আনসার আল ইসলাম সম্পর্কে গত তিন সপ্তাহ ধরে অনলাইনে অনুসন্ধান চালালাম। যা পেলাম সেটা আজ এই সল্প পরিসরে আর না বলি। এক শব্দে “অবর্ণনীয়”। যেই বইটা পড়ে আমার এই অনুভূতি হয়েছে সেই বইয়ের নাম “উন্মুক্ত তরবারী”। বইটা ডাউনলোড করে নিতে পারবেন এখান থেকে। এতদিন ধরে যে ধর্ম পালন করে এসেছি সেই শৈশব থেকে, যে ধর্ম আমার বাবা-মা পালন করেছেন বা করছেন, যে ধর্মের বক্তা ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় দাদাজান আমি সেই ধর্মের প্রতি আজ নিরাসক্ত হয়ে পড়ছি এসব পড়ে। এতদিনের সাজানো বিশ্বাস আমার আজ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ছে। এই দুঃখ আমি কাকে বোঝাব? হঠাৎ বিশ্বাস আমাকে আজ সামনে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করে যেন বলছে হয় তুমি বিশ্বাসী হও নয়ত মানবিক মানুষ। আর যেসব নথি পত্র আমি এই আনসার আল ইসলামের বই পত্রে পেয়েছি কোরান ও হাদীসের রেফারেন্স সহ, সেগুলোর প্রতিউত্তর আমার কাছে নেই। রিক্ত হাতে আমি এক বিষাদ নিয়ে এই লেখা লিখতে বসেছি।
ওরা তাদের এই বইয়ে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে যে এই “ম্যান মেইড” (তাগুতি) আইন বা গণতন্ত্র ওরা মানে না এবং এটিকে তারা ধ্বংস করবেই। ধ্বংস করে ওরা খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করবে। ওরা কোরান ও হাদীসের থেকে সেগুলোর কম্পাটিবল আদর্শ থেকে আইন বানাবে এবং এবং বাংলাদেশের মাটিতে ওরা এটা করবেই।
(আনসার আল ইসলামের সাইট থেকে নেয়া ছবি)
অনলাইনে ওদের প্রচারিত বই “উন্মুক্ত তরবারী” [Unmokto-Torbari] তে তারা বুখারী শরীফের ৪০৩৯ নাম্বার হাদীসের উদাহরণ দিয়ে স্পস্ট দেখিয়েছে যে ইহুদী “আবু রা’ফে” কে হত্যা করবার জন্য স্বয়ং নবী মুহম্মদ কিভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে আতিককে নেতা বানিয়ে একটি স্লিপার সেল বানিয়ে পাঠিয়েছিলো। এগুলো ছাড়াও খোদ আনসার আল ইসলামের ওই বইতে বর্ণিত হয়েছে তারা কিভাবে নবীর নির্দেশে ইবনে খাতাল, কা’ব ইবনে আশরাফ,আবু আফাক, একজন অন্ধ সাহাবী কর্তৃক নিজ দাসীকে হত্যা সব মিলিয়ে প্রায় ৫/৬টা হত্যা কান্ডের কথা বলেছে যেখানে কেউ নবীজি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য বা সমালোচনা কিংবা অশভোন কথা বললেই তাকে হত্যা করা হোতো।
যদিও একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে এই হাদীসে যা বর্ণনা করা হয়েছে সেটির মধ্যে আমি কিছু সিভিয়ার ত্রুটি পেয়েছি। রাফে কে হত্যা করতে যাওয়া ও হত্যা করবার যে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেখানে লজিক দিয়ে চিন্তা করলে এই পুরো ঘটনাকে অসত্য বলে মনে হতে পারে। এখন এটি যদি অসত্য হয় তবে সহীহ হাদীসে আসা একটি হাদিসকে মিথ্যা বলে বলতে হয়। কিন্তু সেটি কি আমার বলা উচিৎ হবে?
