১. চাঁদমারি চলচ্চিত্র
২রা নভেম্বর, ২০০৪ সাল।
স্নিগ্ধ সকালে এমস্টারডামের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে অলস ভঙ্গিতে সাইকেল চালিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছেন থিও ভ্যান গগ। মাঝ বয়েসী হাসি-খুশি একজন মানুষ তিনি। হল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের প্রপৌত্র তিনি। প্র-পিতামহের মতো তিনি অবশ্য অঙ্কন শিল্পী হন নি। তাঁর বদলে সেলুলয়েডের শিল্পী হয়েছেন। তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। কয়েক মাস আগে মুক্তি পেয়েছে তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্র সাবমিশন। মুক্তির পরই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এই চলচ্চিত্র। হয়তো এই চলচ্চিত্র কিংবা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তায় মশগুল ছিলেন তিনি। এমন নির্মল পরিবেশে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে, সে চিন্তা তাঁর মাথাতেও আসে নি। সে কারণে মুহাম্মদ বোয়েরি নামের ছাব্বিশ বছরের এক মরোক্কান-ডাচ যুবক যে অস্ত্র হাতে ছুটে আসছে তাঁর দিকে ছুটে আসছে, সে খেয়ালই ছিল না তাঁর। থিও যখন আততায়ীকে দেখতে পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কাছে এসেই থিওকে গুলি করলো বোয়েরি। গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। হাচড়ে পাচড়ে উঠে রক্তাক্ত শরীরে পাশের বিল্ডিং এর দিকে ছুটতে থাকলেন থিও। আহত শরীরের শ্লথগতি কাল হলো তাঁর। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘাতক চলে এলো তাঁর খুব কাছে। আর কোনো উপায় না দেখে ঘাতকের কাছে করুণা ভিক্ষা করলেন তিনি, ‘প্লিজ, আমাকে মেরো না। এসো আমরা কথা বলি।‘ তাঁর এই করুণা ভিক্ষায় কোনো কাজ হলো না। কাজ হলো না আলোচনার আহবানেও। খুব কাছে থেকে থিওকে আবার গুলি করলো মরোক্কান ছেলেটা। মৃত্যু নিশ্চিত করেও কাজ শেষ হয় না তার অবশ্য। পকেট থেকে ছুরি বের করে প্রবল ঘৃণা আর নৃশংসতায় থিও-র গলা কেটে মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সে। তারপর একটা চিঠি থিও-র বুকের উপরে রেখে ছুরি দিয়ে বিদ্ধ করে।
গোলাগুলির শব্দে এর মধ্যেই পুলিশ এসে গেছে। পুলিশ দেখে বোয়েরি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের পার্কে। পুলিশও ঘিরে ফেলে পুরো পার্ক। আত্মসমর্পন করতে অস্বীকৃতি জানায় বোয়েরি। ফলে তার সাথে সাথে বন্দুকযুদ্ধে নামে পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসার এতে আহত হন। বোয়েরির পায়ে গুলি করে তাকে আহত করে বন্দী করে পুলিশ। নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে।
থিও-র বুকে ছুরি দিয়ে যে চিঠি বিদ্ধ করে দিয়েছিল বোয়েরি, সেই চিঠি কিন্তু থিও-কে উদ্দেশ্য করে ছিল না। ছিল আয়ান হারসি আলির জন্য। আয়ান হারসি সোমালিয়ান শরনার্থী। সেখান থেকে তিনি ডাচ নাগরিক হয়েছেন। মূল ধারার রাজনীতি করে ডাচ সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নেদারল্যান্ডের বেশ বড় সংখ্যার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। থিও ভ্যান গগের পরিচালিত সাবমিশন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য আয়ান হারসির লেখা। এই চলচ্চিত্রের দেখানো হয় যে, একজন মুসলমান মেয়েকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, সে স্বামীর দ্বারা প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয়। এক সময় মেয়েটাকে তার চাচা ধর্ষণ করে। ধর্ষণের কোনো প্রতিকারতো সে পায়ই না, বরং ব্যভিচারের অভিযোগে বিচার হয় তার।
