আসিফ এন্তাজ রবি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন বা চেয়েছেন এটি নিয়ে ফেসবুকে খুব লেখালেখি হচ্ছে এবং একই সাথে আলোচনা চলছে। আমি বাংলাদেশের সন্তান না হলে খুব সম্ভবত এইসব দেখে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। একজন মানুষ দাবী করছেন যে তাঁর জীবন সংকটে এবং তিনি নিরাপত্তাহীন বোধ করছেন আর অমনি এই ফেসবুক পাঁড়াগায়ে পড়ে গেলো হাসি আর ঠাট্টার রোল। ফেসবুকের অনেক ব্যাক্তি লেগে গেলো রবির বিরুদ্ধে। এই ফেসবুকে বসেই তাঁরা মিমাংসা করে ফেলছে রবি’র রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার অধিকার আছে কি নেই। তাঁর জীবনের ঝুঁকি আছে কিনা এটি নিয়ে মশকরা হচ্ছে, বিদ্রুপ হচ্ছে এবং একজন মানুষকে যতটা সম্ভব ঠিক ততটা সম্ভব উপায়ে অনলাইন “বুলি” করা হচ্ছে অত্যন্ত অরুচিকর ও কদর্য উপায়ে।
প্রথমত, একজন মানুষ তাঁর জীবনের নিরাপত্তার জন্য ঠিক কোন পর্যায়ে গেলে অন্য দেশের কাছে আশ্রয় চাইতে পারেন? একজন মানুষের জীবন নিরাপদ কি নিরাপদ না সেটি সবচাইতে ভালো বুঝবেন সেই বিপদে আছেন যিনি মনে করছেন সেই মানুষটি। আর তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে যে দেশের কাছে তিনি আশ্রয় চাইবেন তাঁরা খতিয়ে দেখবেন তাঁর দাবী। এই দাবী খতিয়ে দেখার দায়িত্য কোনো ব্লগারের নয়। কোনো ফেসবুকারের নয় কিংবা কোনো কুতুবের নয়। রবির জীবনের নিরাপত্তা কিংবা সগীরের জীবনের নিরাপত্তা কিংবা এক্স, ওয়াই, যেড এর জীবনের নিরাপত্তা নিরূপন করা কি আমাদের কাজ নাকি যে দেশে নিরাপত্তা চেয়েছে সেই দেশের ইমিগ্রেশন তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাজ?
ধরা যাক একজন মানুষটির জীবনের নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তারপরেও তিনি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েও রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন। কিন্তু তারপরেও তিনি উন্নত বিশ্বে যাবার জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন। এই চাইবার মধ্য দিয়ে গ্লানির ব্যাপার হয়ত রয়েছে কিন্তু মানবিক দৃষ্টিতে আমি আসলে অন্যায় দেখিনা। কেননা এই যে উপরে বলেছি “উন্নত বিশ্ব”, কথাটি সেটির জন্য। একজন মানুষ কেন তাঁর নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে সত্য কিংবা মিথ্যে দিয়েও রাজনৈতিক আশ্রয় চান? কারন হচ্ছে ব্যাক্তির দেশ তাঁর জীবনের প্রাপ্য চাহিদা কিংবা মর্যাদা দিতে পারেনি। এটি একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যার্থতা। এটি ওই রাষ্ট্রের গ্লানি। ব্যাক্তির নয়।
আমার দুইজন বাংলাদেশী ক্লায়েন্ট আছেন যারা এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। সেখানকার একজন আইনজীবি হিসেবে আমি তাঁদের দুজনের রাজনৈতিক আশ্রয়ের এপ্লিকেশন ডিল করছি। এই দুইজন মানুষই তাঁদের কাগজ পত্র যখন সাবমিট করছেন অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে ততবার-ই আমাকে জানান যে তাঁরা অত্যন্ত গ্লানিতে আর কষ্টে ভোগেন। ইন্টারভিউর সময় বাংলাদেশকে নিয়ে এমন সব কথা তাঁদের বলতে হয়েছে যে তাঁরা সেটি কখনোই নিজের দেশ নিয়ে বলতে চান নি। স্কাইপির অন্য প্রান্ত থেকে তাঁদের চোখে আমি অশ্রু দেখেছি। তাঁরা প্রচন্ড আবেগে আক্রান্ত হয়েছেন।
একজন আমেরিকান নাগরিক কি মিথ্যে বলে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় চান? একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক কি মিথ্যে তথ্য দিয়ে নিউজিল্যান্ডে বা কানাডায় কিংবা একজন কানাডিয়ান নাগরিক কি মিথ্যে তথ্য দিয়ে আমেরিকায় বা ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় চান? যদি চান তবে সেটি শতকরা হারে ঠিক কত? হয়ত লাখে একটা হবে। কেন এইসব দেশের নাগরিক অন্য দেশে থাকার জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় চান না? কারন সেইসব নাগরিকদের দেশে পলিটিকাল টেনশন নেই, জীবন যাপন আরামের ও উন্নত।