আবার উন্মুক্ত তরবারী গ্রন্থে হাদীস গ্রন্থ আবু দাউদের ৪৩৬৩ নং হাদীসে মহানবীর একজন অন্ধ সাহাবা তার দাসীকে যে মেরে ফেলেছে সেটির বর্ণনা আছে। সেই দাসীর অপরাধ ছিলো যে তিনি নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত। এই ব্যাঙ্গ করার কারনে সেই সাহাবা মহিলাটিকে মেরে ফেলে। মেরে ফেলবার পর নবী অত্যন্ত খুশি হয় এই ঘটনায় এবং সেই হত্যার শিকার মহিলার রক্ত মূল্যহীন এমনটাই ঘোষনা করে। এ ছাড়াও এই গ্রন্থ থেকে বুখারী হাদীস ১৮৪৬ সম্পর্কে পড়ে দেখি নবী সম্পর্কে বিদ্রুপাত্নক গান গাইবার অপরাধে খুন করা হয়েছে ইবনে খাতাল কে। সেই ইবনে খাতাল কাবার গিলাফ ধরে বাঁচার প্রাণ পন চেষ্টা করলেও মহানবী তাকে ঐ অবস্থায় খুন করতে নির্দেশ দেন।
আনসার আল ইসলাম কোরান শরীফের বিভিন্ন সূরা বিশেষ করে সূরা তওবা, সূরা আহজাব ও সূরা বাকারার নানাবিধ আয়াত দিয়ে স্পস্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে বর্তমান সময়ে যারা নবী, রাসূল কিংবা আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে কিংবা সমালোচনা করে তাদের জন্য একটাই “ঔষধ” আর সেটির নাম হচ্ছে “তরবারী”
আনসার আল ইসলাম এটাও জানিয়েছে যে যেসব মুসলমান/আলেম বলে্ন নিজের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সবচাইতে বড় জিহাদ, নিজের কু প্রবৃত্তি, খারাপ অভ্যাসের সাথে যুদ্ধ করা বড় জিহাদ তারা হচ্ছে সবচাইতে বড় “ইবলিশ”। আনসারের মতে এইসব হচ্ছে “পুতুপুতু” কথা। ইসলাম তরবারী দিয়েই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরাসরি কোপাকুপি-ই হচ্ছে প্রকৃত জিহাদ। এবং শান্তিপূর্ণ জিহাদের কথা যারা বলে তাদেরকেও এক এক করে কোপানো হবে বলে আনসার তাদের সেই বইতে স্পস্ট জানিয়ে দিয়েছে।
এই বইতে যেই হাদীসগুলোর উল্লেখ রয়েছে এবং কোরান শরীফের আয়াতের যে উল্লেখ রয়েছে আমি সেগুলো সাথে সাথে ক্রস চেক করেছি। মহানবীকে সমালোচনা করলে আর সমালোচনাকারীকে যে কখনো স্লিপার সেল পাঠিয়ে কিংবা কখনো নবী ভক্ত নিজ থেকে খুন করে আসত সেগুলো প্রত্যেকটির সত্যতা পেলাম। বুখারী, মুসলিম কিংবা অন্য যেসব হাদীসের কথা বলা রয়েছে তা ওদের ওই বইয়ের সাথে পুরো ১০০% এক রকম।
আমি কেবল ভিন্নতা পেয়েছি আনসার আল ইসলামের নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীর একটা ওয়াজের ভেতরে। এই ওয়াজে সূরা নাহলের আয়াত ৩৬ ও সূরা বাকারার ২৫৬ নাম্বার আয়াত কোরান শরীফে যে প্রেক্ষিতে, ঘটনায় বা যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে সেটা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে রাহমানী তার সামনে বসে থাকা সব ভক্তদের বলেছে যে এই আয়াতগুলোর মানে হচ্ছে জিহাদ করা, মানুষের বানানো আইন ধ্বংস করা এবং আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা।