ডাচ ভাষায় লেখা চিঠিতে আয়ান হারসি আলিকে নাস্তিক মৌলবাদী হিসাবে ভূষিত করা হয়, যে কিনা শয়তানের প্ররোচনায় বিদ্বেষপ্রসূতভাবে ইসলামের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আয়ান হারসি ইসলামকে আঘাত করার জন্য বুমেরাং ছুড়ে দিয়েছে, কিন্তু এই বুমেরাং-ই একদিন তাঁর শেষ পরিণতি ডেকে আনবে।
ইসলামি মৌলবাদী খুনিদের মূল লক্ষ্য থিও ছিল না, ছিল আয়ান হারসি। এই সময়ের দুই বছর আগে থেকেই হুমকির কারণে আয়ান হারসি পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করেন। সে কারণে তাঁর কাছে পৌঁছোতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে তাঁর ঠিকানা অনলাইনে পোস্ট করে দেয় এক মরোক্কান ছেলে। শুধু ঠিকানা নয়, সেখানে আয়ান হারসি এবং থিও-র ছবিও ছিল। সেই মেসেজে বলা হয় যে, আয়ান এবং থিও দুজনকেই মরতে হবে। হুমকিদাতা এই ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আয়ান তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগনামাও করেন পুলিশের কাছে।
‘সাবমিশন’ শেষ হবার পরে আয়ান এবং থিও-র দেখা-সাক্ষাত আর হয় নি। কিন্তু, ফোনে দুজনের যোগাযোগ ছিল। আয়ান এই ঘটনায় থিও-কে সতর্ক করে দেন এবং তাঁর মতো করে পুলিশি নিরাপত্তা নেবার জন্য অনুরোধ করে্ন। আয়ানের কথা হেসে উড়িয়ে দেয় থিও। বলে যে, ‘এই রকম হুমকি আমি গত পনেরো বছর ধরেই পাচ্ছি। কে আমাকে হুমকি দেয় নি বলো? ইহুদি, খৃস্টান, সোশ্যাল ডেমোক্রাট, মুসলমান, সবাই আমাকে হুমকি দিয়েছে। তারপরেও আমার কিছু হয় নি। দেখো, আগামীতেও আমার কিছু হবে না।‘
থিও-র এই আত্মবিশ্বাস কোনো কাজে আসে নি। তিনি যে এই বিষয়ে যে কতোখানি ভুল ছিলেন, তা তাঁর নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। থিও হত্যাকাণ্ডের পরপরই হল্যান্ডের সিকিউরিটি সার্ভিস আয়ান হারসির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁকে গোপন জায়গায় সরিয়ে নেয়।
২. মতিচ্ছন্ন মুসলমান
যে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ হওয়ার জন্য তাঁকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হুমকি পেতে হয়েছে, শেষে অজ্ঞাতস্থানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সেই মানুষটিই তাঁর জীবনের একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে বিশ্বাসী, ধর্মানুরাগী এবং মতিচ্ছন্ন মুসলমান হিসাবেই কাটিয়েছেন। তারপর এই সময় মতিচ্ছন্নতা কেটে গেলে তিনি বেছে নিয়েছেন যুক্তি পথে যাত্রাকে। বিশ্বাস থেকে যুক্তিপথের এই যাত্রা আয়ান হারসির জন্য সংক্ষিপ্ত কিছু নয়, নয় আকস্মিক কিছুও। এ এক দীর্ঘ যাত্রার ফল।
আয়ান জন্মেছেন সোমালিয়াতে। ১৯৬৯ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন সোমালিয়ার বিরোধী দলের একজন নেতা। সেই সময়ে সোমালিয়াতে সিয়াদ বারের স্বৈরশাসন চলছিলো। আয়ানের মা ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর মা-বাবা দুজনেই মুসলমান ছিলেন। তবে, তুলনামূলকভাবে তাঁর বাবা ছিলেন অনেক বেশি উদারপন্থী। মা ছিলেন একজন গোঁড়া মুসলমান। আয়ানের দুই বছর বয়সের সময় পুলিশ এসে তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেয়। পরবর্তী বছরগুলো বাবাকে ছাড়াই কাটাতে হয় তাঁদের।
ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবেই ছোট বেলায় গড়ে তোলা হয়েছিলো তাঁকে। আফ্রিকার কিছু মুসলিম দেশে ছোট বেলায় মেয়েদের খৎনা করার যে নিয়মটা প্রচলিত আছে, সেটা তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছিলো। এই ভয়ংকর কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবার পরেও তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবেই থেকে গেছেন তিনি। এর থেকে বের হবার চিন্তা কখনোই তাঁর মাথায় আসে নি। ছোট বেলায় মাদ্রাসায় গিয়েছেন, কোরান মুখস্ত করেছেন। সেই সময় তাঁরা মক্কায় ছিলেন অল্প কিছুদিন। তখন তিনি কাবা শরীফেও যেতেন নিয়মিতই। টিনএজ বয়সে মুসলিম ব্রাদারহুডেও যোগ দেন। ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবে জীবনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দেন তিনি।
