সামাজিক, নৈতিক, প্রফেশনাল দিক থেকে এরা অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতোই। বিজ্ঞানে যা এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা হলোঃ এদের শরীরে একটি বিশেষ জিন (জিনেটিক প্যাটার্ন) থাকে যা বিষমকামীদের থাকে না। কিংবা, পৃথিবীর কেউ-ই ১০০ ভাগ সমকামী বা ১০০ ভাগ বিষমকামী হয়ে জন্মায় না। এদের মস্তিস্কের নিউরনের নিউরোট্রান্সমিটার, হরমোন এগুলোও কিছুটা ভিন্ন। অন্য আরেকটি ফ্যাক্টর হলো ‘এপিজিনেটিক’ যা পরিবেশ এমন কি বাবা-মার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও যুক্ত।

তাহলে একজন সমকামী হবার পেছনে অনেক কারণ যুক্ত যার অনেকগুলোই নিজেদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। এসব জানার পরে কেন আমরা তাদের ঘৃণা করবো? শুধু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে এ ছাড়া আর কোন যুক্তি নেই। অন্যান্য যুক্তিগুলো আমার নোটে দিচ্ছি। কারো ডায়াবেটিস হলে তাকে কি আমরা ঘৃণা করি? করি না। অন্যদিকে কেউ প্রেগন্যান্ট  হলে বলি “অমুকে অসুস্থ”। আসলে প্রেগন্যন্সি কোন অসুস্থতা না। তেমনি কেউ যদি প্রকৃতিগতভাবে আলাদা হয়, তার জন্যে কোন ঘৃণা তার প্রাপ্য নয়।

২)মানুষ মাত্রেই কি ১০০% সমকামী অথবা ১০০ ভাগ বিষমকামী?

উত্তরঃ 

না।

আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, কোন মানুষই ১০০% সমকামী বা ১০০% বিষমকামী না; বরং একটি মিশ্র রূপ। তবে সর্বশেষ গবেষণায় সমকামীদের মধ্যে বিশেষ জিনেটিক প্যাটার্ন পাওয়া গেছে এক্স ক্রোমোজোম এবং ক্রোমোজোম ৮-এ, যা বিষমকামীদের থেকে আলাদা। এটা অনেক বড় বায়োলজিক্যাল প্রমাণ হতে পারে যে, সমকামিতা মূলত জিনেটিক। তবে অন্যান্য জিনেটিক প্রিডিস্পোজিশনের মতো এ রূপটিও সমাজ, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত চয়েস, পরিবেশ অনেক কিছু মিলিয়েই একজনের জন্যে প্রধান হতে পারে। কিন্তু কাউকে ধরে বেঁধে জোর করে এই সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বদলানো যায় না। অর্থাৎ একজন সমকামী কে ধরে বেঁধে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে, এরকম ধারণাও ভ্রান্ত।

৩) ধর্মে সমকামিতাকে গ্রহণ করতে না করা হয়েছে।

উত্তরঃ 

আমি জানি এই জায়গায় এসেই মানুষের জন্যে সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে গ্রহণ করতে। আমি কাউকে আহত না করে কয়েকটা কথা বলি। কোন ধর্মগ্রন্থ কিন্তু দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করতে পারে নি। বাইবেলে কথা না শুনলে দাসদের রীতিমতো শাস্তির দেয়ার অনুমতি আছে। এমনকি ইসলামে দাসদেরকে মুক্তি করলে পূণ্য, দাসদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার কথা বলা আছে। আবার দাসীদের সঙ্গে সহবাসেরও অনুমতি আছে (ক্ষেত্র ভেদে), কিন্তু নিষিদ্ধ করা হয় নি। তাহলে কি আমরা দাসপ্রথার মতো অমানবিক প্রথায় ফিরে যাবো? যাবো না। ঘুষকে নিষিদ্ধ করা হলেও তা কি বন্ধ আছে? তাহলে ধর্মেরও ইন্টারপ্রিটেশন বদলাতে হতে পারে। কারণ ধর্ম-ই একমাত্র নৈতিকতার মাপকাঠি না।

৪)সমকামীদের সমর্থন করার অর্থ কি সমকামী  হওয়া?

উত্তরঃ 

এটি একেবারেই ছেলেমানুষী অভিযোগ যে সমকামীদের সমর্থন করার অর্থই হল নিজেরা সমকামী হওয়া। কেউ যদি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাহলে কি সে ধর্ষিত হয়? কিংবা কেউ যদি বৃক্ষরোপণ নিয়ে আন্দোলন করে তাহলে নিজে বৃক্ষ হয়ে গেল? এই সব খেলো যুক্তি কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

৫) সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কারণ ছেলে এবং মেয়ের বিয়ে হয় সন্তান উৎপাদনের জন্যে।

উত্তরঃ

সন্তান জন্মানোই যদি বিয়ের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে প্রকৃতিগতভাবে যারা বন্ধ্যা, তাদের কি বিয়ের অধিকার থাকবে না? সন্তান উৎপাদনের জন্যে কি একমাত্র যৌন সঙ্গমই প্রয়োজন? সেকথা না হয় বাদই দিলাম। কেউ কেউ মূর্খের মতো সমকামিতাকে শুধু “যৌনতার রূপ”, “পুঁজিবাদের ফসল, যেখানে বাৎসল্য নেই আছে ভোগবাদ” বলে চালিয়ে দিতে চান। এরা মূলত পুরো বিষয়টি সম্পর্কেই অজ্ঞ। একটি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম যুগল যখন মিলিত হন, তখন কি সেখানে কেবলই যৌনতা থাকে? ভোগবাদীতা থাকে? পৃথিবীতে যতো সমকামী যুগল, তার চেয়ে অনেক বেশি বিষমকামী যুগলের কোন সন্তান নেই। তবে কি সেখানে কোন বাৎসল্য থাকে না? বিবর্তনের শারীরবিদ্যা না জানা থাকলেই এমন সরলীকরণ  করা যায়।

আমরা আসলে সমাজের মধ্যে থাকি তো, আমাদের কে এই জন্যে সামাজিক জীব বলে বোধহয়। সমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মেনে না চললে সামাজিক মর্যাদাটা ঠিক থাকে না। আমাদের বাংলাদেশের সমজা ব্যাবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের আদলে অর্থাৎ মুসলিম ধর্মের আদলে গড়া। যেখানে সমকামিতা হারাম। সেখানে আমার মত মানুষগুলোর জন্য জায়গা তো দূরে থাক, বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দেয় না এই রাষ্ট্র। আমি যতভাবেই বুঝাতে চাইনা কেন, যেখানে গোড়াতেই সমস্যা সেখানে এই ঘুণে ধরা সমাজকে বোঝানোর মত ক্ষমতা আমার বোধহয় একেবারেই নেই।বলার সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা, বেঁচে থাকতেই দেবে না।