রাহমানী তার এই ওয়াজের সাথে সাথে এও ক্লিয়ারলি বলেছে যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিতে হবে, ৩৩০ টা আসনের এই নিয়মকে গুড়িয়ে দিতে হবে এবং খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তা না হলে কেউ মুসলমান না।
আনসার আল ইসলাম ( জসীমুদ্দিন রাহমানী কর্তৃক লিখিত) তাদের “উন্মুক্ত তরবারী” গ্রন্থে বুখারী ৩০১৭, ৬৯২২, আবু দাউদ ৪৩৫৩, তিরমিজি ১৪৫৮, নাসায়ী ৪০৭০ এর উদ্বৃতি দিয়ে বলা রয়েছে যে কেউ যদি তার ধর্ম ত্যাগ করে (ইসলাম কে বুঝানো হয়েছে) তবে তাকে হত্যা কর। আমি বুখারী শব্দটা ইংরেজীতে সার্চ দিয়ে ৩০১৭ নাম্বার হাদীসে গিয়ে এই কথার সত্যতা পেয়েছি।
ওই গ্রন্থে আবারো বলা রয়েছে বুখারী শরীফের হাদিসের ৬৬৩২ এর উদ্বৃতি দিয়ে যে একদিন সাহাবা আলী (রাঃ) নবীকে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর নিজের প্রাণ ছাড়া আর সবকিছুর চাইতে নবীকে ভালো বাসেন। নবী এই কথার জবাবে বলেছিলেন যে সত্যকারের বিশ্বাসী হতে হলে নিজের প্রাণের চাইতে নবীকে বেশী ভালো বাসতে হবে। আলী তখন বলেন যে তিনি নবীকে তাহলে নিজের প্রাণের থেকে বেশী ভালোবাসেন। নবী তখন আলীকে বলেন যে “তাহলে এখন তুমি সত্যকারের বিশ্বাসী”। এই অংশ থেকে জানতে পারলাম যে “নিজের প্রাণের থেকে” নবীকে বেশী ভালো না বাসলে বিশ্বাসী হওয়া সম্ভব না।
এই বই পড়ে বুঝতে পারলাম যে এই যে কয়েকটি অল্প দলে দলে ভাগ হয়ে এই ব্লগার, লেখক, শিক্ষক, ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের হত্যা করা হচ্ছে এই পুরো নিয়মটি তারা ফলো করছে নবীর সময়কার “আবু রা’ফে” কে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে সেই পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে একটি দলে ৪ থেকে ৫ জন থাকে। এরা অনেকদিন ধরে টার্গেটের বাড়ী রেকি করে, খোঁজ খবর নেয় এবং একদিন সুযোগ বুঝে ছুরি বা তলোয়ার নিয়ে কোপায়। এই পদ্ধতিতে নবীজির সাহাবারা নবীর সমালোচনাকারীদের খুন করত সুতরাং আন্সার আল ইসলাম একই পদ্ধতিতে খুনের রাস্তা বেছে নিয়েছে।
এইরকম খুন যে তারা আরো করবে সেটি তারা তাদের ওয়েব সাইটে লিখে দিয়েছে পরিষ্কার ভাবে। হতে পারে সেটি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ব্লগার, সমাজ কর্মী। যে কেউ। এইসব খুন, খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার জন্য এই নৃসংসতা সব কিছুরই একটা যুক্তি তারা দিয়েছে। সেটি হচ্ছে- মৃত্যুর পর তারা আল্লাহর কাছে “কোন মুখ” নিয়ে দাঁড়াবে কিংবা নবীর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে যদি নবী বা আল্লাহ তাদের জিজ্ঞেস করে যে দুনিয়ায় তারা কেন আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আর তারা এইসব ব্যার্থতার দায় নিয়ে পরকালে “জাহান্নামী” হতে চায় না, সে কারনেই তারা দুনিয়ায় এসব করছে।
