আমাদের এলাকার এক লোকের পায়ে একবার ভয়াবহ পচন ধরেছিল। ব্যথায় যন্ত্রণায় সে সারারাত কাতরাত, কিন্তু চিকিৎসা করতে যেত না। যা করতো তা হচ্ছে ঝাড়ফুঁক, আর কিছু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। স্বাভাবিকভাবেই তাতে কাজ হতো না, দিনে দিনে অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। কিন্তু ইহুদী নাসারাদের আবিষ্কৃত, পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সে কোনভাবেই গ্রহণ করবে না। বোকা মনে প্রশ্ন জাগতো, হোমিওপ্যাথি কোন দেশের আবিষ্কার? সে যাইহোক। তার ধারণা ঐ সব চিকিৎসা হচ্ছে ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র। তারা তার সুস্থ সবল পা কেটে বাদ দিতে চায়। তাই সকল দোষ গিয়ে পড়তো বেচারি বউয়ের ওপর। দিনরাত বউকে শুনতে হতো গালাগালি, বকাঝকা। ভদ্রলোক তার পায়ের পচনের যন্ত্রণা কমাতে সারাক্ষণ স্ত্রীকে খোটা দিতো, গালি দিতো। তরকারিতে লবণ কম কেন, ঝাল বেশি কেন, সবকিছুর মধ্যেই ভদ্রলোক তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াতো। তার ধারণা হয়েছিল, সবাই মিলে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাই সে অবিরাম গালি দিয়ে যেত। দেশ, কাল ইউরোপ আমেরিকা কেউ তার গালি থেকে রেহাই পেত না। সারা পৃথিবীর চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে তবেই তার একটু শান্তির ঘুম আসতো। আমাদের অনেকেরই সম্ভবত সেই পচন ধরেছে। মগজে।
নিজেদের অশিক্ষা কুশিক্ষা দারিদ্র জঙ্গিবাদ মৌলবাদ সংখ্যালঘু নির্যাতন ইত্যাদির জন্য অন্যকে দায়ী করার মধ্যে এক ধরণের মজা আছে, দায় মুক্তির আনন্দ আছে। সব কিছু অন্যদের ষড়যন্ত্র, নিজেদের দুর্দশার জন্য আসলে নিজেরা দায়ী নই, অন্যেরা দায়ী, এই বোধ এক ধরণের শান্তি দেয়। সমস্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে বিধর্মী ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র অনুসন্ধান করা এবং নতুন নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উদ্ভাবন করা এক সুখকর অনুভূতি। পাশের বাসার ভদ্রলোক বউকে পেদাচ্ছে, সব ইহুদী নাসারাদের দোষ। “ভদ্র”-পোশাক না পরার শাস্তি হিসেবে মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, সব পাশ্চাত্যের দোষ। পাশ্চাত্যের মিডিয়াই তো মেয়েদের বাইরে বের হতে উৎসাহ দিচ্ছে! দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে? ভারতেও হচ্ছে, অতএব টেনশনের কিছু নাই। হোক। ইরাকে হাজার হাজার মানুষকে মোল্লারা জবাই করে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে? কোন না কোন ভাবে এর মধ্যে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারলেই বাঁচা গেল। মুচকি হাসি নিয়ে বলতে হবে, সব ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র। ঐ মোল্লারা তো দুধের শিশু। ওরা কী বোঝে বাপু? না হয় ক’টা মেয়েকে ধর্ষণ করেছেই, না হয় ক’টা লোককে জবাই করেছেই। তাই বলে এত চিল্লাফাল্লার কী আছে? কেন, গাজায় যে ইহুদীরা মানুষ মারলো তাতে কিছু যায় আসে না? মুসলমানবতাবাদীরা রুখে দাড়াও, প্রতিশোধ হিসেবে ক’টা হিন্দু বাড়ি পোড়াও। নাড়ায়ে তাকবীর আল্লাহো আকবর!
দিনশেষে সকলেই শান্তির সন্ধান করে। নির্বুদ্ধিতার মধ্যে এক অলৌকিক সুখ নিহিত। তাই জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।