আয়ানের কোরান শিক্ষা শুরু হয় তাঁর নানির কাছ থেকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। একটু বড় হলে মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় তাঁরা বাবা জেল থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। সোমালিয়া তাঁর জন্য অনিরাপদ বলে পালিয়ে ইথিওপিয়া চলে যান। ইথিওপিয়া খ্রিস্টানপ্রধান দেশ বলে তাঁর মা সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তাঁর কাছে ইথিওপিয়া হচ্ছে কাফের দিয়ে পরিপুর্ণ এক নোংরা দেশ। ইথিওপিয়া যাবার বদলে আয়ানের মা ইসলামের পূন্যভূমি সৌদি আরব যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য ভূয়া পাসপোর্ট তৈরি করেন তিনি এবং সেই পাসপোর্ট দিয়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। আয়ান তখন আট বছরের বালিকা।
সৌদি আরবে গিয়ে মক্কাতে বসবাস করা শুরু করেন তাঁরা। তিনি এবং তাঁর বোন হাওয়া ভর্তি হন মেয়েদের কোরান শিক্ষার স্কুলে। ভাই মাহাদ ভর্তি হয় ছেলেদের মাদ্রাসাতে। এখানে এসে প্রথম তাঁর উপলব্ধি ঘটে যে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক পূর্বসংস্কারের (প্রেজুডিস) উর্ধ্বে উঠতে পারে নি। সৌদি মেয়েদের গায়ের রঙ ফর্সা। দেখতে সুন্দর। এর জন্য তাদের অহংকারের সীমা পরিসীমা নেই। আয়ান এবং তার বোনের গায়ের রঙ গাঢ় বর্ণের বলে সৌদি মেয়েরা তাঁদেরকে আবিদ বা কৃতদাস বলে ডাকতো।
এখানেই আয়ান প্রথম শারিয়া আইনের কঠিন প্রয়োগ দেখেন। প্রতি শুক্রবার প্রকাশ্য স্থানে জুম্মার নামাজের পর কাউকে শিরোচ্ছেদ করা হতো, কাউকে দোররা মারা হতো, কোনো নারীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো, কখনো বা কোনো ছিঁচকে চোরের হাত কেটে নেওয়া হতো কব্জির কাছ থেকে। মেয়ে হবার কারণে তিনি এগুলো চাক্ষুস দেখার সুযোগ পান নি অবশ্য। কিন্তু তাঁর ভাই মাহাদ এগুলো দেখতে পেতো। তাঁর কাছ থেকেই তিনি এবং তাঁর বোন এইসব ভয়াবহ ঘটনাগুলোর বর্ণনা শুনতেন।
এর মধ্যে তাঁর বাবা ইথিওপিয়া থেকে মক্কায় এসে পরিবারের সাথে যোগ দেন। এ সময়ই আয়ান প্রথম তাঁর বাবা এবং মায়ের ইসলাম ধর্ম বিষয়ে ধারণাটার পার্থক্যটুকু বুঝতে পারেন। ঘরের মধ্যেও ছেলেরা এবং মেয়েরা আলাদা রুমে নামাজ পড়ার রেওয়াজ রয়েছে সৌদি আরবে। তাঁর বাবা এই প্রথাকে ভাঙার চেষ্টা করেন। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে নামাজ পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অন্যেরা যেখানে, বিশেষ করে তাঁর মা সবসময় জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখাতেন ধর্ম পালনের জন্য, সেখানে তাঁর বাবা এর পুরো ব্যতিক্রমী কাজ করতেন। সপ্তাহে একদিন তিনি ছেলেমেয়েদের কোরান পড়াতেন। আরবী আয়াত অনুবাদ করে শোনাতেন তাদের। সেখানেও কোরানের আক্ষরিক অনুবাদ না করে তিনি তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যাই বেশি দিতেন। তিনি ছেলেমেয়েদের বলতেন যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে শাস্তি দেবার জন্য নয়। দুনিয়াতে তিনি মানুষ পাঠিয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর এবাদত বন্দেগীর করার জন্য। আয়ানের মায়ের অবশ্য এই বিষয়ে মত তাঁর বাবার মতের সাথে মিলতো না। আয়ান কোনো কারণে মায়ের অবাধ্য হলে তিনি চিৎকার করে জানান দিতেন যে, এই অপরাধের জন্য দোজখের আগুনে নিক্ষেপিত হবে এবং সেখানেই অনন্তকাল পুড়ে কাবাব হবে।