আমি উপরে যেসব সূত্রের কথা বললাম বা লিখলাম, সেসব একটাও আমার নিজের বানানো নয়। আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী দলটি অনলাইনে অসংখ্য ডকুমেন্ট, হুমকি, তাদের প্রকাশনা, ভিডিও রেখে দিয়েছে। একটু খুঁজলেই এসব পাওয়া যায়। আমি তাদের এমন অসংখ্য লেখা বা ভিডিও থেকে শুধু তাদের একটি মাত্র প্রকাশনা “উন্মুক্ত তরবারী” থেকেই আজকে সব উদ্বৃত করলাম।
আমি সারাটা জীবন যে ধর্ম মেনে এসেছি সেটা জন্মের পর পর বাবা মা যে ধর্ম পালন করতেন সেটা দেখেই। আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে তাই জন্ম সূত্রে আমি মুসলিম এবং ধর্ম হিসেবে আমি ইসলাম ধর্মকেই মেনে চলি। মাহজাব অনুযায়ী আমি সুন্নি মুসলিম। আমার বয়স যখন ১৩/১৪ ছিলো তখনই বাসায় হুজুর রেখে আমাকে কায়দা, আমপারা ও কোরান শরীফ খতম দেয়ানো হয়েছিলো। কোরান পুরোটা শেষ করতে পারাকে বাংলাদেশে বলে “খতম দেয়া”। আমি সেটা খতম দিয়েছি আমার বয়স যখন ১৫ কিংবা ১৬ ছিলো। আমি কোরান শরীফের কিছু না বুঝেই খতম দিয়েছিলাম। তারপর একটা সময় লেখার খাতিরে কিংবা গবেষনার খাতিরে বাংলায় কোরান পড়েছি অনেকবার। তাও পুরোটা নয়, ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্ন সূরা।
আনসার আল ইসলাম তাদের “উন্মুক্ত তরবারী” গ্রন্থে যে হাদীস বা কোরানের আয়াত ব্যবহার করেছে সেগুলো দেখে আমি আতংকিত বোধ করেছি। আমার এতদিনের পালনকরা ধর্ম আমার সামনে অচেনা হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের হাদীসে ক্লিয়ারলি লেখা রয়েছে যে কিভাবে মহানবী স্লিপার সেল পাঠিয়ে সাহাবা আতিকের মাধ্যমে আবু রাফেকে হত্যা করেছেন, একজন গর্ভবতী মহিলাকে পর্যন্ত সাহাবীরা হত্যা করেছেন, নবীর নামে একটা সমালোচনা মূলক কবিতা লেখার কারনে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে।
আমি ছোট বেলা থেকেই জেনে এসেছি যে মহানবী ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল ও দয়াশীল। শত্রুরা তাঁকে আঘাত করলেও তিনি শত কষ্টে মুখে হাসি এনে বলেছিলেন “এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর”। আমি নবীকে আমার মনে এইভাবেই স্থান দিয়েছি ও ছবি একেঁছি যে উনি তাঁর প্রতি বিদ্রুপকারী ও সমালোচনাকারীদের প্রতি অত্যন্ত নমনীয়। আমরা সাধারণ মানুষ হয়ত একটু সমালোচনা শুনলেই রেগে যাই কিন্তু আমি নবীর ছবি এঁকেছি যে তিনি তো আমার কিংবা আমাদের মত নন। আমরা শৈশবে গল্প পড়েছি যে নবীর পথে যে বুড়ো মহিলা কাঁটা রেখে যেতেন সেই মহিলা অসুস্থ হলে নবী-ই সেই বুড়ো মহিলার খোঁজ নিতে তার বাসায় যান।
