সাধারণত আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে হত্যা করা হলে সবার আগে সন্দেহের তীর যেদিকে যায়, তা হচ্ছে জামাত কিংবা নিদেনপক্ষে বিএনপি। আবার কোন বিএনপি জামাত নেতাকে হত্যা করা হলে সবার আগে যাদের প্রতি সন্দেহ হয় তারা হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ইসলামি উপস্থাপক এবং ইমাম ফারুকী সাহেব নাস্তিক বিরোধী ছিলেন, নাস্তিক বিদ্বেষীও হয়তো ছিলেন। তাতে কোন সমস্যা নেই, যে কেউ নাস্তিক বিরোধী, নাস্তিক বিদ্বেষী হতেই পারেন। সকলের বাক-স্বাধীনতা রয়েছে এবং তারা তাদের বাক-স্বাধীনতা ব্যবহার করে যেকোন বক্তব্যই দিতে পারেন। আমি উনার কথা বলার স্বাধীনতার পক্ষে, তা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হলেও। গতবছর একজন নাস্তিক ব্লগার রাজীব হায়দার ইসলামিস্টদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। তাকে জবাই করে ফেলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের তীর যাদের দিকে প্রথমেই গিয়েছিল, তা হচ্ছে ইসলামিস্ট গ্রুপগুলো। পরে দেখা গেল আসলেই তাই। এবার ইসলামি উপস্থাপকের বাসায় ঢুকে তাকে জবাই করে ফেলা হলো। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে, ফেসবুকের নাস্তিকরাই এই অপকর্মটি ঘটিয়েছে কিনা!
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত এমন কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস, এমন কোন মিডিয়া রিপোর্ট চোখে পড়লো না, যেখানে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করা হয়েছে এই অপকর্মটি নাস্তিকরা ঘটিয়েছে। কেন? নাস্তিক মুক্তমনারা কী দুধে ধোয়া তুলসী পাতা? তাদের একজন ব্লগারকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেও তো এই ঘটনা ঘটানো হতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতা হত্যা হলে জামাতের প্রতি সন্দেহ হয়, জামাত নেতাকে হত্যা করা হলে আওয়ামী লীগের দিকে সন্দেহ যায়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। অথচ ঈশ্বর বিশ্বাসী আস্তিক ধার্মিক ইমাম সাহেব ইসলামিস্টের বাসায় ঢুকে জবাই করা হলো, সকলে ইসলামিস্টদেরই কেন সন্দেহ করছে আমি বুঝলাম না! আমি নিশ্চিত, এর পেছনে কোন ইসলামিস্ট গ্রুপকেই পরে পাওয়া যাবে।
হিন্দুদের বাড়িতে যখন আক্রমণ হয়, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, লুটপাট করা হয়, বৌদ্ধদের উপাসনালয় যখন ভেঙ্গে দেয়া হয়, বাউল সন্ন্যাসীদের ধরে যখন দাড়ি কেটে দেয়া হয়, রমনার বটমূলে যখন বোমা হামলা হয়, সারা বাঙলাদেশে যখন সিরিজ বোমা হামলা হয়, ঝালকাঠিতে বিচারকের গাড়িতে যখন বোমা হামলা হয়, আদালতে যখন বোমা হামলা হয়, উদীচীর সম্মেলনে যখন বোমা হামলা হয়, একুশে আগস্ট যখন বোমা হামলা হয়, হুমায়ুন আজাদকে যখন কোপানো হয়, তসলিমা নাসরিনকে যখন আক্রমণ করা হয়, পত্রিকা অফিসে যখন বোমা মারা হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে, একদম প্রতিটি ক্ষেত্রে কাদের দিকে সন্দেহের তীর যায় সবার আগে? এবং পরে কীভাবে দেখা যায়, যাদের প্রতি সন্দেহ হয়েছিল তারাই কাজটি করেছে! কীভাবে এটা হয় একবার ভেবে দেখেছেন? নাস্তিকরাও তো এই কাজগুলো করতে পারে, তাই না? অন্ততপক্ষে দুই একটা অপকর্ম তো নাস্তিকরা ঘটাতেই পারে পালটা প্রতিক্রিয়া হিসেবে! কিন্তু একবারও কী এমনটা হয়েছে?
একটা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই দেশের সংবিধানের ওপর, শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। মানুষ সভ্য হয়, শিক্ষিত হয় কিছু সুনির্দিষ্ট মতবাদকে সামনে রেখে। যেমন পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল ধর্মকে সামনে রেখে, মৌলবাদকে উস্কে দিয়ে। তাই পাকিস্তানের মানুষের কী অবস্থা এখন সহজেই বোঝা যায়। আবার জামাত ইসলামীর মত দলের স্রষ্টা ছিল মওদুদী। সে যেই বই, যেই আদর্শ দিয়ে গেছে, জামাত নেতাকর্মীরাও সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলেছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুশ সরকারের সময়ও বুশের সীমাহীন মূর্খতায় আচ্ছন্ন হয়েছিল তাদের বাহিনীগুলো। তাহলে ইসলামের সৈনিক যারা, তাদের জীবনাদর্শ কে? তারা কোন বই পড়ে এমন হয়ে উঠছে? সমস্যা চোখের সামনেই, সমাধানও আছে। খালি আমরা সেটা দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছি নাকি? আমরা কী তাদের ভয়ে এতটাই ভীত যে, প্রতিবাদ করতে গেলেও তেনা প্যাচিয়ে সবদিক রক্ষা করে সবার মন জুগিয়ে ঘাতকদের মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলতে হয় আমাদের?
আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে আজকের ফেসবুক ব্লগের নাস্তিকগণ কাউকে কোনদিন ছুরি মেরেছে বা হত্যার হুমকি দিয়েছে, এমনটা চোখে পড়ে নি। তারা মসজিদে আক্রমণ করে নি, তারা মন্দির ভাঙ্গে নি। তারা ইসলামিস্টদের হত্যা করে নি। কেউ খুন হলে, কাউকে জবাই করা হলে তাদের কেউ সন্দেহও করে না। ফারাবী ও অন্যান্য ইসলামিস্টদের করে। তার মানে কী এটাই, সকলে জানে মুক্তমনা নাস্তিকরা কাউকে হত্যা করতে পারে না। হত্যা, জবাই দেয়া তো দুরের কথা, তারা কাউকে ছুরি দিয়ে একটা খোঁচাও দেবে না। তারা কোন মন্দির মসজিদে আক্রমণের মানুষ নন। মসজিদ মন্দির উপাসনালয় মূর্তি যারা ভাঙ্গে তারা সকলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস মানুষ। তারা মতবিরোধের কারণে কাউকে হত্যা করবে না। তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদেরও কথা বলার সুযোগ করে দেবে, এমনকি তারা হত্যার হুমকি দিলেও। তারা খুব বেশি হলে প্রতিবাদ হিসেবে একটি ফেসবুক জ্বালাময়ী প্রতিবাদী স্ট্যাটাস দেবে, খুব বেশি হলে একটি ঝাঁঝালো বই লিখবে, নিদেন পক্ষে পত্রিকায় একটি কলাম লিখবে। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
উলটো দিকে ইসলামিস্টরা কী করবে?