বছর খানেক পরে, আয়ানের বয়স যখন নয় বছর, তাঁদেরকে সৌদি আরব ছেড়ে চলে আসতে হয়। তাঁর বাবাকে সৌদি সরকার বহিষ্কার করে। এবার তাঁরা ফিরে আসেন ইথিওপিয়ায়। কিন্তু, এখানেও থাকা হয় না। তাঁর মায়ের ইথিওপিয়ার প্রতি ঘৃণার কারণে দেড় বছর পরে তাঁরা চলে আসেন কেনিয়াতে।
নাইরোবিতে স্কুলে যাওয়া শুরু করেন আয়ান আর হাওয়া। এখানেই তাঁরা ইংরেজি শেখা শুরু করেন। তাঁর মা একই রকমের গোঁড়া থেকে যান। স্কুলে তাঁরা যা কিছু শিখতেন, যেমন মানুষের চাঁদে নামা, কিংবা বিবর্তন, এগুলো যে সত্য হতে পারে, তা মেনে নিতে পারতেন না। বিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিলো যে, কেনিয়ানরা এপ থেকে বিবর্তিত হতে পারে, তাঁরা কিছুতেই নয়। চৌদ্দ বছর হতে না হতেই আয়ানকে তাঁর মা ভর্তি করে দেন মুসলিম গার্লস স্কুলে।
ষোল বছর বয়সে আয়ান শিক্ষক হিসাবে পান সিস্টার আজিজাকে। সিস্টার আজিজার সান্নিধ্যে এসে নিজেকে আরো উন্নত মুসলমান বানানোর উপায় খুঁজে পান তিনি। সিস্টার আজিজা শুরুতে ছিলেন সুন্নি মুসলমান। কিন্তু বিয়ের পরে শিয়া মুসলমানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। পুরো হিজাবি ছিলেন তিনি। এমনকি হাত ঢাকার জন্য গ্লাভস এবং পা ঢাকার জন্য মোজা পরতেন তিনি। সিস্টার আজিজা ধর্ম পড়ানোর চেয়ে প্রচারই বেশি করতেন। আর সেটাও ছিলো অনেক বেশি মাদকতাময়। লাঠির ভয় নয়, অদম্য এক টানে তিনি আটকে ফেলতেন তাঁর শিক্ষানবীশদের। তাঁর বক্তব্য ছিলো যে, “আমি কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না তোমাদের উপরে। বরং আল্লাহর বক্তব্য, তাঁর ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে শুধু তোমাদের সাথে ভাগাভাগি করছি। আমরা যদি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার পথ বেছে নেই, তাহলে অবশ্যই আমরা নরকের আগুনে পুড়বো। কিন্তু, আমরা যদি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারি, সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই বেহেশতে যাবো।“
কিছুটা সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত আয়ান সিস্টার আজিজার পথই বেছে নেন। সেই বেছে নেওয়াটাও ছিলো একান্তমনে, একাগ্রে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেন তিনি। দর্জির কাছে গিয়ে পা থেকে গলা পর্যন্ত মোড়ানো পোশাক তৈর করে নেন। মাথায় বাঁধতে থাকেন কালো স্কার্ফ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাটাই তখন তাঁর কাছে ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন এবং সাধনা।
শুধু সিস্টার আজিজা নয়, এসময় তাঁকে প্রভাবিত করে আরেকজন ধর্মপ্রচারকও। তাঁর নাম বোকোল সম। বকোল সম দ্বারে দ্বারে গিয়ে ইসলামের ডাক দিতেন। সিস্টার আজিজা যেখানে হিজাবি ছিলেন, বোকোল সম তেমনি পরতেন সৌদি পোশাক। নাইরোবির সোমালিয়ান তরুণরা তখন বখে যাওয়া শুরু করেছে। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে দলে দলে গিয়ে রাস্তায় আড্ডা পেটায় তারা, মেয়েদের উত্যক্ত করে, কখনো কখনো সুযোগ বুঝে মেয়েদের ধর্ষণও করে। বোকোল সম, এদের সবাইকেই মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দিতে আহবান জানানো শুরু করেন। শুরুতে তিনি একাই এই কাজটা করতেন। এরপরেই তাঁকে সাহায্যের জন্য রাস্তায় রাস্তায় হিড়িক পড়ে গেলো। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মসজিদও তৈরি হয়ে গেলো একটা এবং বোকোল সমকে সেখানকার ইমাম বানিয়ে দেওয়া হলো। দ্বারে দ্বারে ঘুরে দীন ইসলাম কায়েম করা লোক বোকোল সম রাতারাতি একটা আন্দোলনের নেতা বনে গেলেন।