কিন্তু আজকে আনসার আল ইসলামের এই “উন্মুক্ত তরবারী” গ্রন্থ এমন এক অচেনা ছবি্র সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো যে আমার এত দিনের সাজানো ও গোছানো সব ছবি ভেঙ্গে পড়বার যোগার। তাহলে কি আমি এতদিন কোরান ও হাদীস নিয়ে ভুল জেনে এসেছি? সেই সাথে কোরান ও হাদীস নিয়ে আমার অসংখ্য প্রশ্ন এসে আমার মনে ভীড় করেছে যে এগুলোর উত্তর আমি কার কাছে পাব জানিনা। গত কয়েকটি দিন ধরে আমি কতটা কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছি সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারা অসম্ভব।
আনসার আল ইসলাম যে রক্তপাতের ইসলামের কথা বলছে, যে নৃশংসতার কথা বলছে সেভাবে তো ইসলাম পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব না কিংবা আমি তো আমার নিজের প্রাণের থেকেও, আমার সন্তান, বাবা মায়ের থেকেও নবীকে বেশী ভালো বাসতে পারবোনা। তাহলে তো আমি প্রকৃত বিশ্বাসী নই। আর এইভাবে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভবও না।
একের পর এক আমার ব্লগার বন্ধুরা রাস্তায় খুন হয়ে মুখ থুবড়ে রক্তে জমাট বেঁধে পড়ে রয়েছে, একের পর এক লেখক শিক্ষকদের খুন করে ওরা ইসলাম কায়েম করবে, খিলাফাহ কায়েম করবে, আমি তো এইভাবে আমার এতদিনের পালন করা ধর্মকে মেনে নিতে পারব না। কোনোভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি বুঝিনা যেখানে কোরান শরীফে ক্লিয়ারলি বলা রয়েছে যে “আমি আদমের মধ্যে আমার রুহ ফুঁকে দিলাম” (সূরা হিজর, আয়াত ২৯/ সূরা সোয়াদ, আয়াতঃ ৭২) কিংবা সূরা আল ওয়াকিয়াতে বলা রয়েছে যে “সে সময় তোমাদের চেয়ে আমিই তার (মৃত ব্যক্তি) অধিকতর নিকটে থাকি৷ কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না” (আয়াত ৮৫)
আমার মাথায় এসব কিছুই আজকে ঢুকছে না। যেখানে আল্লাহ কোরানের এক আয়াতে বলছেন একজন মৃত ব্যাক্তির সবচাইতে নিকটে তিনি থাকেন আবার সূরা তওবার আয়াত ৫ নাম্বারে তিনি বলেন- “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক”
যেই সত্ত্বা নিজের রুহ ফুঁকে দিলেন মানুষের মধ্যে, যেই সত্ত্বা মৃত্যুর সময় সেই মৃত ব্যক্তির অতি নিকটে থাকেন সেই সত্ত্বা আবার কিভাবে এই মানুষকে হত্যা করবার নির্দেশ দিচ্ছেন?
আমার সব কিছু উলোট পালট হয়ে যাচ্ছে আজ। এই মানুষকেই উনি তৈরী করলেন, তিনিই তাদের জ্ঞান বুদ্ধি দিলেন আবার তিনিই অন্য মানুষকে নির্দেশ দিচ্ছেন ওইসব মানুষকে মারতে যদি তাঁর কথা না শুনে। কেন? মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে মানুষ কি তবে প্রতিদন্দ্বীর মত?
