ছোটবেলা আমাদের স্কুলের ধর্মশিক্ষক আমাদের শিখিয়েছিলেন, কালো পিপড়া হচ্ছে মুসলমান পিপড়া। আর লাল পিপড়া হচ্ছে হিন্দু পিপড়া। তাই লাল পিপড়াগুলো মানুষকে কামড় দেয়। সেগুলো তাই পিষে মেরে ফেলাই উত্তম।
শুধু তাই নয়, আমাদের শিখিয়েছিলেন ইহুদীরা হচ্ছে ইসলামের দুশমন। তাদের খতম করতে পারলে অসংখ্য সওয়াব। বেহেশতে গেলে পাওয়া যাবে হুর পরী। ছোট বেলা তো হুর পরী বুঝতাম না, কিন্তু ধর্ম শিক্ষক খুব রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করতেন হুরের কথা। তার লালসা পূর্ণ চোখ আর জিহ্বা দেখলে মনে হতো, এখনই বুঝি কোন মেয়ের ওপর হামলে পড়বেন!
সেই স্কুল জীবনে, যখন হিন্দু মুসলমান কাকে বলে তাই জানতাম না, তখনই আমার মধ্যে এই দাড়িওয়ালা খচ্চর ঢুকিয়ে দিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা। অস্বীকার করবো না, সে সময়ে হিন্দুদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। ঘৃণা করতাম ইহুদীদেরও। ভাবতাম, আল্লাহর দুনিয়ায় বসবাস করে, আল্লাহরটা খেয়ে পরে এই অকৃতজ্ঞ লোকগুলো আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে না। কত্তবড় সাহস। এগুলোকে ধরে ধরে জবাই করা উচিত। এই চিন্তার মধ্যে আগুনে বারুদ যোগাতো কোরানের নানান সাম্প্রদায়িক বক্তব্য। হাদিসে ইহুদী বিদ্বেষী বক্তব্যগুলো যখন বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে হুজুরদের মুখে শুনতাম, মনের মধ্যে আগুন জ্বলতো। আহ, একটা ইহুদীকে যদি সামনে পেতাম, কল্লাটা নামিয়ে দিতাম এক কোপে!
খুব আশ্চর্যজনক ভাবেই, সে সময়ে কিছু রাশিয়ান বই হাতে পেয়েছিলাম। সেগুলো পড়েছিলাম গোগ্রাসে। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান চেতনার বই। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছিল, এতদিন যা ভাবতাম তার অনেক কিছুই হয়তো সঠিক নয়। ধীরে ধীরে আরো পেয়েছিলাম অসংখ্য ধর্মবিরোধী, কুসংস্কার বিরোধী, যুক্তিবাদী বই। বইগুলো বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলতো, মানবতাবাদের কথা বলতো, মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস শেখাতো। পড়তে পড়তে, জানতে জানতে একদিন আরজ আলী মাতুব্বরের বই হাতে পেয়ে গেলাম। এরপরে একে একে অসংখ্য বই পড়েছি। আজকের আমি সেই বইগুলোর যোগফল তো বটেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই বইগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। শিশুরা ক্রমশ বই বিমুখ হচ্ছে, কম্পিউটার আর মোবাইল ফোনের প্রতি তাদের আগ্রহ অদম্য। তা হবেই, তাতে আমি বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু তারা বিদ্যালয়ে কী শিখছে? আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোর ক্রমশ ইসলামিকরণের পরে আগামী প্রজন্ম কেমন হবে? আমরা কী আগামী প্রজন্মকে জঙ্গি, মৌলবাদী, বর্বর, অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নতজানু, অসভ্য তরুণ তরুণী দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে চাই?
আমি চাই না আমার শিশুদের কেউ হিন্দু মুসলমানে ভাগ করুক। আমার শিশুরা কোন ভাগাভাগিতেই না থাকুক। আমার শিশুদের কেউ না বলুক, ওরা হিন্দু আর ওরা মুসলমান। ওরা লাল পিপড়া আর আমরা কালো পিপড়া। আমার শিশুদের কেউ না বলুক, বিধর্মীরা অভিশপ্ত! আমার শিশুদের জন্য সেক্যুলার শিক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত মানবতাবাদের শিক্ষার। প্রয়োজন তাদের উপযোগী করে নারীবাদ, সাম্যবাদ, সকলের সমান অধিকারের শিক্ষা দেয়ার। প্রয়োজন যৌন শিক্ষা দেয়ার, যেন সে বুঝতে পারে সে কে। যেন নিম্নমানের চটি বই তার যৌন শিক্ষক না হয়ে ওঠে। সে যেন ধর্ষণকে যৌনতা ভেবে ভুল না করে।
তাই “শিশুদের জন্য মানবতাবাদ” নামে একটি ইউরোপীয় বই অনুবাদের কাজ শুরু করেছি আমরা কয়েকজন মিলে। মূল বইটি ইউরোপ থেকে প্রকাশিত, বইটি যে সংগঠন থেকে বের হয়েছে, তারা প্রস্তাব করেছে বইটি বাঙলায় অনুবাদ করে দিতে পারলে তারা ১০০০ কপি বই বিনামূল্যে বাঙলাদেশের ছেলেদের জন্য দান করবে। হয়তো অনুরোধ করলে আরো বেশি কপিও পাওয়া যাবে। ইউরোপে প্রতিটি বইয়ের মূল্য ২৫ পাউন্ড, সে হিসেবে বাঙলায় বিনামূল্যে বইটি পাওয়া গেলে দারুণ একটা ব্যাপারই হবে বটে।
বইটির বেশিরভাগ অংশ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ গড়ার পক্ষে সহায়ক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আগে একবার এই নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার পরে অসংখ্য লোক লাইক শেয়ার ইত্যাদি হুলুস্থুল করে জানিয়েছিল তারা সাথেই আছে। কাজ করতে আগ্রহী। এখন তেমন কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প কয়েকজন মিলেই অনুবাদের কাজ করে যাচ্ছি আমরা। বাঙালির স্বভাব যা, কাজের বেলায় কাউকে পাওয়া যায় না।
যাইহোক, যেই অল্প কয়েকজন কাজ করছেন, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আর যারা কাজ করতে চান, তারা এই গ্রুপে যোগ দিনঃ Humanism for children Bangla book
আর যারা আকডুম বাকডুম আর নানান অজুহাত দেখাবেন, শুধুমাত্র লাইক দিয়ে দেশ উদ্ধারের পথ খুঁজবেন, কথা বেশি কাজ কম করবেন, তারা রাস্তা মাপেন। আপনাদের প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।