বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ আর ‘বিপক্ষ শক্তি’ বলতে সত্যিই একটা প্লাটফর্ম এক সময় ছিল। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াকে মেনে নিতে না পারা লোকজনই ছিল এই ‘বিপক্ষ শক্তি’। এরা এখন বাস্তবতা মেনে বাংলাদেশের প্রতি শতভাগ আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। জামাত ইসলামও জানে অখন্ড পাকিস্তান দিবাস্বপ্ন। অন্যান্য ইসলামী দলগুলোও বাংলাদেশ মুখী। কাজেই সত্যিকার অর্থে দেশে এখন আর ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বলতে কিছু নেই।
আমাদের একটা বড় ভুল ছিল ৯০ দশক পর্যন্ত ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ বলে যারা চিহিৃত হতেন তাদেরকে অযৌক্তিকভাবে সেক্যুলার প্রগতিশীল ভাবা। কথিত স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা নিয়ে। ৪৭ সালের যে আদর্শে পূর্ববঙ্গ ভাগ হয়েছিল তা থেকে একচুল সরে আসেনি কথিত স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি। জিন্না সাহেব ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেই ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তান কেবল মুসলমানদের দেশ নয়, অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও এখানে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এ কারণে পাকিস্তানের পতাকাতে সবুজের সঙ্গে সাদা রঙ যুক্ত করা হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতি সহাবস্থান বুঝাতে। বাংলাদেশও ৭২ সালের সংবিধানে সেক্যুলারিজম বসিয়েছিল। কিন্তু একচুলও সরে আসেনি ‘পাকিস্তান’ কনসেপ্ট থেকে। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র আর পাকিস্তান যে কনসেপ্ট থেকে জন্ম নিয়েছিল দুটো আলাদা বিষয়। বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি থেকে বেরিয়ে ছোট পরিসরে আরেকটি পাকিস্তান কনসেপ্টই ধারণ করেছিল। তাই এই রাষ্ট্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর সেই ৭২ সাল থেকেই রাষ্ট্রীয় বৈষম্য চলে আসছে।
হেফাজত ইসলামসহ ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো ইসলামী রাজনীতি করে। এদের সঙ্গে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের’ বড় ধরণের বিবাদ ঐতিহাসিক। মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম পরিচয়ে সংখ্যাগুরুত্ব বজায় রেখে শাসন ক্ষমতা নিজেদের কাছে রাখতে চায়। তাদের এই শাসনেই মুসলিমদের সব ধরণের আধুনিক উৎকর্ষতা লাভ করুক সেটাই তাদের কাম্য। পাকিস্তান হবার ফলে ঢাকার সিনেমাতে একজন নায়ক রাজ রাজ্জাক তৈরি হতে পেরেছে- এভাবেই একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী নিজেদের দর্শনকে নির্ভুল প্রমাণ করতে চায়। এদিকে সিনেমায় অভিনয় করা ইসলাম অনুসারে হারাম কাজ। ইসলামী দলই এরকম অনৈসলামিক কাজকে সমর্থন করে না। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাদের বিবাদ এখানেই। ছোট্ট এই উদাহরণ থেকেই সব পরিস্কার বুঝতে পারবেন। ধর্মের পরিচয়ে জন্ম নেয়া ‘পাকিস্তান’ নিয়েও তাই ওলামা মাশায়েখরা সন্তুষ্ঠ ছিল না। তাই ওলামারাদের কাছে পাকিস্তান কান্ডারীরা ছিল কাফের। সেক্যুলার। কমিউনিস্ট…। অথচ এরাই মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গড়ে দিয়েছেন। পাকিস্তান আন্দোলন তো কোন সেক্যুলার মুভমেন্ট ছিল না। কিন্তু অপপ্রচারের জোরে তারাই হয়ে গিয়েছিলেন সেক্যুলারপন্থি! একটা লোককে এক গ্রাম মানুষ অকারণেই পাগল ডাকা শুরু করলে একসময় সে নিজেকে পাগল মনে করতে থাকবে। ৭২ সালের সংবিধান সেই গণহিস্টিরিয়ার প্রতিফল…। আমরা কখনই সেক্যুলার ছিলাম না। এটাই অপ্রিয় সত্য…।