এই আন্দোলনের জোরে মুসলিম ব্রাদারহুড কাজে নেমে পড়লো। সমাজে যে বিশৃঙ্খলা ছিলো, সেটাকে দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলো তাঁরা। রাস্তা থেকে বখাটে ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলো। তাদেরকে নতুন কাপড়-চোপড় দিলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো শিখালো। সহজ ভাষায় বললে, তাদের জীবনকেই পালটে দিলো মুসলিম ব্রাদারহুড। এই ছেলেপেলেগুলোর কোনো দিকনির্দেশনা ছিলো না, ছিলো না কোনো ভবিষ্যৎ ভাবনা। এরাই মুসলিম ব্রাদারহুডের কল্যাণে একটা সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা পেয়ে গেলো।
বোকোল সমের মুল বক্তব্য ছিলো যে, পার্থিব জগৎ ক্ষণস্থায়ী। মহানবির নির্দেশিত পথের বাইরে কেউ যদি চলে, তবে সে তার আসল জীবনের, যেটা শুরু হবে পরকালে, তার পুরোটা সময় ধরেই দোজখের আগুনে পুড়বে। কিন্তু, কেউ যদি সঠিকভাবে চলে, তবে আল্লাহ পুরস্কার হিসাবে তাকে বেহেশতে বসবাস করতে দেবে। আর কেউ যদি আল্লাহ সৈনিক হয়, তবে সে আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করবে।
সিস্টার আজিজা এবং বোকোল সম ছিলেন রণলিপ্সু, রক্ত পিপাসু ইসলামের ধারক এবং বাহক। এই রণলিপ্সু ইসলামের জন্ম হয়েছে মুহাম্মদের মদিনা জীবনের রাজনৈতিক আদর্শ এবং দর্শন থেকে। না বুঝেই আরো অসংখ্য মানুষের মতো আয়ানও এর খপ্পড়ে পড়ে যান। ফলে, আয়াতুল্লাহ খোমেনি যখন সালমান রুশদির কল্লা চাইলো স্যাটানিক ভার্সেস লেখার অভিযোগে, তখন এটা উচিত কি অনুচিত সেই বিবেচনায় আয়ান গেলেন না। বরং আয়াতুল্লাহ খোমেনির সাথে সহমত পোষণ করলেন। শুধু তিনি একা নন, তাঁর সম্প্রদায়ের সব মানুষেরই এক কথা ছিলো যে, সালমান রুশদিকে মরতে হবে। সে নবিকে অপমান করেছে। কাজেই, শাস্তি তার প্রাপ্য। এর বাইরে অন্য কোনো কিছু চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। একদিন তিনি যাদের ফতোয়াকে বিশ্বাস করে একজন লেখকের হত্যার হুমকিকে সমর্থন করেছিলেন, সেই তারাই যে অনাগত দিনে তাঁর মৃত্যুর জন্যও অজস্র ফতোয়া দেবে, হুমকি দেবে, হত্যা প্রচেষ্টা চালাবে, সেটা দুঃস্বপ্নেও হয়তো কল্পনা করেন নি তিনি।
৩. পলাতক পয়োমুক
ঘন মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে যেমন রূপালি আলোর ঝিলিক খেলা করে, সেরকম আয়ানের এই গোঁড়ামির অন্তরালেই বয়ে চলেছিলো মৃদুবেগে কোনো অন্তঃসলিলা। ছোটবেলা থেকেই প্রবল কৌতুহলী ছিলেন তিনি। সেই সাথে ছিলো সবকিছু জেনে নেবার জন্য অনর্গল প্রশ্ন করার অদ্ভুত এক বাতিক। এই সব প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত ছিলো দীর্ঘ এক পথে যাত্রা করার অনিশ্চিত এবং টালমাটাল ছোট ছোট পদক্ষেপ। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ, যাকে বলা যেতে পারে একেবারে উল্লম্ফন, তা আসে এর কিছুদিন পরেই।
বিরানব্বই সালে আয়ানের বিয়ে হয়। এটি ছিলো পরিবারের ঠিক করে দেওয়া বিয়ে। তাঁর স্বামী ওসমান মুসা ছিলেন সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত ক্যানাডিয়ান নাগরিক। একজন প্রথাগত, সংসারী সোমালিয়ান মেয়েকে বিয়ে করাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। সোমালিয়াতে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। ওখানে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে বের করা কঠিন। সেজন্য কেনিয়ায় বসবাসরত সোমালিয়ান মেয়ে খুঁজে নেওয়া হয়। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর হবু স্বামী জানিয়ে দেন যে, তিনি ছয়টি ছেলে সন্তান নিতে ইচ্ছুক। আয়ান এই বিয়েতে অমত করে। কিন্তু তাঁর মতামতের কোনো মুল্য দেওয়া হয় না পরিবারের তরফ থেকে। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে আয়ান হস্তান্তরিত হয়ে যান তাঁর স্বা্মীর পরিবারের কাছে। দুই পরিবারের মিলন ঘটে। এবং এটাই ছিলো মূখ্য জিনিস। আয়ান এই সিস্টেমের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র।