আমি নগন্য জ্ঞান দিয়ে, আমার অতি তুচ্ছ জ্ঞান দিয়ে আমি হয়ত কিছুই বুঝতে পারিনি। যদি আমার লেখায় কেউ ব্যথা পান কিংবা কষ্ট পান তবে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি কাউকেই আঘাত দিয়ে একটা শব্দও বলতে চাই নি বরং আমার ভেতর থেকে আজ এসব সব প্রশ্ন উঠে আসছে, আমি এতদিনের চেনা ধর্মের যে ছবি আমার ভেতরে ধরে রেখেছি সেটি ভেঙ্গে পড়ছে ধীরে ধীরে। কোনো ধর্মে অবিশ্বাসীর লেখাই আমাকে ধর্মচ্যুত করতে পারেনি এতটা কাল অথচ যেই আনসার আল ইসলাম, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এইসব হত্যা যজ্ঞ করে যাচ্ছে সেই তাদের লেখা পড়েই আমি আমার নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। হোয়াট আ আয়রনি…
নবীকে গাল দিলে আমি খুব বড়জোর সেই ব্যাক্তির কথাকে বিশ্লেষন করে ভদ্রভাবে উত্তর দিতে পারি যদি আমার কাছে যুক্তি থাকে কিন্তু তাই বলে প্রাণ কেড়ে নেয়া? এটি তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর যদি এটি না করতে পারাতে আমি “ভুয়া” মুসলিম হিসেবে পরিচিত পাই, তবে তাই হোক। আমি নবীর জন্য নিজের প্রাণও দিতে পারব না কিংবা কাউকে খুনও করতে পারব না। এতে করে যদি দোজখ আমার ঠিকানা হয় ধর্ম মতে তবে সেটি-ই মেনে নেব। আর হাদীস কোরানে এই টাইপের হত্যা কর, মেরে ফেলো, খুন কর এসব কথা যা দেখেছি, সেগুলোর পরে ধর্ম আমার কাছে পান্সে হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আমি আজ চরম ভাবে ভারাক্রান্ত ও হতাশ। এতদিন যে ধর্মকে আমি আঁকড়ে ধরে রেখেছি সেটি আজ এইভাবে আমাকে কাছে এসে জানান দিয়ে গেলো।
গতকাল রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইংরেজীর শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যার খুন হয়ে পড়েছিলেন একটা সরু গলিতে।চারিদিকে রক্ত আর রক্তের বন্যা। স্যারের পাশে পড়েছিলো একটি ব্রাউন রঙের ব্যাগ। এটি নিশ্চয়ই স্যারের ব্যাগ। স্যার এটি হাতে করে যাচ্ছিলেন। কষ্টে চোখটা বন্ধ করবার আগে শুধু স্মৃতিতে সেই ব্যাগটি কি কারনে যেন গেঁথে রইলো। গতকাল দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি শুধু মনে করতে পারি আমি সেই দুঃস্বপ্নে সেই নিঃসঙ্গ ব্যাগটিই কেবল দেখেছি।
আজ কম্পিউটার খুলেই জানতে পারলাম কলাবাগানে খুন করা হয়েছে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামের দুজন ব্যাক্তিকে। জানা গেছে জুলহাজ মান্নান রূপবান নামের একটি সমকামী পত্রিকার সহ সম্পাদক ছিলেন। এটাই কি তাঁর অপরাধ?
জুলহাজ ভাইয়ের ফেসবুকে গিয়ে দেখি তিনি শেষ লেখা লিখেছেন ১৬-ই এপ্রিল। দুহাতে ধরা একটি লালফুলের ছবি দিয়ে ক্যাপশনে লিখেছেন,
“শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধির পাশে
তরুন ইরান কবি কাঁদে নিরজনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে”
রেজাউল স্যারের মৃতদেহ দেখে স্বাভাবিক ছিলাম। এসব দেখতে দেখতে ভেতরটাও নিজেকে ওইভাবে তৈরী করে নিয়েছে। বোধ শূন্য। অথচ কি অদ্ভুত!! যে রক্তে ভেসে যাওয়া শরীরটুকু আমাকে আক্রান্ত করতে পারেনি সেই আমার ভেতরটা ছার খার হয়ে গেছে তাঁর সেই দেহের পাশে পড়ে থাকা শূন্য একটা নিঃসঙ্গ খয়েরী ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে। আজ, এই মুহুর্তে জুলহাজ ভাইয়ের এই হত্যাকান্ডের পর নিরবে শুধু সেই খবর দেখেছি। চুপ চাপ দেখে গেছি পাঠকের মন্তব্য, কথা। শুধু তাঁর ফেসবুকে ওই চার লাইনের কবিতাটা আমার ভেতরটা সব উলোট পালট করে দিয়ে গেলো।
ঝরা মনে গোলাপের বিলাপ শুনে…তরুন ইরানি কবি কাঁদে নিরজনে…