পৃথিবীর কোন মানুষটি তাঁর জন্য একটি আরাম,নিরাপদ ও মর্যাদার স্থানে থাকতে চান না? উত্তর হচ্ছে সবাই চান। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ট্রিট করে কুকুর আর বিড়ালের মতন। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখতে পারে, মন্ত্রীর ছেলে বড় শিল্পপতি হবার স্বপন দেখতে পারে, এম পি হবার স্বপন দেখতে পারে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবার স্বপ্ন দেখতে পারে কিন্তু একজন ছাপোষা নাগরিক কোনোদিন এসব স্বপ্ন দেখে না। দেখলেও সেটি অবাস্তব বলে সবাই হাসাহাসি করে।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে এইসব হাসাহাসি কারা করে? একজন বাংলাদেশী অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে এবং সেটি আরেক বাংলাদেশী সেটি শুনলে কেন এটি নিয়ে হাসাহাসি করে? যারা হাসাহাসি করে সমাজে অর্থনৈতিক বিভাজনে তাঁদের অবস্থান কি? খুব সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণী হচ্ছে এই জাতীয় কাজ কারবারের হোতা। আমি নিজেও এই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করি সুতরাং দায় আমারও। আমরা মধ্যবিত্তরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের নানাবিধ অন্যায়, অত্যাচারের ভিকটিম। আমাদের নিন আনতে পানতা ফুরোয় এবং আমরাই মনে মনে উন্নত বিশ্বে গিয়ে সেখানে জীবন যাপন করবার স্বপ্নে বিভোর থাকি। অথচ এই আমাদের মধ্য থেকে একজন মানুষ যখন অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে “উন্নত বিশ্বে” চলে যেতে চায় তখন আমরাই টেনে ধরে তাঁর প্যান্ট খুলে ফেলি, তাকে অপমানিত করি। আমাদের এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা হচ্ছে একটা প্রকটভাবে দূর্নীতিগ্রস্থ একটা অংশ। আমরাই পেট্রোল বোমা খাই রাজনীতিবিদদের চামচামি কিংবা তাদের আসনকে পোক্ত করার জন্য আবার আমরাই আরেক মধ্যবিত্তকে পেট্রোল বোমা মারি। যে ছেলেটি পেট্রোল বোমা মারে দুই হাজার বা তিন হাজার টাকার জন্য সেই ছেলেটিই আবার পেট্রোল বোমা খাওয়া ঘরে তার ভাই কিংবা বোনের জন্য চিকিৎসা পায়না। আমাদের এই মধ্যবিত্ত সমাজের এই নোংরামির জন্য আজ লুটতরাজ হচ্ছে মহা লুটতরাজ আর মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে আরো বড় মন্ত্রী বা টাকার মালিক।
কথা হচ্ছিলো রবির এসাইলাম নিয়ে। এই এসাইলাম নিয়ে আমার নিজের মনেও কিছুটা দুঃখবোধ রয়েছে। গণ জাগরন মঞ্চের সাথে জড়িত থাকার সুবাদে লন্ডনে অনেক ব্যাক্তিই মনে করতেন যে আমি এই আন্দলোন, সংগ্রাম এসব করছি ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার জন্য। ফেসবুকে কিছু লোক প্রায়ই আমার পরিবার কিংবা আমাকে উদ্দেশ্য করে কিংবা আমার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস কি সেটি নিয়ে লেখা লিখত। এমনকি আমি নাকি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে সেটি পেয়েও গেছি এমন কথাও চাউর হয়েছিলো। ইংল্যান্ডে যিনি ১৫-২০ বছর ধরে থেকেছেন তেমন ব্যাক্তিও আমাকে নিয়ে এমন নোংরামোতে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ আমি কখনই ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইনি। আমি ইংল্যান্ডে যে পড়ালেখা করেছি, আমি যে স্টুডেন্ট ভিসাতে ছিলাম সেটি যেন অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন একটা সময়। পরবর্তীতে ১০ বছর এই দেশে থাকবার সুবাদে আমি পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পেয়েছি এবং এরও পরে আমি ব্রিটিশ সিটিজেন হয়েছি। আমার এই ইমিগ্রেশন হিস্টোরি একেবারেই আমার ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার ছিলো অথচ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই আমার মত আরেক মধ্যবিত্তকে টেনে নামাবার চেষ্টা করেছে, আমাকে নিয়ে নোংরামো করেছে।