স্বামীর সাথে মিলিত হবার জন্য আয়ানকে ক্যানাডায় যাবার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করেন তাঁর পরিবার এবং তাঁর প্রবাসী স্বামী। তাঁর স্বামীই তাঁর যাত্রার সমস্ত ব্যবস্থা করেন, খরচপাতি দেন। স্বামীর কাছে যাওয়া কীভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে ছোট বোন হাওয়ার সাথে পরামর্শ করেন তিনি। হাওয়া তাঁকে পরামর্শ দেয় যে, ক্যানাডায় গিয়ে মুসাকে ডিভোর্স দিয়ে আমেরিকা গিয়ে নিজের জীবন শুরু করাটাই হবে সেরা কাজ।
হাওয়ার বুদ্ধি অবশ্য কাজে লাগান নি তিনি। বরং যাত্রার মধ্য পথেই, হাওয়ার দমকে যেমন পলাতক হয় পয়োমুক, তেমনি করে পলাতক হয়ে যান তিনি। জার্মানির ডাসলডর্ফে ছিলো স্টপওভার। ট্রানজিটের সময়ে এখানেই সবকিছু খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে থাকেন তিনি। আর সেই ভাবনার ফল হিসাবে ক্যানাডাগামী প্লেনে নয়, বরং বনে চলে যান তিনি।
জার্মানিতে থাকার ইচ্ছা তাঁর আদৌ ছিল না। মুসার পক্ষে খুব সহজেই তাঁকে সেখানে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল। তাঁর প্রথম ইচ্ছা ছিল ইংল্যান্ড যাবার। সাথে তাঁর সার্টিফিকেট আছে। লন্ডনে গিয়ে কাজ করে টাকা জমিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। ক্যানাডায় গিয়ে বন্দী জীবন যাপনের চেয়ে, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজের হাতে নিয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করাটাই তাঁর কাছে বেশি শ্রেয় ছিল। তাঁর মায়ের বা অন্য অনেক মুসলমান মেয়ের যে দুর্বিষহ জীবন, তার বাইরেও যে মেয়েদের আলো ঝলমল এক মুক্ত জীবন আছে, তার গন্ধ তিনি পেয়ে যান ইউরোপের আকাশে, বাতাসে এবং মাটিতে।
পরে অবশ্য ইংল্যান্ড নয়, হল্যান্ডে সাহায্য করার জন্য একজন আত্মীয় থাকার কারণে এবং জার্মানি থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার দূরত্বে সহজে যাওয়া যায় বলে হল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
বন থেকে এমস্টার্ডামগামী ট্রেনে চেপে বসেন তিনি। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা একজন ব্যক্তি হিসাবে হল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি। এটি মঞ্জুরও হয়ে যায়। সমাজকল্যান ভাতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন তিনি। ডাচ ভাষা শেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেন, লেখালেখি শুরু করেন, সেই সাথে নানা বিতর্কেও অংশ নেন। সবশেষে ডাচ পার্লামেন্টেও নির্বাচিত হন। এর কোনোটাই ইসলাম ত্যাগ নয়, কিন্তু এগুলোই ছিলো ক্রমে ক্রমে তাঁর ইসলাম থেকে বের হয়ে আসার কার্যক্রম।
বিরানব্বই সালের ২৪শে জুলাই হল্যান্ডগামী ট্রেনে উঠেছিলেন তিনি। এই দিনটাকে তিনি তাঁর নবজন্ম হিসাবে বিবেচনা করেন। এই দিনেই আলাদা একজন মানুষ হিসাবে জন্ম হয়েছিল তাঁর, যে কিনা নিজের হাতেই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেকে ভাবতে পারেন যে, এটাই বুঝি তাঁর ইসলামের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া বা ধর্ম ত্যাগের ঘটনা। আসলে তা নয়। ইসলাম থেকে পালাচ্ছিলেন না তিনি, কিংবা পালাচ্ছিলেন না স্বৈরাচারী সমাজ থেকে গণতান্ত্রিক সমাজে। এরকম বড় কোনো বিষয় ছিল না তাঁর পলাতক হবার পিছনে। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে নিজের জীবনকে নিজে সাজাতে, নিজের হাতে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার পেতে, অজানার পথে অনিশ্চিত পা ফেলেছিল মাত্র।
৪. যুক্তি পথে যাত্রা