অনেকেই বলেন ভুয়া এসাইলাম এপ্লিকেশনের কারনে অনেক আসল এসাইলাম এপ্লিকেশন নষ্ট হয়। এই কথা যারা বলেন তারা ভুল বলেন কিংবা তাঁরা হয়ত জানেন না যে একটি এসাইলাম এপ্লিকেশন ঠিক কতটা অতশী কাঁচের নীচ দিয়ে রিফাইন করে সংশ্লিষ্ঠ দেশ তাঁদের সিদ্ধান্ত জানায়। আমরা মনে করি যে আমেরিকায় যা ইচ্ছে বলে দিলে কিংবা ইংল্যান্ডে বা অস্ট্রেলিয়ায় যা ইচ্ছে বলে দিলেই সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় মিলতে পারে। এগুলো যে কি ভয়াভ ভুল ধারনা সেগুলো কে বোঝাবে কাকে? প্রত্যেকটি দেশের দক্ষ ইমিগ্রেশন অফিসার রীতিমত গোয়েন্দার মত সেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীর ব্যাপারে খোঁজ নেন, সেই দেশের ব্যাপারে খোঁজ নেন। কুয়োর ব্যাঙেরা এসব জানেনা বলেই অন্যের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস বা বিষয় নিয়ে কথা বলে।
এইতো গত সপ্তাহে ধর্ম বিষয়ক একটি লেখার ফলে চাউর হয়ে গিয়েছিলো যে আমার নাকি ভিসা শেষ তাই আমি ধর্ম নিয়ে লিখছি এবং এর ফলে আমি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইব। কারা এই হুল্লোড় করেছিলো আমাকে নিয়ে? কারা আমাকে নিয়ে কিংবা আমার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস নিয়ে এইসব কথা বলেছিলো? আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে তাঁরাই এসব নিয়ে কথা বলেছে যারা নিজেরাও জীবনের নিরাপত্তাহীনতার জন্য পশ্চিমা দেশ গুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ইংল্যান্ডে এবং অনলাইনে একটা নাস্তিক গ্যাং তৈরী হয়েছে যারা মনে করে ওরা ছাড়া আর কারো জীবন শংকায় নেই। যদি কেউ নিজেকে নাস্তিক দাবী করে তবে যেন তাঁদের সার্টিফিকেট নিয়ে, তাঁদের অনুমোদন নিয়েই নিজেকে নাস্তিক দাবী করতে হবে। পুরো ব্যাপারটি একেবারে মৌলবাদী মোল্লাদের মত। মোল্লারা আর ফতোয়াবাজরা যেমন মনে করে তাঁরা ছাড়া আর কেউ ভালো মুসলিম নয়, ঠিক তেমন। এইসব নাস্তিক গ্যাংদের সাথে ধর্মীয় মোল্লাদেরে একেবারে পার্থক্য নেই শুধু তাদের লেবাস ছাড়া।
ফিরে আসি আসিফ এন্তাজ রবির প্রসঙ্গে। আসিফ এন্তাজ রবি নিজের জীবনকে বাংলাদেশে নিরাপদ মনে করছেন না। আসিফের হয়ত অনেক সুনির্দিষ্ট কারন রয়েছে এই মনে করবার পেছনে। আর তাঁর দাবীটি নিয়ে যারা কন্সার্ণড হবেন ব্যাপারটি নিয়ে তারাই ভাববেন। আমরা নই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দীকির জীবনে কোনো হুমকি ছিলো না। তিনি সেতার বাজাতেন এবং সংস্কৃতি মনা একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু খুনীরা রেজাউল স্যারকে কুপিয়েছে। কারন কি? তিনি যদি কখনো রাজনৈতিক আশর্য চাইতেন আমি নিশ্চিত ফেসবুকের এইসব গ্যাং রেজাউল স্যারকে নিয়েও হাসি, ঠাট্টা ও তামাসা করত। একজন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নির্ণয় এখন ফেসবুকের কুতুবদের মাধ্যমে হচ্ছে এইটার থেকে বিষ্ময়কর আর কি হতে পারে?
কয়দিন আগে জার্মানীতে বসবাসরত বাঙালী এক উগ্র নাস্তিক ও সন্ত্রাসী লেখক আরেক বাংলাদেশী ব্লগারের রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারটি নিয়ে ঠিক এমন নোংরামি করেছিলো। অথচ আসিফ এন্তাজ রবির এই রাজনৈতিক আশ্রয়ের খবরটি নিয়ে সেই ভিকটিম ব্যাক্তিটির মন্তব্য হচ্ছে আসিফের খবরটি শেয়ার দিয়ে একটা “LOL” চিহ্ন। একজন মানুষ যেটি নিজে সাফার করেছে সেটি অন্যকে সাফার করতে দেখার পরেও যখন তিনি এই বিষয়ে রুখে দাঁড়ায় না তখন সেই ব্যাক্তিটিকে আমার অত্যন্ত নিম্ন মানসিকতার বলে মনে হয়। তাকে অমানবিক মনে হয়।
কবে আমরা সভ্য হব? কবে আমরা অন্যের ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করব? কবে আমরা ফেসবুকে একটু সুস্থ একটা পরিবেশের সন্ধান পাব? কবে বাঙালী মধ্যবিত্ত একজোট হয়ে সমস্যার মোকাবেলা করতে শিখবে?