বিরানব্বই থেকে দুই হাজার এক সাল পর্যন্ত ধর্মকর্ম পালনকারী একজন মুসলমান হিসাবেই তাঁর কেটেছে। যদিও ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশীলনগুলো কমে আসা শুরু হয়। নামাজ, রোজা বন্ধ হয়ে যায়, হিজাবও হয়ে পড়ে অবাঞ্চিত। তবে, মনের ভিতরেও তখনও তিনি রয়ে যান মুসলমান। এই সময় পাঁচ বছর তিনি তাঁর এক প্রেমিকের সাথে বসবাস করেন। এই প্রেমিক ছিলেন নাস্তিক। এর ঔরসে সন্তান নেবারও পরিকল্পনা করেন তিনি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তিনি একটা দ্বৈত জীবন যাপন শুরু করেন।
এই দ্বৈত জীবন থেকে মুক্তি আসে নাইন-ইলেভেনের পর থেকে। নাইন ইলেভেনের ঘটনার শেষ অংশ টেলিভিশনে সরাসরি দেখেন তিনি। এর সাথে যে মুসলমানরা জঙ্গিরা জড়িত, সেটাও জেনে যান তিনি। জঙ্গিরা এই ঘটনা ঘটালেও অনেক মুসলমান যে, এতে উল্লসিত, সেটাও বুঝতে পারেন তিনি। নাইন-ইলেভেনের আক্রমণের পর একজন ক্যামেরা ক্রু এমস্টারডার্মের রাস্তায় লোকজনের প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করছিলেন। তাঁর ক্যামেরায় একদল উল্লসিত মুসলমান কিশোর-তরুণের দেখা পাওয়া যায়। টুইন টাওয়ার ধ্বংসে বিপুল আনন্দে লাফালাফি করছে তারা। যদিও এরা ছিল অবুঝ এবং অল্পবয়েসী ছেলেপেলে, তবুও এর মাধ্যমে মুসলমানদের মনোভাব কিছুটা হলেও অনুমান করে ফেলেন আয়ান।
পরের দিন সকালে আয়ান দেখা করতে যান লেবার পার্টির চেয়ারম্যান রুড কুলের সাথে। ইউরোপের আরো অনেক উদার মানুষের মতো রুডেরও ধারণা ছিল যে, নাইন ইলেভেনের এই হামলার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। রুড দুঃখের সাথে মাথা নাড়িয়ে আয়ানকে বলেন যে, ‘কী রকম অদ্ভুত দেখো! সবাই বলছে যে এর সাথে ইসলাম জড়িত।‘ কিন্তু আয়ান যখন তাঁর সাথে দ্বিমত করে বলেন যে, এর সাথে আসলেই ইসলামের সম্পর্ক রয়েছে। তখন রুড ব্যাখ্যা দেন এভাবে যে, ‘আয়ান, এই লোকগুলো অবশ্যই মুসলমান, তবে বদ্ধ উন্মাদ এরা। আমাদের খ্রিস্টানদের মধ্যেও চরমপন্থী লোক আছে, যারা বাইবেলকে আক্ষরিকভাবেই অনুসরণ করে। বেশির ভাগ মুসলমানই এগুলো সমর্থন করে না। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যা কিনা সভ্য এবং শান্তিপূর্ণ, তার জন্য এতে সম্মতি জানানোটা সম্মানহানিকর ব্যাপার।‘
অতি অবশ্যই রুডের এই উদার বক্তব্যকে গ্রহণ করেন নি আয়ান। রুড শুধু একা নয়, পুরো হল্যান্ডই এরকম উদার মনোভাব পোষণ করেছে। আয়ান বুঝতে পারেন যে, ধর্মীয় চরমপন্থার কারণে হল্যান্ডে কখনোই কিছু ঘটে নি, সেই কারণে সবাই ভান করছে যে, ভবিষ্যতেও এখানে কিছু ঘটবে না। হল্যান্ড ভুলে গেছে যে, ঈশ্বরের নির্দেশে মানুষের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব, সম্ভব সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়া, সম্ভব মানুষকে জেলে ঢোকানো, এমনকি সম্ভব খুন-খারাবিও করা। এই ধরনের ভয়ংকর ধর্মের উপস্থিতি কয়েক শতাব্দী ধরেই হল্যান্ডে অনুপস্থিত। ফলে, ধর্ম কতখানি ভয়াবহরূপে, বিধ্বংসী আকারে দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এদেরকে জাগানোর একটা নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করেন তিনি। এই ধ্বংসাত্মক কাজ শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু চরমপন্থীর কাজ নয়, বরং মুসলমানদের একটা বড় অংশই একে দেখে পশ্চিমা কাফেরদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিশোধ হিসাবে। তাঁর নিজের ধর্ম ইসলামের নামে আসলে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই যুদ্ধ ঘোষণায় আয়ানের জন্য অবস্থানগত সংকট তৈরি হয়। কোন পক্ষে যাবেন তিনি? একটা না একটা পক্ষ তাঁকে নিতেই হবে। নিশ্চুপভাবে বসে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমেই তাঁর মনে যে প্রশ্ন আসে, তা হচ্ছে, এটা কি সত্যই ইসলাম? ইসলাম কি এই ধরনের হত্যাযজ্ঞকে অনুমোদন দেয়? তিনি একজন মুসলমান হিসাবে কি এই আক্রমণকে সমর্থন দিতে পারেন? ইসলামের আসলে কোন জায়গায় তাঁর অবস্থান?
এই সময় এই সমস্ত সংকট নিয়ে এই দ্বৈত জীবন যাপনের ভারসাম্য বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাঁর জন্য। এই সন্ত্রাসীদের মূল অনুপ্রেরণা যে নবি মোহাম্মদ, এটাকে বুঝতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হয় নি। তিনি প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া শুরু করেন। কিন্তু, যখন ডাচ রেডিও বা টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে যখন তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করা হচ্ছিলো যে, তিনি একজন মুসলমান কিনা, তখন তিনি টের পেলেন যে, তাঁর স্বর নরম হয়ে গিয়েছে। এর উত্তর দেবার জন্য শব্দ হাতাতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি মুসলিম না অমুসলিম, এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তখনও কাটে নি তাঁর।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি আসে দ্রুতই। যদিও সেই মুক্তি ছিলো ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর মনের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো ছিলো সেগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যান তিনি। কোরান আল্লাহ লেখে নি, মোহাম্মদ নৈতিকতার পথপ্রদর্শক না, মৃত্যুর পরে কোনো জীবন নেই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে নি, এই ধারণাগুলো মনের মধ্যে মুক্ত হয়ে আসে। ধর্মবিরোধী এই অবস্থান নিয়ে ইসলামে থাকা সম্ভব নয়। এটা ইসলামের মুল স্তম্ভকেই চ্যালেঞ্জ করা। এই চ্যালেঞ্জের মাধ্যমেই দীর্ঘ এক যাত্রার শেষে যুক্তি পথে যাত্রা শুরু হয় তাঁর।
তারপরেও তাঁর এই যুক্তি পথে যাত্রাকে, বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসের পথে যাত্রাকে আরো সুস্পষ্টভাবে বললে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার যাত্রাকে, শুধুমাত্র নাইন-ইলেভেনের অবদান বললে ভুল হবে। যদিও এটিই ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করেছে। নাইন ইলেভেনের পরেই তিনি মুসলমান হিসাবে তাঁর বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছেন। যদিও এর পিছনে মূল কারণ হিসাবে রয়ে গিয়েছে, তারও আগে পশ্চিমা চিন্তা-ধারার সাথে তার চেনা পরিচয় এবং সংশ্রব। এই পশ্চিমা চিন্তা-ধারা যৌক্তিক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়, মুল্যায়ন করে এবং একে ডালপালা গজিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
৫. অয়োময়ী অভ্রমালা
ইসলামকে সমালোচনা করে জীবননাশের হুমকি পেয়ে চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তা পাচ্ছেন, এমন লোক এই দুনিয়ায় শুধু আয়ান হারসি একাই নন। আরো অনেকেই আছে। কিন্তু, আয়ান হারসির মতো এই বিপদাপন্ন জীবনযাপনের সময়েও রাজকীয় স্টাইল ধরে রাখা আর কারো পক্ষেই সম্ভব হয় নি। গার্ডিয়ানের এন্ড্রু এন্টনি বলেছেন যে, আয়ান দেখতে ফ্যাশন মডেলদের মতো, কিন্তু যখন মুখ খোলেন তখনই বোঝা যায় বুদ্ধির ঝিলিক এবং প্রাজ্ঞতা। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, প্রকাশভঙ্গীর তীক্ষ্ণতা তাঁকে অনেকের মাঝেই আলাদা করে ফেলতে সক্ষম। যে আভিজাত্য এবং সাবলীলতা নিয়ে তিনি ইন্টেলেকচুয়াল ডিবেটকে মোকাবেলা করেন তা অবাক বিস্ময়ে দেখা ছাড়া গতি থাকে না। ইংরেজি তাঁর তিন নম্বর ভাষা। অথচ এই ভাষায় তাঁর দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। ক্ষুরধার মেধা এবং গভীর পড়াশোনা দিয়ে তিনি যা উপলব্ধি করেন, তা অত্যন্ত জোরালোভাবে বলার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হন না তিনি। পশ্চিমের অন্য অনেকেই যেখানে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার চেষ্টা করেন, সেখানে আয়ান হারসি কোদালকে কোদাল বলতেই বেশি পছন্দ করেন।
আয়ান হারসি আলি তাঁর ইনফিডেলে বিশ্বাস থেকে যুক্তিপথে যাত্রার যে গল্প আমাদের শুনিয়েছে, তা হয়তো অভিনব নয়, আরো অনেকের জীবনেই এমন ঘটেছে। কিন্তু, যে গভীরতা নিয়ে, যে দৃঢ়তা নিয়ে, যে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে তিনি সেই যাত্রার গল্পকে আমাদের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা অনেকের মনেই সাহস এবং আশার সঞ্চার করবে। বিশ্বাসের নিরাপদ পথ ছেড়ে দিয়ে বিপদসংকুল যুক্তি পথে আসার জন্য বিশাল সাহসের প্রয়োজন হয়। আয়ান তাঁর নিজের সাহসের বহু অংশই তাঁর কথামালার মাধ্য সঞ্চারিত করে দিয়েছেন তাঁর পাঠকের মাঝে। এখানেই তাঁর মূল সার্থকতা নিহিত। ইনফিডেলের প্রশংসা করতে গিয়ে বারবারা আইসোল্ডও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশনে একই ধরনের কথা বলেছেন।
“Infidel, Ayaan Hirsi Ali’s autobiography, is an extraordinary document. It is the story of a highly intelligent, courageous young woman, contending with widely opposing traditions, at a time of enormous historical transition. It describes a different culture of childhood and its effects. But it also demonstrates the way in which the early emergence of the capacity to self-reflect can have an impact on later ability to think clearly, especially when anxiety is high.”